মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

এখন তখন যখন কখন 1

এখন তখন যখন কখন
মোঃ জহিরুল ইসলাম



কখন 

বৃহস্পতিবারবাদ মাগরিব,  ফেব্রুয়ারী মাস১৯৮৩.
ক্রোধে অন্ধ আবদুল ওহাব জোর কদমে হেটে যাচ্ছে তার পরিনতির দিকে,  সে জানে না। ব্রাম্মনবাড়িয়া রেলস্টেশন  থেকে কখন লোকাল ট্রেনে উঠেছেন,  কখন তালশহর নেমেছেন হুশ নেই।
হাটছেন আর বিরবিরিয়ে নিজেই বলছেন,  কত বড় সাহস আমার নাতিরে রাখে
সেই দুপুর থেইকা আমি নাতির জন্য বইসা রইসিআমার পেটপুড়ার কোন দাম নাই
তালশহুর রেলস্টেশনে নেমে তিনি পাগলের মত হেটে চলেছেন পশ্চিমে!  সামনে একটা কালভার্ট,  তিনি মনোযোগ না দিয়ে হেটেই চল্লেনচোখে চশমা নাই,  এদিকে আধার ঘন হয়ে এসেছে। 
রাগে তার সারা শরীর কাপছে। সন্তান বাতসল্যে তিনি ভুলে গেছেন রাগ করা হারাম।
আজ দুপুর থেকে অপেক্ষা করছেন,  বড় ছেলে বউ  নাতিকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে ফিরবেপ্রাণ প্রিয় নাতির জন্যে অপেক্ষা!  
কথায় আছেরাজার বাড়ির হাতিগরিবের ঘরের নাতি
দুইটাই বড় প্রিয়
অবশ্য নাতির শখ আবদুল ওহাব এর পুরো হয়েছে আরো বহু বছর আগেই,  তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার ছেলে জহিরের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে। প্রথম নাতিকে নিয়ে কত আনন্দকিন্তু মেয়ে থাকে ঢাকায়চাইলে  নাতির মুখ দেখা যায় না। তাই বড় 
ছেলে আউয়ালের সন্তান হওয়ায় পর যেন তিনি হাতে চাদ পেলেন। আপন খেলার সাথী!
নাতিকে নিয়ে যা- করেন মন ভরে না। গত সাপ্তাহে তাই ছেলে যখন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা বললওহাব সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়।  কিন্তু কি করা যাবে,  ছেলের বউও খুব ভালো মেয়ে ,  তাকেও কষ্ট দেয়া যায় না,  যাক বাপের বেরিয়ে আসুকউনার আপত্তি নেই। 
বার বার করে বলে দিলেন _বউ,  আমার ছেলে তো তোমাদের বাড়ি গেলে আর আসতে চায় না। কিন্তু আমার দিকে চাইয়া মাহবুব রে নিয়া সামনের  বৃহস্পতিবার চইলা আইসো। 
সারা সপ্তাহ তার নাতিকে ছাড়া কিভাবে কেটেছে তিনি  জানেন। আজ বিসুদ বারসকাল থেকে অপেক্ষায়,  আউয়াল নাতিকে নিয়ে ফিরবেনাতির হাসিতে ঘর উজ্জ্বল হবে। 
কিন্তু সারাদিন পর ছেলে ফিরলো একা

ছেলের সাথে নাতিকে না দেখে ওহাব সাহেবের মাথা খাবার হয়ে গেলো।  
তিনি তখনি রউনা হলেন তালশহরছেলের বউকে জিজ্ঞেস করবেন _ বাপের বাড়ি এসে আমাকে ভুলে গেলা?  আমার নাতিকে না দেখলে মন কেমন করে ভুলে গেলা

রাগে আবদুল ওহাব হাটছেনজোড় কদম হাটাসামনে কালভার্ট তিনি খেয়াল করলেন না। 
অন্ধকারে পা দিয়ে তিনি নিচে পড়ে গেলেন। 
.......
পাশের গ্রাম থেকে দুজন লোক আসছিলো রেলস্টেশন এর দিকেকালভার্টের কাছে আসতেই ধপ্  করে কিছু পরার আওয়াজ পেল!
এই কি হইলো রে,  কালভার্টের উপর থেইক্কা কিছু পরছে মনে হয়
দুজনে দোউরে এসে দেখলেন,  আবদুল ওহাব পড়ে আছেনঅবস্থা খুবই খাবার। দুজনেই ডাকাডাকি করে লোক জরো করে দ্রুত উনাকে রেলস্টেশনে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে বহু লোক জরো হয়ে গেলো,  ভাগ্য ভালো তখনই একটা ট্রেন ঢাকা থেকে আসছিলসবাই মিলে  উনাকে ট্রেনে তুললেন। 
.….
রাত প্রায় আটটার দিকে এলাকার ছেলেরা এসে খবর দিলআউয়াল ভাইজলদি জেলা হাসপাতালে যান। তুন্দুল হুজুরের অবস্থা খারাপ!


বা 

নুরুল ইসলাম পাগলের মত দোউরাচ্ছে,  আর বার বার পিছনে ফিরে দেখছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে শুনেই তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, " আমি জহিররে নিয়া গেলাম,  তোমরা সবাই একসাথে থাইকো। "
রফিয়া বলল  -  তুমি শুধু ছেলেরে নিয়া গেলে হবে!  আম্মা,  আমি আর অন্যদের কথা চিন্তা করতে হইব না? "
নুরুল ইসলামের জবাব  - তোমরারে দেখার জন্য বড় ভাই আছেনসেই দেখবোআমি আমার ছেলেরে নিয়া মসজিদে যাইতাছি। আল্লাহ বাচাইয়া রাখলে আবার দেখা হইব। "
বলে তিনি ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে দোউরে বেরিয়ে গেলেন। 
পেছন থেকে রফিয়া হতবাক হয়ে সন্তান বাতসল্লে অন্ধ পিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন
পিতা তার ছেলেকে বুকে জরিয়ে পরিবারের আর সকলকে ভুলে শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কথাই ভাবছেন
আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও!   আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও

বাবা 

জহিরের অফিস যেতে আজ দেরি হবে। খুব সকালে স্বামি স্ত্রী তাদের মেয়ে রাফাকে নিয়ে 
পদ্মা ডায়াগনোসিস  এসেছে,  মেয়ের রক্ত পরিক্ষা করতে হবে।  কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর এল তাদের সিরিয়াল। জহির মেয়ে রাফাকে কোলে নিয়ে নার্সের  সামনে দাড়ালো। মেয়ের বয়স  মাত্র দুই। ছোট্ট টুনটুনি!  নার্স সাভাবিক ভাবে বাচ্চার হাতে টিপে টিপে দেখছেনকোন হাত থেকে রক্ত নিবেন। 
মেয়ে কান্না শুরু করে দিলনার্সের এদিকে কোন খেয়াল নেইইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দিলেন অবলিলায় ছোট্ট শিশুর হাতে। মেয়ে চিৎকার করে উঠলো। জহির শক্ত করে মেয়েকে জরিয়ে ধরলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার বুকের ধন সোনার ময়না ব্যথায় কাদেপারভীন পাশ থেকে জহিরের কাধে হাত রাখে। বাবা আরোও শক্ত ভাবে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে। 
হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে সুস্থতা দাও

বাবা 

জহির অনেক দিন পর জাপান থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরছেন আজ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতে রাস্তা যেন ফুরায় না। 
ঘরের দরজায় সবাই অপেক্ষায়। জহিরের সাথে ব্যাগ ভরতি গিফট। হৈচৈ আনন্দের মধ্যে ঘরে ঢুকল। 
সবাইকে বুকে জরিয়ে কত কথা আর চোখ খুজছে মেয়েদের। রাফা ইফা কোথায়
ছোট মেয়ে ইফাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। 
মেয়ে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে!
"আয় হায়ইফার কি হইছে। "
ইফার মারাত্মক অসুখ হইছিলতুমি বিদেশে কস্ট পাইবা সে জন্য তোমারে বলি নাই! "
বাবাইফার জন্য আনা খেলনা সাইকেলগাড়ি সবকিছু বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ইফা দুর্বল শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে একমনে খেলতে থাকে। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। 
মেয়েকে আনন্দে হাসতে দেখেও বাবার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ে।


তখন

ভাইতুমি খাও না যে! " রফিয়ার হাতে আইসক্রিমমুখে তেতুলকথা বোঝা যাচ্ছে না।  
আব্বাস জিজ্ঞেস করল -কি কসবুঝিনা!
ইস! " আইসক্রিমে কামড় দিয়ে বললতুমি কুলফি খাইবা না
তুই খা,  পাগলি কুনখানকার,  কুলফি আর তেতুল মাইনসে একলগে খায়
আমি খাইআমার ভালো লাগেতুমি না খাইলে নাই," রফিয়ার জবাব। 
কিতোর এত্ত সাহসদাড়া আইজ ঘরে গিয়া মামুরে কইতাছিতুই আমার লগে ব্যদ্দবি করছসদেখিস মামু কি করে! " আব্বাস ভয় দেখায়। 
ভাইতোমার আল্লাহর দোহাই,  আব্বারে বিচার দিও নাতুমি যা চাইবা তাই দিমু " রফিয়া এখন আব্বাস কে মানাতে চেস্টা করে। 
আব্বাস রফিয়ার ফুফাতো ভাইওদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে। বোনের ছেলে বলে আবদুল ওহাব খুব আদর করেন। ছেলাটা বাবা মা ছাড়া দুরে আছে!  তার সব কথাই আব্বার সায়। ভাই বোন এক সাথে স্কুলে যায় আসে। 
অন্নদা স্কুলের সামনে আব্বাস চোখ গরম করে রফিয়ার দিকে তাকায়। আর মনে মনে হাসে।  ছোট বোনের ভয় পাওয়া দেখে মায়া লাগছে
ভাই বোনের খুব মিল। সারাদিন দুই জন একসাথেপড়া,  স্কুল যাওয়া খেলা সব। 
ভাইচাইলতার আচার খাইবা? " রফিয়া  আবার জিজ্ঞেস করে। 
"নাকিচ্ছু খামু নাচল বাসায় যাই,  মামি চিন্তা করবো"
আব্বাস তাড়া দেয়। 
ভাইতোমারে আল্লার কিরা,  আব্বার কাছে বিচার দিও না!" 
দিমু না,  যা। কিন্তু আর বেদ্দবি করবি না 
ঠিক আছেআর করমু নারফিয়া কথা দেয়। 
ভাই বোন বই খাতা নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। 


রফিয়া গায়ের উড়না সামলাতে হিমসিম খায়। তার গায়ের তুলনায় উড়না অনেক বড়। টেনেটুনে কাপড় টা কোমড়ে ভালো ভাবে পেচিয়ে নেয়। কালিবাড়ির মোড় এসে রফিয়া আব্বাসের হাত চেপে ধরে। আব্বাস বোনকে মাথা নেরে সান্তনা দেয়। 
এত ভয় পাছ কেন? "
"তুমি জাননাঅই বটগাছে ভুত আছে! " রফিয়া শক্ত করে আব্বাস ভাইয়ের হাত চেপে ধরে.....



যখন 

১০৩/ নামা গোরান,  পোস্ট অফিস - বাসাবো,  থানাখিলগাঁও।  রফিয়ার নতুন ঘর। নতুন ঠিকানা। স্বামী স্ত্রীর   আপন সপ্নের বাড়ি। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থাকার পর নামা গোরানে   কাঠা জমি কিনে নিজ বাড়ি তৈরি করেছেন নুরুল ইসলামতখন ১৯৬৬ সাল। দোচালা টিনের ঘর। 
তাও প্রায় দশ বছর হলো। 
আজ সোমবার। ঘন্টা দুয়েক আগে নুরুল ইসলাম অফিস গিয়েছে  দেবর রফিক গিয়েছে কলেজ। এরপর সন্ধা পর্যন্ত ছেলেকে  নিয়ে একা। সকালে  স্বামি আর দেবরকে বিদায় দিয়ে সময় কাটানো মুসকিল হয়ে যায়। 
দিনের বেলায় পুরো এলাকা জুড়ে কোন পুরুষ মানুষের মুখ দেখা যায় নানতুন এলাকাবসতি কম। ভাগ্য ভালো কিছু দিন আগে মীর সাহেবের পরিবার পাশের জমিতে এসে উঠেছে। মীর ভাবির কাছ থেকে আনা মাসিক পত্রিকা "বেগম " পড়ছে রফিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। পাশে ছেলে জহির মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছে। হঠাৎ গেইট থেকে আওয়াজ এল - দুধ --
দুধ ওয়ালা এসেছে দুধ নিয়ে। 
পুরো এলাকা সুনসান নীরব। কেউ এসে ডাকলে  গেইট খোলা যায় না।  মাঝে মাঝে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। 
দুধ ওয়ালার পরিচিত গলা শুনে ছেলে আগেই দৌড়ে গেইটে চলে গেছে। সারাদিন ছেলেটার খালি দুস্টামি
রফিয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেইট খোলে। 
"ভাবি আসসালামু আলাইকুম।  "
রফিয়া ঘোমটার ভেতর মাথা নেরে নিঃশব্দে সালামের উত্তর  দেয়। দুধের পাতিল এগিয়ে  দেয়। দুধ ওয়ালা দুধ মেপে দিতেই রফিয়া পাতিল নিয়ে তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়তার মন পরে আছে "বেগমপত্রিকার নায়ক নায়িকা  "আজিম-সুজাতারছবির দিকে। সিনেমার জুটি বাস্তবে  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই খবর  খুব মন দিয়ে পড়ছিল। অন্যমনস্কতায় রফিয়া খেয়াল করলো না যে ছেলে দুধ ওয়ালার পেছন পেছনে গেইট থেকে বেরিয়ে গেছে!
কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়ার পর ঘরে কোন শব্দ নাই দেখে আসে পাশে তাকিয়ে  দেখলেন,  জহির গেল কোই
ছেলেটারে নিয়া আর পারিনা,  সারাদিন দুস্টামি!
পাশের  ঘরে উকি দিলেন,"জহিরকই গেলি? "
এই ঘরে নাই!
উঠানে দৌড়ে গেলেননাই!
উঠানের শেষ মাথায় বাথরুমে  দেখলেনছেলে নেই
হঠাৎ কি মনে হতে এক দৌড়ে গেইটের দিকে গেলেন। 
আয় হায়!  গেইট খোলা!  
ছেলে নিঃসচই বাইরে চলে গেছে
জহিরচিৎকার করতে করতে  গলিতে বেরুলেন রফিয়া। 
ডানে বায়ে তাকালেন ছেলের খোঁজে।  নেইদৌড়ে হারুনদের বাসায় গেলেন নিলি হারুনতোর আম্মারে ডাক,জহিররে খুইজা পাইতাছিনা
হাহাকার করে চিৎকার করছে রফিয়া। 
শুনে নিলু  তার মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে
 জহিরের মাকি হইছে
আপাজহিররে খুইজা পাইতাছি না
হেঃ কন কিএই নিলু যা তোসোহেলের মারে ডাক দে। 
নিলু দৌড়ে পাশের বাড়ির মীর সাহেবের স্ত্রীকে ডাকতে যায়। 
এদিকে রাফিয়ার শরীর ভয়ে কাপছে!
আল্লাহআমার ছেলের কি হবে!
***
সারা এলাকার মহিলারা জহিরদের বাসায় একত্রিত হয়েছেকত বড় সর্বনাস,জহির কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রফিয়ার অবস্থা প্রায় অচেতন। 
পাড়ার সকল মহিলা আসেপাশে খুঁজে দেখেছেন
এলাকার কোথাও জহির নেই। 
"আপা,আমার ছেলের কি হইব? " 
পলাশের আম্মা ধমকে উঠে - চুপ করমাগিছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পারছ না,অখন কান্দে! "
চঞ্চলের আম্মা ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকেনসাথে আরও তিন জন মহিলাসবার  শাড়ি জামা সমস্ত শরীর ভেজা
মুখ থমথমে। 
পাশের ডোবায় নেমে দেখেছেনযদি বাচ্চা ছেলেটি পানিতে নেমে থাকে
নাহ,গত আধ ঘন্টা তিন জন মিলে সারা ডোবা তন্নতন্ন করেছেন।  
আল্লাহর রহমত জহির পানিতে পরেনি।
পাড়ার সব মহিলা  বাচ্চারা জড়ো হয়েছে। উঠানে বাচ্চারা খেলছে। 


টুটুলের মামা কচি আজ কলেজ যায় নি,  সাইকেল চালিয়ে গোরান বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখেজহির একটা সেলুনের চেয়ারে বসে কাঠি লজেন্স খাচ্ছে
সাইকেল থামিয়ে,  সেলুনে ডুকে কচি মামা," কি রে জহির,  তুই এইখানে কি করছরফিক কই? "

ছয় বছরের বাচ্চা জহির কচি মামাকে দেখে হেসে হাত বারিয়ে দেয়। "মামা!"
সেলুন ওয়ালা জিজ্ঞেস করল - ভাইআপ্নে এই বাচ্চারে চিনেন! "
,চিনিকি হইছে! "
বাচ্চা টা একা একা রাস্তা দিয়া কান্তে কান্তে যাইতাছে দেইখা আমরার দোকানে বসাইয়া রাখছিকারো বাচ্চা হারাইছে মনে কইরা! "
"ভাইখুব ভাল কাজ করছ।"
জহির কে কোলে নিতে নিতে বললকি রে পাকনাহারাইলি কেমনে
দুধ ওয়ালা... "
চলআগে বাসায় যাইতোর আম্মার না জানি কি অবস্থা! "

যখন  

রফিয়ার মনটা আজ বেশ খুশি  খুশিকারন তার আব্বা আসছে দেশ থেকে। আব্বাকে বরাবরই একটু ভয় পেলেও রফিয়া জানেন আব্বা তার এই মেয়ে অত্যাধিক স্নেহ করেন। আব্বা আসার সময় এটা সেটা কতকি যে এনেছেন। নদীর মাছ ভেজেহাসের মাংসের তরকারি তার মায়ো সিদোল শুটকিও রেধে পাঠিয়েছে। কোনোকিছু রান্নার দরকার ছিলোনা তবুও আব্বা আসছে এতোদিন পর তার পছন্দের সজনে ডাল রান্না চড়ায়ে রফিয়া মাগরিবের আজানের আগে আগে ঘরের দরজা জানালা লাগাচ্ছে এমন সময় আব্দুল ওয়াহাব সাহেব ঘরে ঢুকলেনরফিয়া তাড়াতাড়ি এসে বলে আব্বা ওজুর পানি দিমু। তিনি অপেক্ষাকৃত গম্ভীর,  মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন না আমি মসজিদে নামাজ পরে আসতেছি। রফিয়ার মনে সংশয় আব্বা হটাৎ এতো গম্ভীর!! আসরের পরপর তার স্বামী কে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাদের একটা জায়গা দেখতে যেটা কিছুদিন আগেই তার স্বামী নূরুল ইসলাম বায়না করছে। দুজন যখন বেড়হয় তখন রফিয়ার বেশ আনন্দই লাগছিলো এক স্থায়িত্বের প্রশান্তি তার চেহারায়নিজের একটা বসতি একান্তই নিজের। কত শত স্বপ্ন এসে ভিড় করে তার চোখে।  
কিন্তু ফিরে এসে আব্বা ভাব গতিক সুবিধার ঠেকতেছেনা।  কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে ডাল বাগার দিয়ে চায়ের পানি বসায়তার স্বামীও আব্বার সাথে ফিরে নাই এটাও আশ্চর্য লাগতেছে।  আবার কোনো ঝামেলা হয় নাইতোমনের মধ্যে এক উৎকন্ঠাদুইজনের কাউরেই কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না।  দুইজনই বেশ রাগী মানুষ।  রফিয়া উৎকন্ঠিত মনে অপেক্ষা তারা কিছু বলে কিনা। 
নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে চা দিতে বললেন ওয়াহাব সাহেব,  মেয়ের হাতের চা টা তিনি বেশ উপভোগই করেনরফিয়া সুন্দর করে চায়ের সাথে তার আনা বিস্কুট থেকে দুইটি টোস্ট  পিরিচের কোনায় দেয় সাথে এক গ্লাস পানি। তিনি হাত বাড়িয়ে আগে পানিটা নেন এক ডোকে শেষ করেন বিস্কুট টা হাতে নিয়ে বলেন এগুলা তুমগো লাইগ্যা আনছি আবার আমারে দিলা কেনহাইন আফনে আমরারতো আছোই। আগের ফিল্লা যেইডি আনছেন হেইডিত্তো শেষ হইছেনা। জামাই আমারে যাত্রাবাড়ী নামায়া দিয়া কইলো আফনে বাসাত যান আমি ইট্টু মফিজের এহানতে হইয়া আসি। রফিয়া কইলো হো এই একজনইতোগেলে হের ঐহানেই যায়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চায় কিছু বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ প্রশ্ন করে  জামাইয়ের সবকিছু ঠিকঠাক চলতাছেতো?? রফিয়া অবাক,  হো আব্বা সবইতো ঠিকঠাক কোনো কিছু হইলেতো কইতোলোকটা হুটহাট চেইত্যা যায় কিন্তু কিছু হইলে আগে আমারেই কয়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলোনা। তিনি গায়ের পান্জাবিটা ছেড়ে বিছানায় শরীরটা ইকটু এলিয়ে দিলেন। কখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল করেননি। মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আব্বা আফনের কি শরীরটা খারাপওয়াহাব সাহেব নিজেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন অসময়ে ঘুমিয়ে পরায়। হেসে বললেন নারে বেডি কহন যে চোখডা লাইগ্যা গেলো টের ফাইছিনা। 
উউট্টা এশার নামাজটা পড়েন আমি ভাত বাড়তাছি। জামাই আইছে?? আইয়া পরবো আফনে নামাজ শেষে হাইয়া লোন। রফিয়ার মনে আরো সংশয় নিশ্চয়ই কিছু হইছে নইলে এতোক্ষনেতো লোকটা চইলা আসার কথা। খাবার সময়ই জিগাইতে হইবো আব্বারে কিছু হইছে নি। ওয়াহাব সাহেব নামাজ শেষে দেখেন মেয়ে শীতল পাটিতে খাবার বিছায়া রাখছে অনেক আয়োজন সাথে তার পছন্দের সজনে ডালও আছে। আলহামদুলিল্লাহ এতকিছুসব তুই করছোস?? মেয়ে হাসে ইকটু সাহস পায় আব্বা স্বাভাবিক হইতাছে।  মেয়ে বাবার পাতে খাবার তুলে দেয় ওয়াহাব সাহেব খেতে খেতে রান্নার প্রসংশা করে রান্না ভাল হইছেতোর মায়োর মতরফিয়া মনে মনে হাসেআব্বা নিজেও জানেনা তার মেয়ের জন্য মায়ো কি কি দিয়া দিছে। এগুলো তার মায়েরই রান্না সে শুধু ডাল পাকাইছে। 
ওয়াহাব সাহেব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আইবো তোরা খাবিনাহেয় আইলেই খামু আপনি খানতোওয়াহাব সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেনসুযোগ বুঝে রফিয়া প্রশ্ন করে আব্বা জায়গা যে দেখতে গেলেনকেমুন দেখলেন?  কিছুই দি কইলেন না
ওয়াহাব সাহেব ইকটু থামলেন আবার ভাত মাখতে মাখতে বললেন জায়গায় তো যাইতারছিনা ঐহানে এহনো রাস্তা হইছেনা। এই ডেমরার এদিকেত্তে ত্রিমহনি একটা জায়গা ঐহানতে নুরুল ইসলাম আমারে আঙুল দা দেহাইলো উইযে দূরে আমগো জায়গাডা আব্বা। আমি ইকটু অবাক হইছিটেহাদা কেউ বিল কিনেরে। পয়সাডি ফানিত ফালাইয়া আইসে। আমিতো হেরে ভালই জানতাম ফাগল টাগল হইয়া গেলোনি। রফিয়া এতক্ষণে বুঝলো আব্বা কেন এত গম্ভীর ছিলেন। বাবা-মেয়ে কেউ তখনও জানেনা তাদের সেই বিলের আশপাশটা জুড়ে একদিন মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং থেকে শুরু মার্কেট সিনেমা হল সবই গড়ে উঠবে। সেই সাথে নিজেদের একটা চারতলা বাড়ী।


তখন

সাল ১৯৬৪.
রফিয়ার বিয়ের মেহেদী না শুকাতে  একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।
নুরুল ইসলাম এর টিবি হয়েছে
লোকে বলে যক্ষাহইলে নাই রক্ষাএকেমন কিথারফিয়া মাত্র ফিরা যাত্রায় এসেছে বিয়ের পর।এই সময়ে এমন বিপদ। আবদুল ওহাব মেয়ের জামাই এর এই সংবাদ পেয়ে প্রানের ধনকলিজার টুকরো মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছেননুরুল ইসলাম কে বিবাড়িয়া মেড্ডা হাস্পাতালে ভর্তি করা হয়েছেকিন্তু পিতার প্রাণ তার মেয়েকে হাস্পাতালে যেতে দিতে চান না!  লোকজ বিশ্বাসযক্ষা হইলে....
মেয়ের শশুর  বাড়ি থেকে কয়েক বার খবর পাঠানোর পরও আব্দুল ওহাব মেয়েকে যেতে দেননি। 
মাইয়ো,কি করতাম,তোমরার জামাই রে তো দেখতে যাওন দরকার! " রফিয়া তার 
মা'কে জিজ্ঞেস করে। "আব্বা তো যাইত দিতাছে না!"
তোর জামাই তুই বুঝবি!"মা ঠাট্টা করেন। 
মাইয়ো! " রফিয়া প্রায় কেদে দেয়! " কি করতাম কও না।"
কি করবি আর!  তোর বাপের কথা শুনলে চলত না। তুই ওদুদ রে লইয়া হাস্পাতাল যা। " 
….
রফিয়া ছোট ভাই ওদুদ কে নিয়ে ভিতু পায়ে মেড্ডা হাস্পাতালে ঢুকে। মনে ভয় যদি কেঊ দেখে আব্বাকে বলে
নুরুল ইসলাম মন খারাপ করে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। ওদুদ এর সাথে রফিয়া কে দেখে তার মনটা অভিমানে ভরে উঠে
আসছেন,  লাট সাহেবের বেটি
মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
লম্বা ঘোমটা দিয়ে রফিয়া স্বামির পাশে গিয়ে বসে। 
মাইয়ো টিফিনকারিতে গাজরের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছেন।  ওদুদ টিফিনকারি বিছানার রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যায়,"আফা আমি গেইডো আছি,তুমি যাওয়ার সম ডাক দিও"
নুরুল ইসলামের দিকে চেয়ে রফিয়ার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে
একি হাল হয়েছে উনার!
বিয়ের সময় সবাই বলাবলি করেছে - বরের স্বাস্থ্য কত সুন্দরব্যায়াম বীর
সেই স্বাস্থ্য এখন কি হইছে
রফিয়া ঘোমটার ভেতর কাদতে থাকে। রফিয়ার কান্না দেখে নুরুল ইসলাম  ঠুকরে কেদে দেন।
স্বামী স্ত্রী নিরবে কিছুক্ষন কাদে।
"কি হইল আমার কওত রফিয়া। " নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে। 
আমি কি বাছতাম না!"
স্বামীর প্রশ্ন শুনে রফিয়ার বুক ফেটে যায়। 
নিরবে টিফিনকারি থেকে হালুয়া বের করে স্বামীকে তুলে দেয়। 
মনে মনে দোয়া করেআল্লাহ তুমি উনারে বাচাওমাবুদ তুমি উনারে বাচাও!


তখন 

যক্ষা হইলে নাই রক্ষা - প্রবাদ কে ভুল প্রমাণ করে আল্লাহর অশেষ রহমতে নুরুল ইসলাম  দুই সপ্তাহের মধ্যেই আপাত সুস্থ হয়ে উঠলেন,  তার শরীর সুস্থ হয়ে উঠলেও কিছু জীবানু থেকে যায়যা ধরা পরবে প্রায় পঞ্চাশ বছর পরসেটা অন্য গল্পপরবর্তীতে বলা হবে। 
নুরুল ইসলাম ময়দাগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে মনমরা হয়ে বসেপাশে তার ভাতিজা নান্নু মিয়া। বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুজনে সুখ দুখের সাথি।
লঞ্চ ঘাটের ডিম ওয়ালা আওয়াজ দেয়ডিমবল ডিম!
নান্নু মিয়া জিগ্যেস করে - "কাহাবইদা হাইবা (খাইবা)?
নুরুল ইসলাম মাথা নারে।
"হাউ একটাসইলো জুর ফাইবা!"
"নাহচা পাইলে খাইতামনুরুল ইসলাম দীর্ঘশাস ফেলেন।
রফিয়ার কথা মনে পরেলাটসায়েব এর বেটি হাস্পাতালে চা নিয়া আসত তার জন্য!তিনি রাগ করে বলতেন - তোমার আব্বার হোটেলের চা খাইতাম না! "
"হোটেলের চা নাআমি নিজে রানছি!খাইন! "রফিয়া বলত।
রফিয়ার জন্য বড় মায়া লাগেনুরুল ইসলাম এর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। 
"কাহাচাচির লেইগ্যা পেট পুরে নি,  কান্দ কেরে? "
নান্নু চাচাকে সান্ত্বনা দেয়। 
বইদা হাউ একটা। "
"তুই খাএক কাপ চা হইলে খাইতাম! "
"তুমার হালি চা আর  চাঢাহা গিয়া তুমার অব্বাস হারাপ হইছে।"
দুর্বল শরীর নিয়ে নুরুল মুচকি হাসে,কথা সত্যি। 
"দেখচা পাছ নি।"
"তুমি বও ইহানোআমি চা আনতাছিনান্নু মিয়া চায়ের খোঁজে বেরিয়ে যায়। 
নুরুল ইসলাম একা বসে রফিয়ার কথা ভাবেআল্লাহ  জানেনরফিয়ার সাথে তার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ কিভাব নমুনা ভালো না। তুন্দুল হুজুরের নিয়ত ভালো মনে হইতাছে নাপাগল বেটা মেয়েরে আর শশুর বাড়ি পাঠাইতে চায় না। একবার হাসপাতালে মেয়ে জামাইরে দেখতেও আইলো নাকেমন পাষাণ
এই লও তুমার চা!" নান্নুর কথায় নুরুর ধ্যান ভাংগে।
"তাগদা হাও (খাও), লঞ্চ আইতাছে! "
চা মুখে দিয়ে নুরুর আবার রফিয়ার কথা মনে পরে
বার বার তার  সুন্দর মুখটা চোখে ভাসে!
কিছুক্ষন পর লঞ্চ আসলে দুজনে গিয়ে উঠেনগন্তব্য নবিনগরসেখান থেকে নৌকায় বিটঘর,তারপর হেটে গুরিগাও।
বেলা দুপুর। কড়া রোদে নদীর পানি চিক চিক করছে। লঞ্চ ছারে সারেং। ধীরে ধীরে ময়দা গঞ্জ লঞ্চঘাট দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যায়। 
আকাশের দিকে তাকিয়ে নুরুল অনুচ্চ সরে বলেন - হে আল্লাহ তুমি রফিয়ারে ভালো  রাইখো!"
বিদায়রত ব্রাহ্মণ্ বাড়িয়ার দিকে তাকিয়ে নুরুল ইসলাম কঠিন এক শপথ নেয়সে
আর কখনও শশুর বাড়ি যাবে না!



তখন 

কুদ্দুস মাস্টার কান্দির পাড় রুটিঘর হোটেলের সামনে এসে দাড়ান। মনে ভয়তুন্দুল হুজুর জানি কি কয়!
যে মেজাজি মানুষযথারীতি  
হোটেলে কাস্টমার এর ভীড়। 
এই রুটি ঘর বিবাড়িয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় হোটেল। 
আব ওহাব এই হোটেলে বিবাড়িয়ায় প্রথম তুন্দুল রুটি তৈরী করেনরুটি ঘর এর গরম গরম  তুন্দুলরুটি এত জনপ্রিয়তা পায় যে সবাই  ওহাব সাহেব কে তুন্দুল হুজুর ডাকতে শুরু করেন
তুন্দুল হুজুর কাউন্টার  বসে!  
সালাম দিয়ে পাশে গিয়ে দাড়ালেন কুদ্দুস মাস্টার। 
মামার সইলডা ভালো নি
সইল ভালোতুমি কেমন আছঅনেক দিন পর আসলা? "
ইস্কুলো পরীক্ষা চলতাছেএকটু ব্যস্ততা যাইতাছেমামা।"
হুমবসএই মাসটররে সরের চা দেলগে মিস্টি সিংগাড়া দিস।"
"মামাসিংগাড়া খাইতাম নাখালি চা দিত কন।"
"না কইর নামাত্র নামাইছে কড়াই থেইকা। খাও। আর বাইম মাছ রানছেভাত খাইয়া যাইবা।"
তুন্দুল হুজুরের কথার উপর কিছু বলার নাই
মামাএকটা কথা কইতাম আইছি। "
বওটেবিলে,  আমি ক্যাশ সামলাইয়া আসতাছি।"

কিছুক্ষণ পর আবদুল ওহাব এসে কুদ্দুস মাস্টার এর পাশে বসেন।
"কওকি কইবা।"
"মামাচলেন কেবিনে গিয়া বসিমাস্টার বিনীত ভাবে প্রস্তাব দেন।
আবদুল ওহাব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করেনসব খবর ভালো নি।"
খবর ভালো মামাএকটু জরুরি আলাপ আছিল।"
পাশেই তিনটা ফ্যামিলি কেবিনপরদা ডাকা।
ভেতরে বসে কুদ্দুস মাস্টার ইতস্তত করেন।
কি কোন সমস্যা? " তুন্দুল হুজুর আবার জিজ্ঞেস করেন। 
"মামারফিয়ার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়া আসছি!"
কুদ্দুস মাস্টার এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন।
কথা শুনে তুন্দুল হুজুর চমকে উঠেন
বকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে
কলিজার টুকরা রফিয়ার বিয়ার প্রস্তাব
দীর্ঘ শাস ফেলে নিজেকে সামলান। 
মেয়ে বড় হইছে,  বিয়ে তো দিতেই হবে!  চিরকাল তো আর আগলে রাখা যাবেনা। 
ছেলে ভালো,  ঢাকা একটা অসুদ কম্পানিতে চাকরি করেকুদ্দুস মাস্টার ভয়ে ভয়ে বলেন।  তিনি জানেনরফিয়া মামুর জানের টুকরা
"বাড়ি গুরিগাও। "
দুজনে এরপর রফিয়ার বিয়ের আলাপে ব্যস্ত হয়ে যায়। কুদ্দুস মাস্টার প্রস্তাব আনছেএরপর আর কি কথা চলে!

এদিকে রফিয়া আব্বাস ভাইয়ের সাথে স্কুল থেকে ঘরে  ফিরেছে। 
রফিয়া জানেনা আজই তার শেষ স্কুল যাওয়া।
আর কোন দিন সে স্কুলে পড়তে যাবে না!


তখন 

রফিয়া  জামাই বেভাইরাত সইল মাছ আনছে!" মঞ্জু হাসতে হাসতে বলে। 
রফিয়া চোখ বড় করে তাকায়।
মঞ্জু আর রোকেয়া হেসে গড়িয়ে পরে একজন আরেকজনের উপর। 
আজ রফিয়ার বিয়ে
মঞ্জু আর রোকেয়া প্রিয় বান্ধবীএকটার পর একটা খবর এনে দিচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর।  পর্যন্ত পাওয়া সব খবর  খারাপ
বর যাত্রী আসার কথা ছিল দেড়শআসছে পয়ত্রিশ জন।
সবাই বলাবলি করছবরপক্ষ কিপটাখরচ বাচাতে এই আকাম করছে
আব্দুল ওহাব এর সংসারে আজ প্রথম বিয়ে
তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার বিয়ে
কত সাজ গোসকত আয়োজনআসেপাশের তিন বাড়ি ঘীরে পেন্ডেল করেছেন আব্দুল ওহাবলাইটিংএমনকি ডেকোরেটারে বড় পেন্ডেল ছিল্মা বলে তিনি টেইলার থেকে অর্ডার দিয়ে সিলাই করেছেনবরপক্ষ সব কিছুর মধ্যে পানি ঢেলে দিল!

রাহে আব্দুল ওহাব এর শরীর ফেটে যাওয়ার দশা
বার বার ঘরের ভিতর বাহির করছেন আর বলছেন - জোহরা দেখলা কত বড় বেজ্জতি!"
জোহরা স্বামীর মেজাজ জানেনসান্তনা দেয়ার জন্য বলেন - আফনে ইহানো বইয়া ইকটু জিরাইন নাবাকি সব আবরু আওয়াল আর আলিম দেখব!"

হুম,পুলাপান দিয়া কোন কাম হয়?"
হইবআফনে চিন্তা কইরেন নাকুস্তা অইতো নাআল্লাহ পাক সব ঠিক কইরা দিবআমরার রফিয়া বড় ভালো মাইয়াজোহরার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। তিনি মুখ অন্যদিকে ফেরান।
তিনি জানেন স্বামীর মনে আরোও বেশি কষ্ট
রফিয়া তার কলিজার টুকরো। 
পিতলের গ্লাসে পানি এগিয়ে দেন স্বামীকে। মাটির কলসের ঠান্ডা পানি!
পানি খেতে খেতে আব্দুল ওহাব বির বির করেনকুদ্দুস আমার কি সর্ধনাস করল!"
দীর্ঘ শাস ফেলেনআমার রফিয়ার কফালো কি আছে আল্লাহ জানে!"

এদিকে পাশের ঘরে রোকেয়া বলছেরফিয়াঅদুদ কইছে তোর জামাইর বলে মাথা ছুডু!"
রফিয়া ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকেচোখ দিয়ে টপ টপ পানি পরে!
মঞ্জু রোকেয়াকে ইশারা দেয়রফিয়া কান্তাছেচুপ কর!
মঞ্জু রফিয়ার কাধে হাত রাখেরফিয়া ঠুকরে কেদে উঠে
"আরে বিহুবআমরা  ঠিশারা করছি " রোকেয়া সান্তনা দেয়।
আমি চুফি দিয়া দেখছিতর জামাই দেখতে সুন্দরচুল বেশি ছুঢু কইরা কাটছে দেইখা মাথা ছুডু লাগে।"
মঞ্জু চোখ গরম করে তাকায় রোকেয়ার দিকে। 
রোকেয়া জিভে কামড় দেয়!
তারাতাড়ি বলেরফিয়াতর কফাল কত বালাআলিম কইছে দুইশ তিপ্পান্নডা পিতলের কলশি উপহার আইছে!"
রফিয়া ঘোমটার ভেতর হেসে ফেলে
মঞ্জু গুনগুন করে গায়পিতলের ঘোড়াপিতলের ঘোড়া....


তখন 

আজ রবিবারঅফিস ছুটির দিন। 
রাত নয়টা। বি টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক দেখছে বাচ্চারা। নুরুল ইসলাম কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে চা খাচ্ছেন। বড় ছেলে জহির হঠাৎ নাটকের মধ্যে একটা হিন্দি গান শুনে নুরুল ইসলাম কে জিজ্ঞেস করল - "আব্বাআপনে  হিন্দি উরদু ভাষা জানেন?  পাকিস্তান পিরিয়ডে  উরদু বলতে হইততাই না! "
জহিরের প্রশ্ন শুনে বাবা মুচকি হাসেন। 
ভাইবোন সবাই আব্বার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকায়। 
চায়ে চুমুক দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন - "আসলে আমরা উর্দু এতটা বলতাম নাসব সময় বাংলা  বলছিইস্কুলে আমরারে উর্দু শিখাইছেকিন্তু চরচা নাই দেইখা ভুইলা গেছি!"

সুরাইয়া আবদার করে - আব্বা একটু উর্দু কন  শুনি! "
নুরুল ইসলাম তার ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকেদেখতে দেখতে ছেলে মেয়ে গুলো বড় হয়ে যাচ্ছে!
মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে হইল জহিরচার কি সারে তিন বছর পর সুরাইয়াএরপর দিলু মনিরমনে হয় এইত সেদিনকিন্তু মাশাল্লাহ ছেলে মেয়ে গুলো তর তর করে বড় হয়ে গেলো,  জহির এখন সিক্সে পড়ে
"আব্বাকন না " সুরাইয়া আবার বলে। 
ইইতিমধ্যে রফিয়া রান্নাঘর সামলে ঘরে ঢোকেন। 
তারও চোখে কৌতুহল। 
নুরুল ইসলাম মুচকি হেসে বলেন - উর্দু না হিন্দি জানিনাছোট বেলায় একটা গল্প শুনছিলামসেইটা বলি শুন।"

ছেলেমেয়েরা টিভি বন্ধ করে নরে চরে বসে।
"তোদের দাদার কাছে শুনাবহু বছর পর নুরুল ইসলাম এর বাবার চেহারাটা মনে ভাসে!
একদেশে এক রাজা আছিলবিরাট রাজত্ব।  একদিন রাজা তার পাক্কসিরে জিগায় - শুনছি,  আমার রাজত্যে একটা গ্রামের মানুষ কুইচ্চা খায়?"
পাক্কসি কয় খায়। রাজা শুইন্না কয় তুমি পাক করতে পারবাখাইয়া দেখি কেমন।"
কেচোর কথা শুনে বাচ্চারা অবাক হয়ে যায়। আব্বারে উর্দু বলতে গিয়ে একি হচ্চে!
জহির রফিয়ার দিকে তাকায়। 
রফিয়া মাথা নেরে ইশারা দেয়আসতাছে...
ছোট মেয়ে দিলু জিজ্ঞেস করে, "আব্বা হিন্দিতে কননা কেন?"
নুরুল ইসলাম হেসে বলেন -    রাজা পাক্কসিরে কইছেতুমি রান্দ। পাক্কসি রান্দছে ঠিক  কিন্তু একটা সমস্যা হইয়া গেলগা।"
সবাই নুরুল ইসলাম এর দিকে তাকিয়ে। 
"রাইন্দা সাইরা বাবরচি গেসে গুসল করতেআইসা দেখে তরকারি বিলাই খাইয়া ফালাইছেএখন কি হইবরাজা দরবারে বসছে,  একটু পরে  খাইতে আসবোকি করন যায়চিন্তায় বাবুর্চির অবস্থা খারাপ। দরবারে উজিরনাজির এর সামনে কুইচ্চা কথা কেমনে কয়!
একটা বুদ্ধি পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া দরবারে ঢুকছে।
 " হুজুর জাহাপনা,আপকা কুচিয়া পারা থানা  লুটলিয়া।"
রাজা  বুঝছে বেটায় কি কয়পুরা দরবারের লোক চিন্তা করতাছেকুচিয়া পারা থানা আবার কুনডা,কে আবার লুটপাট করল!
রাজা  বুঝছেজিগায়কোউন"
"হুজুর বিল্লাল খান।রাজা ঠিকই বুঝছে বিলাই খাইয়া ফালাইছে। জিগায় - 
"সরবুদ্দি কাহা থা?" মানে সরা (ঢাকনাকই!
"  পহেলা থাপ্পড় মেই গিরগিয়া! " 
রাজা আবার জিগায় - গদবুদ্দি (গদালাঠি জাতীয়কাহা থা! "
বাবুর্চি চিন্তা করে লাঠি নিয়া  আমি পাহারা দেই নাই,তাইলে  চাকরি থাকত নাবুদ্ধি কইরা কয় -  তো জংগল বাড়ি থা!"
হুমআউর কোউন কোউন বাকি হেয়? "
রাজা জানত চায়পুরা তরকারি  গেছে না কিছু বাচছেবেডা সখ করছিল খাইব!
বাবুর্চি কয় - আওর শিরবুদ্দি আর লিজবুদ্দি।"
রাজা বুঝছে কুইচ্চার লেজ মাথা আছে!
একটু চিন্তা কইরা কয় - ওদোন কো বেগুন বাড়ি ভেজ দো।"
বাবুর্চি গিয়া বাকি যেই কুইচ্চা বাচছিলসেগুলা বেগুন দিয়া ভুনা কইরা রাখে রাজার লেইগা!
এদিকে দরবারের উজির নাজির মনে মনে কয় বিল্লাল খা না জানি কত বড় পালোয়ানহা হা হা



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন