বাগান পরিচর্যা
পরদিন
সকালে সবাই প্রথমে মাঠে এসে উপস্থিত হল। প্রথমে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা হল ফুলি
বাবুর পরিবারের সমস্যা নিয়ে কি করা যায়। একেক জন একেক রকম বুদ্ধি দিল। কিন্তু কোনও
সিদ্ধান্তে পৌছানো গেলো না।
ঠিক
হল প্রথমে ফুলি বাবুর বাসাতে যাওয়া যাক। জঙ্গলের রাস্তায় ফুলি বাবুদের আইল দিয়ে ঢুকতেই
ওদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ভাব দেখে মনে হল বাচ্চা দুটো ওদের অপেক্ষাতেই দাড়িয়েছিল।
ভন্ডূলদের দেখেই ফুলি আর বাবু দৌড়ে আসলো।
গতকাল ভন্ডূলরা ফুলি বাবুর বাবার ব্যাপারে
যথাসম্ভব খোঁজ খবর নিয়েছে আশেপাশে। ভন্ডূল ও বিদ্যুত লোকাল থানায় পর্যন্ত গিয়েছিলো
ওসি সাহেবকে জানাতে ও পরামর্শ নিতে ফুলির বাবার নিখোজ হওয়ার ব্যাপারে। ট্রেনের ঘটনার
পর থেকে ওসি সাহেব ভন্ডূল বিদ্যুতকে খুব পছন্দ করেন। তিনি বলেছেন এ ব্যাপারে যতটুকু
সম্ভব সহযোগিতা করবেন। তবে ওসি সাহেবের সন্দেহ ফুলির বাবা ঢাকায় চলে গেছে অধিক আয় রোজগারে
উদ্দেশ্যে।
ফুলির মার সাথে এ ব্যাপারে ওদের কথা হল
কিছুক্ষণ। এরপর ওদের সামনে একটি প্রশ্ন হল এল যা ভন্ডূল বিদ্যুতদের সামনে কখনও এভাবে
আসেনি। হঠাৎ ফুলির মা প্রশ্ন করল ‘‘ফুলির বাপ না আইলে আমরা খামু কি? ’’
তাইতো!
যতদিন ফুলির বাবার সন্ধান না পাওয়া যাচ্ছে। ততদিন ওদের আয় উপার্জন অথবা খাদ্য সংস্থানের
ব্যবস্থা কি হবে?
ফুলির
মা আবার বলল ‘‘বাচ্চা দুইটারে রাইখা আমিও কোনও বাড়ীতে কাম করতে যাইতে পারি না, কি যে
করুম বুঝতে পারতাছি না।’’
ভন্ডূলরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলো।
এ ধরণের সমস্যার সমাধান ওদের অজানা।
হঠাৎ সাজু বলল ‘‘আপনি কোনও হাতের কাজ বা
বিশেষ কোনও কাজ জানেন যা অন্যরা করতে পারে না ?’’
সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালো। ফুলির মা
অবাক হয়ে বলল “হাতের কাজ বলতে তো বাবা রান্ধন ছাড়া আর কিছু জানি না। তয় ছোট বেলায় বাবার
কাছে কিছু মালির কাম শিখছিলাম।’’
‘‘কি ধরণের মালির কাজ শিখেছিলেন ? ’’ ভন্ডূল
জানতে চাইলো।
ফুলির মা বলল ‘‘এ ধরেন বীজ থেইকা গাছের
চাড়া জ্বালান, মাটি মিশানো, গাছে কলম দেওয়া এই সব কাম পারতাম।“
‘‘এক্সেলেন্ট ’’
হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠল ভন্ডূল। ছেলেরা সবাই খুবই অবাক হয়ে ওর কান্ড দেখছে।
ছেলেদের দিকে তাকিয়ে ভন্ডূল জিজ্ঞেস করল
‘‘কি আমরা সবাই পরীক্ষার পর কি করব খুঁজে বেরাচ্ছিলাম না?’’
সবাই
এক সাথে মাথা নাড়লো উপর নীচে।
‘‘হয়ে গেলো আমাদের নতুন এ্যাডভেঞ্চার।’’
ভন্ডুলের কথা ছেলেরা কিছুই বুঝতে পারছে
না।
ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো ভন্ডূল-‘‘কি
তোরা বুঝতে পারছিস না আমি কি বলছি?’’
বিদ্যুত
গোমড়া মুখে বলল ‘‘বুঝিয়ে বল।’’
ভন্ডূল ওদের সবাইকে ওর পরিকল্পনা বুঝিয়ে
বলল।
ক্লাশের
ফাস্ট বয় সাজু মন্তব্য করলো ‘‘যাক্, পরীক্ষার ছুটিটা কাটানোর একটা জবরদস্ত কাজ পাওয়া
গেলো এবং ফুলিবাবুর মার প্রবলেমও সলভ হয়ে যাবে।’’
ফুলির
মা ওদের পরিকল্পনা শুনে এতই অবাক হয়েছে যে কথা খুজে পাচ্ছে না। মহিলার চোখে পানি এসে গেলো। ‘‘আল্লাহ, তুমি আমার এই কঠিন বিপদের
সময় সোনার টুকড়া ছেলেগুলোরে কই থেইকা পাঠাইলা।’’
কিছুক্ষণ
পর সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল- বিকালে সবাই যার যা সঞ্চয় আছে তা নিয়ে আসবে, সেই টাকা
দিয়ে ফুলি বাবুদের জন্য একটা নার্সারী তৈরী করার চেষ্টা করা হবে। বাজার থেকে বীজ, টব,
ছোট পলিথিন প্যাকেট প্রয়োজনীয় সার কেনা হবে।
বিদায়
নিয়ে ওরা তখনকার মত যার যার বাসায় চলে গেলো। তার আগে ফুলির মার কাছ থেকে জেনে নিল নার্সারি
তৈরীর জন্য ওদের কি কি জিনিস প্রয়োজন।
বিকালবেলা
সবাই ভন্ডূলদের বাড়ীর পেছনে মাঠে মিলিত হল। সবার সঞ্চয় মিলে ওদের হাতে এসেছে তেইশ শত
টাকা। ঠিক হল ১৩০০ টাকায় বীজ ও অন্যান্য জিনিস কেনা হবে এবং ১০০০/- টাকা ফুলির মার
হাতে দেয়া হবে ওদের সাময়িক সংসার খরচ চালাবার জন্য।
বাজার
করে ওরা যখন ফুলিদের বাসায় পৌছল তখন প্রায় সন্ধ্যা। ফুলির মা টাকা হাতে পেয়ে কেঁদে
ফেলল।
অশ্রু সজল চোখে ছেলেদের গায়ে আদরের
হাত বুলাতে বুলাতে ফুলির মা বলল ‘‘সোনার ছেলেরা, আমি কেমনে তোমাদের ঋণ শোধ করুম! তোমরা
আমার কত উপকার করতেছ।’’
ভন্ডূল
বলল ‘‘কোনও ঋণ নাই, খালা, আপনি আমাদের শেখাবেন কিভাবে গাছের চারা করতে হয়, কিভাবে বাগান
পরিচর্যা করতে হয়। আমরা প্রতিদিন আসবো আপনার সাথে বাগানে কাজ করার জন্য গরমের ছটির
এই কয়টা দিন আমাদের আনন্দেই কাটবে আপনার সাথে কাজ করে।’’
সবাই
ওর কথায় সম্মতি দিল। ফুলির মা বুঝতে পারলো, ছেলেরা বাগান পরিচর্যা শেখার বাহানায় আসলে
মহিলাকে সাহায্য করতে চাইছে। তাঁর সজল চোখে ফুঠে ওঠল এক আনন্দময় হাসি।
পরদিন
সকাল থেকে শুরু হল ওদের অন্য রকম এক শরীর চর্চার ক্লাশ। প্রথমে সবাই মিলে ফুলিদের বাসার
সামনে আগাছা পরিস্কার করল। এরপর উঠানটাকে ওরা দুই ভাগে ভাগ করে মাটি তৈরীর কাজে লেগে
গেলো।
উঠানের
বাম দিকে কাজ করল পাঁচজন। বাকী পাঁচজন ডান দিকে। ওরা বাসা থেকে কোদাল ও পাঠের বস্তা
নিয়ে এসেছে। পাঁচ মিনিট মাটি কোবানোর পরই মিন্টু বলে উঠল ‘‘বাপরে বাপ। আমারে মাপ কর।
আমি মাটি কোবাইতে পারুম না। আমি মইরা যামু! আমার ক্ষিদা লাগছে। ’’
মোটা
ছেলেটা একটু পরিশ্রমেই ঘেমে একাকার হয়ে হাপাচ্ছে।
বিদ্যুত
ধমক দিল ‘‘এই মটকু চুপ কর! সারাক্ষণ খালি ক্ষিদা আর ক্ষিদা। কাজ না করতে পারলে চুপ
চাপ বইয়া থাক। একটু পর সবাই এক সাথে মুড়ি চানাচুর খামু।’’
ওরা
সাথে করে মুড়ি চানাচুর নিয়ে এসেছে।
ওপাশ
থেকে ভন্ডূল ওদের কথা শুনতে পেয়ে বলল “এক কাজ করা যাক ,মন্টু বা যাদের মাটি কাটতে কষ্ট
হচ্ছে তারা অন্য কাজ করুক। জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে এনে বাগান বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করুক ওরা।’’
দেখা গেলো মোটা মিন্টু, গুডবয় সাজু, অলস
রাসেল ও শুভ্র বাঁশ কেটে বেড়া দিতে বেশী আগ্রহী।
ভন্ডূল বলল ‘‘ঠিক আছে, কাজ ভাগাভাগী হয়ে
গেলো। এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে, দেখা যাক, যার যার কাজ কে কত ভালো ভাবে
করতে পারে।’’
শুরু হয়ে গেলো দুই গ্রুপের প্রতিযোগিতা ফাস্টবয় সাজু দড়ি
দিয়ে মাপজোক শুরু করল। ওর দেয়া মাপ থেকে মিন্টু , রাসেল ও সুভ্র গিয়ে বাঁশ কেটে আনলো।
সাজু তখন মাটিতে দাগ কেটে বাগানের বেড়ার খুব সুন্দর একটা ডিজাইন করে ফেলেছে। ওর ডিজাইন
দেখে মিন্টু খুব উৎফুল্ল। বাহ!
ফাস্ট বয় তার জ্ঞান চর্চা শুরু করেছে !
এদিকে ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন বাবলু এক নাগারে
মাটি কুপিয়ে যাচ্ছে। সব সময় ওর মুখে হাসি। কোনও পরিশ্রমই ওর কাছে কষ্টের নয়। ওর দেখা
দেখি ভন্ডূল, বিদ্যুত, টুটুল, নিপু ও তিতু চেষ্টা করছে যথেষ্ট। কিন্তু বাবলুর অর্ধেক
মাটিও ওরা কোপাতে পারেনি। তবু একটু পর পর বিশ্রাম নিয়ে ওরা একটানা দুপর পর্যন্ত মাটি
কাটা চালিয়ে গেলো।
এরপরের কয়েক দিনে ওরা ফুলির মার কাছে শিখলো
কিভাবে মাটিতে জৈব সার ইউরিয়া টিএসপি সার মেশাতে হয়।
মাটি তৈরীর পর এল সবচেয়ে উত্তেজনাকর সময়।
বৃক্ষরোপন ও বীজ বপন!
ফুলির
মা ঠিক করেছে প্রচলিত কিছু ফুলের গাছ যেমন গোলাপ, গাঁদা, ইত্যাদি করবে আর ফসলের মধ্যে
আম, কাঁঠাল, আঙ্গুর, জাম গাছের চারা তৈরী করবে। এসব চারা ও গাছ বিক্রির জন্য। আর বাগানের
জন্য ওরা শাকসব্জীর গাছ লাগাবে ঠিক করল।
এর মধ্যে একদিন ভন্ডূল ও সাজু কৃষি অফিসে
গিয়ে কর্মীদের থেকে পরামর্শ নিল। কৃষি অফিসের আনিস সাহেবও ট্রেনের ঘটনার জন্য ভন্ডূলকে
চিনতে পেরেছেন, সাজুর সাথে তার আগেই পরিচয় আছে। ওদের উদ্যোগের কথা শুনে তিনি খুবই খুশী
হলেন এবং ওদের সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি
দিলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, মাশরুম ও স্ট্রবেরীর চারা তৈরীর জন্য। এগুলোর এখন সারাদেশ
ব্যাপী খুব চাহিদা। তিনি ফুলির মা ও ভন্ডুলের প্রশিক্ষণের জন্য একজন কর্মীও সাথে দিলেন।
সপ্তাহ পেরুতেই ওদের বাগানে উঁকি দিল বিভিন্ন
ধরণের গাছের অংকুর। প্রথম দেখায় সব গাছই এক রকম মনে হয়। কয়েক দিন পর চারাগুলো আলাদভাবে
বোঝা গেলো।
শুরু
হল চারা আলাদা আলাদা করে পলিথিন ব্যাগে ভাগ ভাগ করা। সর্বমোট ৬০০ গাছের চারা তৈরী হল
বীজ, কাটিং ও কলম থেকে। বর্ষাকাল বলে ওরা মূলত পুইশাক ও ডাটা শাকের বীজ লাগাতে পেরেছে
বাগানে, বাকী সব কলম ও কাটিং করতে হয়েছে।
ফুলির
মা ওদের শেখালো কিভাবে কলম ও কাটিং করতে হয়।
নতুন
শিক্ষা ওদের মধ্যে একটা উত্তেজনা এনেদিল। ভন্ডূলরা সবাই বাগান পরিচর্যা প্রশিক্ষণের
ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছে। ছোট ছোট চারার যত্ন নেয়া যেন একেকটা শিশু পরিচর্যা। সবাই মিলে ঠিক করল স্কুল খোলার
পর হেড স্যারের সাথে কথা বলে এরা স্কুলের মাঠের এক পাশে যে বাগানটা আছে তাতে কিছু চারা
ফুলির মার কাছ থেকে কিনতে বলবে।
ভন্ডূলরা
সবাই এলাকার প্রত্যেক বাড়ী বাড়ী গিয়ে হাতে লেখা লিফলেট দিয়ে এল। সবাই খুব অবাক হয়ে
গেলো নার্সারীর ব্যাপারে ছেলেদের এত আগ্রহ দেখে। দুতিনটা প্রশ্নের উত্তর জেনে এলাকাবাসী
যখন জানতে পারলো, ওদের আসল উদ্দেশ্য ফুলি বাবুর মাকে সাহায্য করা, তখন যেন একটা প্রতিযোগিতা
শুরু হয়েগেলো নার্সারী থেকে গাছের চারা কেনার। কেউ কেউ অগ্রীম অর্ডার পর্যন্ত করলেন।
দেখতে
দেখতে ফুলির মার নার্সারী এলাকার সবচে জনপ্রিয় নার্সারি হয়ে উঠল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন