এখন তখন যখন কখন
মোঃ জহিরুল ইসলাম
কখন
বৃহস্পতিবার, বাদ মাগরিব, ফেব্রুয়ারী মাস, ১৯৮৩.
ক্রোধে অন্ধ আবদুল ওহাব জোর কদমে হেটে যাচ্ছে তার পরিনতির দিকে, সে জানে না। ব্রাম্মনবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে কখন লোকাল ট্রেনে উঠেছেন, কখন তালশহর নেমেছেন হুশ নেই।
হাটছেন আর বিরবিরিয়ে নিজেই বলছেন, কত বড় সাহস আমার নাতিরে রাখে!
সেই দুপুর থেইকা আমি নাতির জন্য বইসা রইসি! আমার পেটপুড়ার কোন দাম নাই!
তালশহুর রেলস্টেশনে নেমে তিনি পাগলের মত হেটে চলেছেন পশ্চিমে! সামনে একটা কালভার্ট, তিনি মনোযোগ না দিয়ে হেটেই চল্লেন, চোখে চশমা নাই, এদিকে আধার ঘন হয়ে এসেছে।
রাগে তার সারা শরীর কাপছে। সন্তান বাতসল্যে তিনি ভুলে গেছেন রাগ করা হারাম।
আজ দুপুর থেকে অপেক্ষা করছেন, বড় ছেলে বউ ও নাতিকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে ফিরবে, প্রাণ প্রিয় নাতির জন্যে অপেক্ষা!
কথায় আছে_ রাজার বাড়ির হাতি, গরিবের ঘরের নাতি!
দুইটাই বড় প্রিয়!
অবশ্য নাতির শখ আবদুল ওহাব এর পুরো হয়েছে আরো বহু বছর আগেই, তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার ছেলে জহিরের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে। প্রথম নাতিকে নিয়ে কত আনন্দ! কিন্তু মেয়ে থাকে ঢাকায়, চাইলে ই নাতির মুখ দেখা যায় না। তাই বড়
ছেলে আউয়ালের সন্তান হওয়ায় পর যেন তিনি হাতে চাদ পেলেন। আপন খেলার সাথী!
নাতিকে নিয়ে যা-ই করেন মন ভরে না। গত সাপ্তাহে তাই ছেলে যখন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা বলল, ওহাব সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কি করা যাবে, ছেলের বউও খুব ভালো মেয়ে , তাকেও কষ্ট দেয়া যায় না, যাক বাপের বেরিয়ে আসুক, উনার আপত্তি নেই।
বার বার করে বলে দিলেন _বউ, আমার ছেলে তো তোমাদের বাড়ি গেলে আর আসতে চায় না। কিন্তু আমার দিকে চাইয়া মাহবুব রে নিয়া সামনের বৃহস্পতিবার চইলা আইসো।
সারা সপ্তাহ তার নাতিকে ছাড়া কিভাবে কেটেছে তিনি ই জানেন। আজ বিসুদ বার, সকাল থেকে অপেক্ষায়, আউয়াল নাতিকে নিয়ে ফিরবে! নাতির হাসিতে ঘর উজ্জ্বল হবে।
কিন্তু সারাদিন পর ছেলে ফিরলো একা!
ছেলের সাথে নাতিকে না দেখে ওহাব সাহেবের মাথা খাবার হয়ে গেলো।
তিনি তখনি রউনা হলেন তালশহর, ছেলের বউকে জিজ্ঞেস করবেন _ বাপের বাড়ি এসে আমাকে ভুলে গেলা? আমার নাতিকে না দেখলে মন কেমন করে ভুলে গেলা?
রাগে আবদুল ওহাব হাটছেন, জোড় কদম হাটা! সামনে কালভার্ট তিনি খেয়াল করলেন না।
অন্ধকারে পা দিয়ে তিনি নিচে পড়ে গেলেন।
.......
পাশের গ্রাম থেকে দুজন লোক আসছিলো রেলস্টেশন এর দিকে, কালভার্টের কাছে আসতেই ধপ্ করে কিছু পরার আওয়াজ পেল!
এই কি হইলো রে, কালভার্টের উপর থেইক্কা কিছু পরছে মনে হয়!
দুজনে দোউরে এসে দেখলেন, আবদুল ওহাব পড়ে আছেন! অবস্থা খুবই খাবার। দুজনেই ডাকাডাকি করে লোক জরো করে দ্রুত উনাকে রেলস্টেশনে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে বহু লোক জরো হয়ে গেলো, ভাগ্য ভালো তখনই একটা ট্রেন ঢাকা থেকে আসছিল, সবাই মিলে উনাকে ট্রেনে তুললেন।
.….
রাত প্রায় আটটার দিকে এলাকার ছেলেরা এসে খবর দিল, আউয়াল ভাই, জলদি জেলা হাসপাতালে যান। তুন্দুল হুজুরের অবস্থা খারাপ!
বা ১
নুরুল ইসলাম পাগলের মত দোউরাচ্ছে, আর বার বার পিছনে ফিরে দেখছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে শুনেই তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, " আমি জহিররে নিয়া গেলাম, তোমরা সবাই একসাথে থাইকো। "
রফিয়া বলল - তুমি শুধু ছেলেরে নিয়া গেলে হবে! আম্মা, আমি আর অন্যদের কথা চিন্তা করতে হইব না? "
নুরুল ইসলামের জবাব - তোমরারে দেখার জন্য বড় ভাই আছেন, সেই দেখবো, আমি আমার ছেলেরে নিয়া মসজিদে যাইতাছি। আল্লাহ বাচাইয়া রাখলে আবার দেখা হইব। "
বলে তিনি ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে দোউরে বেরিয়ে গেলেন।
পেছন থেকে রফিয়া হতবাক হয়ে সন্তান বাতসল্লে অন্ধ পিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন!
পিতা তার ছেলেকে বুকে জরিয়ে পরিবারের আর সকলকে ভুলে শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কথাই ভাবছেন!
আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও! ও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও!
বাবা ২
জহিরের অফিস যেতে আজ দেরি হবে। খুব সকালে স্বামি স্ত্রী তাদের মেয়ে রাফাকে নিয়ে
পদ্মা ডায়াগনোসিস এ এসেছে, মেয়ের রক্ত পরিক্ষা করতে হবে। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর এল তাদের সিরিয়াল। জহির মেয়ে রাফাকে কোলে নিয়ে নার্সের সামনে দাড়ালো। মেয়ের বয়স মাত্র দুই। ছোট্ট টুনটুনি! নার্স সাভাবিক ভাবে বাচ্চার হাতে টিপে টিপে দেখছেন, কোন হাত থেকে রক্ত নিবেন।
মেয়ে কান্না শুরু করে দিল! নার্সের এদিকে কোন খেয়াল নেই! ইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দিলেন অবলিলায় ছোট্ট শিশুর হাতে। মেয়ে চিৎকার করে উঠলো। জহির শক্ত করে মেয়েকে জরিয়ে ধরলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার বুকের ধন সোনার ময়না ব্যথায় কাদে! পারভীন পাশ থেকে জহিরের কাধে হাত রাখে। বাবা আরোও শক্ত ভাবে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে।
হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে সুস্থতা দাও!
বাবা ৩
জহির অনেক দিন পর জাপান থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরছেন আজ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতে রাস্তা যেন ফুরায় না।
ঘরের দরজায় সবাই অপেক্ষায়। জহিরের সাথে ব্যাগ ভরতি গিফট। হৈচৈ আনন্দের মধ্যে ঘরে ঢুকল।
সবাইকে বুকে জরিয়ে কত কথা আর চোখ খুজছে মেয়েদের। রাফা ইফা কোথায়!
ছোট মেয়ে ইফাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন।
মেয়ে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে!
"আয় হায়, ইফার কি হইছে। "
ইফার মারাত্মক অসুখ হইছিল, তুমি বিদেশে কস্ট পাইবা সে জন্য তোমারে বলি নাই! "
বাবা, ইফার জন্য আনা খেলনা সাইকেল, গাড়ি সবকিছু বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ইফা দুর্বল শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে একমনে খেলতে থাকে। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে।
মেয়েকে আনন্দে হাসতে দেখেও বাবার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ে।
তখন
ভাই, তুমি খাও না যে! " রফিয়ার হাতে আইসক্রিম, মুখে তেতুল! কথা বোঝা যাচ্ছে না।
আব্বাস জিজ্ঞেস করল -কি কস? বুঝিনা!
ইস! " আইসক্রিমে কামড় দিয়ে বলল, তুমি কুলফি খাইবা না?
তুই খা, পাগলি কুনখানকার, কুলফি আর তেতুল মাইনসে একলগে খায়?
আমি খাই, আমার ভালো লাগে, তুমি না খাইলে নাই," রফিয়ার জবাব।
কি, তোর এত্ত সাহস! দাড়া আইজ ঘরে গিয়া মামুরে কইতাছি, তুই আমার লগে ব্যদ্দবি করছস, দেখিস মামু কি করে! " আব্বাস ভয় দেখায়।
ভাই, তোমার আল্লাহর দোহাই, আব্বারে বিচার দিও না, তুমি যা চাইবা তাই দিমু " রফিয়া এখন আব্বাস কে মানাতে চেস্টা করে।
আব্বাস রফিয়ার ফুফাতো ভাই, ওদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে। বোনের ছেলে বলে আবদুল ওহাব খুব আদর করেন। ছেলাটা বাবা মা ছাড়া দুরে আছে! তার সব কথাই আব্বার সায়। ভাই বোন এক সাথে স্কুলে যায় আসে।
অন্নদা স্কুলের সামনে আব্বাস চোখ গরম করে রফিয়ার দিকে তাকায়। আর মনে মনে হাসে। ছোট বোনের ভয় পাওয়া দেখে মায়া লাগছে!
ভাই বোনের খুব মিল। সারাদিন দুই জন একসাথে, পড়া, স্কুল যাওয়া খেলা সব।
ভাই, চাইলতার আচার খাইবা? " রফিয়া আবার জিজ্ঞেস করে।
"না, কিচ্ছু খামু না, চল বাসায় যাই, মামি চিন্তা করবো"
আব্বাস তাড়া দেয়।
ভাই, তোমারে আল্লার কিরা, আব্বার কাছে বিচার দিও না!"
দিমু না, যা। কিন্তু আর বেদ্দবি করবি না ক?
ঠিক আছে, আর করমু না" রফিয়া কথা দেয়।
ভাই বোন বই খাতা নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে।
রফিয়া গায়ের উড়না সামলাতে হিমসিম খায়। তার গায়ের তুলনায় উড়না অনেক বড়। টেনেটুনে কাপড় টা কোমড়ে ভালো ভাবে পেচিয়ে নেয়। কালিবাড়ির মোড় এসে রফিয়া আব্বাসের হাত চেপে ধরে। আব্বাস বোনকে মাথা নেরে সান্তনা দেয়।
এত ভয় পাছ কেন? "
"তুমি জাননা, অই বটগাছে ভুত আছে! " রফিয়া শক্ত করে আব্বাস ভাইয়ের হাত চেপে ধরে.....
যখন
১০৩/৭ নামা গোরান, পোস্ট অফিস - বাসাবো, থানা- খিলগাঁও। রফিয়ার নতুন ঘর। নতুন ঠিকানা। স্বামী স্ত্রীর আপন সপ্নের বাড়ি। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থাকার পর নামা গোরানে ৩ কাঠা জমি কিনে নিজ বাড়ি তৈরি করেছেন নুরুল ইসলাম, তখন ১৯৬৬ সাল। দোচালা টিনের ঘর।
তাও প্রায় দশ বছর হলো।
আজ সোমবার। ঘন্টা দুয়েক আগে নুরুল ইসলাম অফিস গিয়েছে । দেবর রফিক গিয়েছে কলেজ। এরপর সন্ধা পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে একা। সকালে স্বামি আর দেবরকে বিদায় দিয়ে সময় কাটানো মুসকিল হয়ে যায়।
দিনের বেলায় পুরো এলাকা জুড়ে কোন পুরুষ মানুষের মুখ দেখা যায় না! নতুন এলাকা, বসতি কম। ভাগ্য ভালো কিছু দিন আগে মীর সাহেবের পরিবার পাশের জমিতে এসে উঠেছে। মীর ভাবির কাছ থেকে আনা মাসিক পত্রিকা "বেগম " পড়ছে রফিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। পাশে ছেলে জহির মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছে। হঠাৎ গেইট থেকে আওয়াজ এল - দুধ ল--ন!
দুধ ওয়ালা এসেছে দুধ নিয়ে।
পুরো এলাকা সুনসান নীরব। কেউ এসে ডাকলে ই গেইট খোলা যায় না। মাঝে মাঝে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়।
দুধ ওয়ালার পরিচিত গলা শুনে ছেলে আগেই দৌড়ে গেইটে চলে গেছে। সারাদিন ছেলেটার খালি দুস্টামি!
রফিয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেইট খোলে।
"ভাবি আসসালামু আলাইকুম। "
রফিয়া ঘোমটার ভেতর মাথা নেরে নিঃশব্দে সালামের উত্তর দেয়। দুধের পাতিল এগিয়ে দেয়। দুধ ওয়ালা দুধ মেপে দিতেই রফিয়া পাতিল নিয়ে তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়, তার মন পরে আছে "বেগম" পত্রিকার নায়ক নায়িকা "আজিম-সুজাতার" ছবির দিকে। সিনেমার জুটি বাস্তবে ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই খবর ই খুব মন দিয়ে পড়ছিল। অন্যমনস্কতায় রফিয়া খেয়াল করলো না যে ছেলে দুধ ওয়ালার পেছন পেছনে গেইট থেকে বেরিয়ে গেছে!
কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়ার পর ঘরে কোন শব্দ নাই দেখে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলেন, জহির গেল কোই?
ছেলেটারে নিয়া আর পারিনা, সারাদিন দুস্টামি!
পাশের ঘরে উকি দিলেন,"জহির! কই গেলি? "
এই ঘরে নাই!
উঠানে দৌড়ে গেলেন, নাই!
উঠানের শেষ মাথায় বাথরুমে ও দেখলেন, ছেলে নেই!
হঠাৎ কি মনে হতে এক দৌড়ে গেইটের দিকে গেলেন।
আয় হায়! গেইট খোলা!
ছেলে নিঃসচই বাইরে চলে গেছে!
জহির! চিৎকার করতে করতে গলিতে বেরুলেন রফিয়া।
ডানে বায়ে তাকালেন ছেলের খোঁজে। নেই! দৌড়ে হারুনদের বাসায় গেলেন, ও নিলি হারুন, তোর আম্মারে ডাক,জহিররে খুইজা পাইতাছিনা!
হাহাকার করে চিৎকার করছে রফিয়া।
শুনে নিলু ও তার মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে!
ও জহিরের মা, কি হইছে?
আপা, জহিররে খুইজা পাইতাছি না!
হেঃ কন কি? এই নিলু যা তো, সোহেলের মারে ডাক দে।
নিলু দৌড়ে পাশের বাড়ির মীর সাহেবের স্ত্রীকে ডাকতে যায়।
এদিকে রাফিয়ার শরীর ভয়ে কাপছে!
আল্লাহ, আমার ছেলের কি হবে!
***
সারা এলাকার মহিলারা জহিরদের বাসায় একত্রিত হয়েছে, কত বড় সর্বনাস,জহির কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রফিয়ার অবস্থা প্রায় অচেতন।
পাড়ার সকল মহিলা আসেপাশে খুঁজে দেখেছেন,
এলাকার কোথাও জহির নেই।
"আপা,আমার ছেলের কি হইব? "
পলাশের আম্মা ধমকে উঠে - চুপ কর, মাগি! ছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পারছ না,অখন কান্দে! "
চঞ্চলের আম্মা ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকেন, সাথে আরও তিন জন মহিলা, সবার ই শাড়ি জামা সমস্ত শরীর ভেজা!
মুখ থমথমে।
পাশের ডোবায় নেমে দেখেছেন, যদি বাচ্চা ছেলেটি পানিতে নেমে থাকে!
নাহ,গত আধ ঘন্টা তিন জন মিলে সারা ডোবা তন্নতন্ন করেছেন।
আল্লাহর রহমত জহির পানিতে পরেনি।
পাড়ার সব মহিলা ও বাচ্চারা জড়ো হয়েছে। উঠানে বাচ্চারা খেলছে।
টুটুলের মামা কচি আজ কলেজ যায় নি, সাইকেল চালিয়ে গোরান বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখে, জহির একটা সেলুনের চেয়ারে বসে কাঠি লজেন্স খাচ্ছে!
সাইকেল থামিয়ে, সেলুনে ডুকে কচি মামা," কি রে জহির, তুই এইখানে কি করছ? রফিক কই? "
ছয় বছরের বাচ্চা জহির কচি মামাকে দেখে হেসে হাত বারিয়ে দেয়। "মামা!"
সেলুন ওয়ালা জিজ্ঞেস করল - ভাই, আপ্নে এই বাচ্চারে চিনেন! "
হ,চিনি, কি হইছে! "
বাচ্চা টা একা একা রাস্তা দিয়া কান্তে কান্তে যাইতাছে দেইখা আমরার দোকানে বসাইয়া রাখছি, কারো বাচ্চা হারাইছে মনে কইরা! "
"ভাই, খুব ভাল কাজ করছ।"
জহির কে কোলে নিতে নিতে বলল- কি রে পাকনা, হারাইলি কেমনে?
দুধ ওয়ালা... "
চল, আগে বাসায় যাই, তোর আম্মার না জানি কি অবস্থা! "
যখন
রফিয়ার মনটা আজ বেশ খুশি খুশি, কারন তার আব্বা আসছে দেশ থেকে। আব্বাকে বরাবরই একটু ভয় পেলেও রফিয়া জানেন আব্বা তার এই মেয়ে অত্যাধিক স্নেহ করেন। আব্বা আসার সময় এটা সেটা কতকি যে এনেছেন। নদীর মাছ ভেজে, হাসের মাংসের তরকারি তার মায়ো সিদোল শুটকিও রেধে পাঠিয়েছে। কোনোকিছু রান্নার দরকার ছিলোনা তবুও আব্বা আসছে এতোদিন পর তার পছন্দের সজনে ডাল রান্না চড়ায়ে রফিয়া মাগরিবের আজানের আগে আগে ঘরের দরজা জানালা লাগাচ্ছে এমন সময় আব্দুল ওয়াহাব সাহেব ঘরে ঢুকলেন, রফিয়া তাড়াতাড়ি এসে বলে আব্বা ওজুর পানি দিমু। তিনি অপেক্ষাকৃত গম্ভীর, মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন না আমি মসজিদে নামাজ পরে আসতেছি। রফিয়ার মনে সংশয় আব্বা হটাৎ এতো গম্ভীর!! আসরের পরপর তার স্বামী কে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাদের একটা জায়গা দেখতে যেটা কিছুদিন আগেই তার স্বামী নূরুল ইসলাম বায়না করছে। দুজন যখন বেড়হয় তখন রফিয়ার বেশ আনন্দই লাগছিলো এক স্থায়িত্বের প্রশান্তি তার চেহারায়, নিজের একটা বসতি একান্তই নিজের। কত শত স্বপ্ন এসে ভিড় করে তার চোখে।
কিন্তু ফিরে এসে আব্বা ভাব গতিক সুবিধার ঠেকতেছেনা। কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে ডাল বাগার দিয়ে চায়ের পানি বসায়, তার স্বামীও আব্বার সাথে ফিরে নাই এটাও আশ্চর্য লাগতেছে। আবার কোনো ঝামেলা হয় নাইতো? মনের মধ্যে এক উৎকন্ঠা, দুইজনের কাউরেই কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না। দুইজনই বেশ রাগী মানুষ। রফিয়া উৎকন্ঠিত মনে অপেক্ষা তারা কিছু বলে কিনা।
নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে চা দিতে বললেন ওয়াহাব সাহেব, মেয়ের হাতের চা টা তিনি বেশ উপভোগই করেন, রফিয়া সুন্দর করে চায়ের সাথে তার আনা বিস্কুট থেকে দুইটি টোস্ট পিরিচের কোনায় দেয় সাথে এক গ্লাস পানি। তিনি হাত বাড়িয়ে আগে পানিটা নেন এক ডোকে শেষ করেন বিস্কুট টা হাতে নিয়ে বলেন এগুলা তুমগো লাইগ্যা আনছি আবার আমারে দিলা কেন? হাইন আফনে আমরারতো আছোই। আগের ফিল্লা যেইডি আনছেন হেইডিত্তো শেষ হইছেনা। জামাই আমারে যাত্রাবাড়ী নামায়া দিয়া কইলো আফনে বাসাত যান আমি ইট্টু মফিজের এহানতে হইয়া আসি। রফিয়া কইলো হো এই একজনইতো, গেলে হের ঐহানেই যায়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চায় কিছু বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ প্রশ্ন করে জামাইয়ের সবকিছু ঠিকঠাক চলতাছেতো?? রফিয়া অবাক, হো আব্বা সবইতো ঠিকঠাক কোনো কিছু হইলেতো কইতো, লোকটা হুটহাট চেইত্যা যায় কিন্তু কিছু হইলে আগে আমারেই কয়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলোনা। তিনি গায়ের পান্জাবিটা ছেড়ে বিছানায় শরীরটা ইকটু এলিয়ে দিলেন। কখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল করেননি। মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আব্বা আফনের কি শরীরটা খারাপ? ওয়াহাব সাহেব নিজেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন অসময়ে ঘুমিয়ে পরায়। হেসে বললেন নারে বেডি কহন যে চোখডা লাইগ্যা গেলো টের ফাইছিনা।
উউট্টা এশার নামাজটা পড়েন আমি ভাত বাড়তাছি। জামাই আইছে?? আইয়া পরবো আফনে নামাজ শেষে হাইয়া লোন। রফিয়ার মনে আরো সংশয় নিশ্চয়ই কিছু হইছে নইলে এতোক্ষনেতো লোকটা চইলা আসার কথা। খাবার সময়ই জিগাইতে হইবো আব্বারে কিছু হইছে নি। ওয়াহাব সাহেব নামাজ শেষে দেখেন মেয়ে শীতল পাটিতে খাবার বিছায়া রাখছে অনেক আয়োজন সাথে তার পছন্দের সজনে ডালও আছে। আলহামদুলিল্লাহ এতকিছু? সব তুই করছোস?? মেয়ে হাসে ইকটু সাহস পায় আব্বা স্বাভাবিক হইতাছে। মেয়ে বাবার পাতে খাবার তুলে দেয় ওয়াহাব সাহেব খেতে খেতে রান্নার প্রসংশা করে রান্না ভাল হইছে, তোর মায়োর মত, রফিয়া মনে মনে হাসে, আব্বা নিজেও জানেনা তার মেয়ের জন্য মায়ো কি কি দিয়া দিছে। এগুলো তার মায়েরই রান্না সে শুধু ডাল পাকাইছে।
ওয়াহাব সাহেব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আইবো তোরা খাবিনা? হেয় আইলেই খামু আপনি খানতো, ওয়াহাব সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন, সুযোগ বুঝে রফিয়া প্রশ্ন করে আব্বা জায়গা যে দেখতে গেলেন, কেমুন দেখলেন? কিছুই দি কইলেন না?
ওয়াহাব সাহেব ইকটু থামলেন আবার ভাত মাখতে মাখতে বললেন জায়গায় তো যাইতারছিনা ঐহানে এহনো রাস্তা হইছেনা। এই ডেমরার এদিকেত্তে ত্রিমহনি একটা জায়গা ঐহানতে নুরুল ইসলাম আমারে আঙুল দা দেহাইলো উইযে দূরে আমগো জায়গাডা আব্বা। আমি ইকটু অবাক হইছি, টেহাদা কেউ বিল কিনেরে। পয়সাডি ফানিত ফালাইয়া আইসে। আমিতো হেরে ভালই জানতাম ফাগল টাগল হইয়া গেলোনি। রফিয়া এতক্ষণে বুঝলো আব্বা কেন এত গম্ভীর ছিলেন। বাবা-মেয়ে কেউ তখনও জানেনা তাদের সেই বিলের আশপাশটা জুড়ে একদিন মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং থেকে শুরু মার্কেট সিনেমা হল সবই গড়ে উঠবে। সেই সাথে নিজেদের একটা চারতলা বাড়ী।
তখন
সাল ১৯৬৪.
রফিয়ার বিয়ের মেহেদী না শুকাতে ই একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।
নুরুল ইসলাম এর টিবি হয়েছে!
লোকে বলে যক্ষা, হইলে নাই রক্ষা! একেমন কিথা! রফিয়া মাত্র ফিরা যাত্রায় এসেছে বিয়ের পর।এই সময়ে এমন বিপদ। আবদুল ওহাব মেয়ের জামাই এর এই সংবাদ পেয়ে প্রানের ধন, কলিজার টুকরো মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছেন! নুরুল ইসলাম কে বিবাড়িয়া মেড্ডা হাস্পাতালে ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু পিতার প্রাণ তার মেয়েকে হাস্পাতালে যেতে দিতে চান না! লোকজ বিশ্বাস, যক্ষা হইলে....
মেয়ের শশুর বাড়ি থেকে কয়েক বার খবর পাঠানোর পরও আব্দুল ওহাব মেয়েকে যেতে দেননি।
মাইয়ো,কি করতাম,তোমরার জামাই রে তো দেখতে যাওন দরকার! " রফিয়া তার
মা'কে জিজ্ঞেস করে। "আব্বা তো যাইত দিতাছে না!"
তোর জামাই তুই বুঝবি!"মা ঠাট্টা করেন।
মাইয়ো! " রফিয়া প্রায় কেদে দেয়! " কি করতাম কও না।"
কি করবি আর! তোর বাপের কথা শুনলে চলত না। তুই ওদুদ রে লইয়া হাস্পাতাল যা। "
….
রফিয়া ছোট ভাই ওদুদ কে নিয়ে ভিতু পায়ে মেড্ডা হাস্পাতালে ঢুকে। মনে ভয় যদি কেঊ দেখে আব্বাকে বলে!
নুরুল ইসলাম মন খারাপ করে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। ওদুদ এর সাথে রফিয়া কে দেখে তার মনটা অভিমানে ভরে উঠে!
আসছেন, লাট সাহেবের বেটি!
মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
লম্বা ঘোমটা দিয়ে রফিয়া স্বামির পাশে গিয়ে বসে।
মাইয়ো টিফিনকারিতে গাজরের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছেন। ওদুদ টিফিনকারি বিছানার রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যায়,"আফা আমি গেইডো আছি,তুমি যাওয়ার সম ডাক দিও"
নুরুল ইসলামের দিকে চেয়ে রফিয়ার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে!
একি হাল হয়েছে উনার!
বিয়ের সময় সবাই বলাবলি করেছে - বরের স্বাস্থ্য কত সুন্দর! ব্যায়াম বীর!
সেই স্বাস্থ্য এখন কি হইছে!
রফিয়া ঘোমটার ভেতর কাদতে থাকে। রফিয়ার কান্না দেখে নুরুল ইসলাম ও ঠুকরে কেদে দেন।
স্বামী স্ত্রী নিরবে কিছুক্ষন কাদে।
"কি হইল আমার কওত রফিয়া। " নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে।
আমি কি বাছতাম না!"
স্বামীর প্রশ্ন শুনে রফিয়ার বুক ফেটে যায়।
নিরবে টিফিনকারি থেকে হালুয়া বের করে স্বামীকে তুলে দেয়।
মনে মনে দোয়া করে- আল্লাহ তুমি উনারে বাচাও! মাবুদ তুমি উনারে বাচাও!
তখন
যক্ষা হইলে নাই রক্ষা - প্রবাদ কে ভুল প্রমাণ করে আল্লাহর অশেষ রহমতে নুরুল ইসলাম দুই সপ্তাহের মধ্যেই আপাত সুস্থ হয়ে উঠলেন, তার শরীর সুস্থ হয়ে উঠলেও কিছু জীবানু থেকে যায়, যা ধরা পরবে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর! সেটা অন্য গল্প, পরবর্তীতে বলা হবে।
নুরুল ইসলাম ময়দাগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে মনমরা হয়ে বসে, পাশে তার ভাতিজা নান্নু মিয়া। বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুজনে সুখ দুখের সাথি।
লঞ্চ ঘাটের ডিম ওয়ালা আওয়াজ দেয়- ডিম, বল ডিম!
নান্নু মিয়া জিগ্যেস করে - "কাহা, বইদা হাইবা (খাইবা)?
নুরুল ইসলাম মাথা নারে।
"হাউ একটা, সইলো জুর ফাইবা!"
"নাহ, চা পাইলে খাইতাম" নুরুল ইসলাম দীর্ঘশাস ফেলেন।
রফিয়ার কথা মনে পরে! লাটসায়েব এর বেটি হাস্পাতালে চা নিয়া আসত তার জন্য!তিনি রাগ করে বলতেন - তোমার আব্বার হোটেলের চা খাইতাম না! "
"হোটেলের চা না, আমি নিজে রানছি!খাইন! "রফিয়া বলত।
রফিয়ার জন্য বড় মায়া লাগে! নুরুল ইসলাম এর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে।
"কাহা, চাচির লেইগ্যা পেট পুরে নি, কান্দ কেরে? "
নান্নু চাচাকে সান্ত্বনা দেয়।
" বইদা হাউ একটা। "
"তুই খা, এক কাপ চা হইলে খাইতাম! "
"তুমার হালি চা আর চা, ঢাহা গিয়া তুমার অব্বাস হারাপ হইছে।"
দুর্বল শরীর নিয়ে নুরুল মুচকি হাসে,কথা সত্যি।
"দেখ, চা পাছ নি।"
"তুমি বও ইহানো, আমি চা আনতাছি" নান্নু মিয়া চায়ের খোঁজে বেরিয়ে যায়।
নুরুল ইসলাম একা বসে রফিয়ার কথা ভাবে, আল্লাহ ই জানেন, রফিয়ার সাথে তার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ কি! ভাব নমুনা ভালো না। তুন্দুল হুজুরের নিয়ত ভালো মনে হইতাছে না! পাগল বেটা মেয়েরে আর শশুর বাড়ি পাঠাইতে চায় না। একবার হাসপাতালে মেয়ে জামাইরে দেখতেও আইলো না! কেমন পাষাণ!
" এই লও তুমার চা!" নান্নুর কথায় নুরুর ধ্যান ভাংগে।
"তাগদা হাও (খাও), লঞ্চ আইতাছে! "
চা মুখে দিয়ে নুরুর আবার রফিয়ার কথা মনে পরে!
বার বার তার সুন্দর মুখটা চোখে ভাসে!
কিছুক্ষন পর লঞ্চ আসলে দুজনে গিয়ে উঠেন, গন্তব্য নবিনগর, সেখান থেকে নৌকায় বিটঘর,তারপর হেটে গুরিগাও।
বেলা দুপুর। কড়া রোদে নদীর পানি চিক চিক করছে। লঞ্চ ছারে সারেং। ধীরে ধীরে ময়দা গঞ্জ লঞ্চঘাট দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে নুরুল অনুচ্চ সরে বলেন - হে আল্লাহ তুমি রফিয়ারে ভালো রাইখো!"
বিদায়রত ব্রাহ্মণ্ বাড়িয়ার দিকে তাকিয়ে নুরুল ইসলাম কঠিন এক শপথ নেয়, সে
আর কখনও শশুর বাড়ি যাবে না!
তখন
কুদ্দুস মাস্টার কান্দির পাড় রুটিঘর হোটেলের সামনে এসে দাড়ান। মনে ভয়, তুন্দুল হুজুর জানি কি কয়!
যে মেজাজি মানুষ! যথারীতি
হোটেলে কাস্টমার এর ভীড়।
এই রুটি ঘর বিবাড়িয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় হোটেল।
আব ওহাব এই হোটেলে বিবাড়িয়ায় প্রথম তুন্দুল রুটি তৈরী করেন! রুটি ঘর এর গরম গরম তুন্দুলরুটি এত জনপ্রিয়তা পায় যে সবাই আ ওহাব সাহেব কে তুন্দুল হুজুর ডাকতে শুরু করেন!
তুন্দুল হুজুর কাউন্টার এ বসে!
সালাম দিয়ে পাশে গিয়ে দাড়ালেন কুদ্দুস মাস্টার।
মামার সইলডা ভালো নি?
" হ, সইল ভালো, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন পর আসলা? "
ইস্কুলো পরীক্ষা চলতাছে, একটু ব্যস্ততা যাইতাছে, মামা।"
হুম, বস, এই মাসটররে সরের চা দে, লগে মিস্টি সিংগাড়া দিস।"
"মামা, সিংগাড়া খাইতাম না, খালি চা দিত কন।"
"না কইর না, মাত্র নামাইছে কড়াই থেইকা। খাও। আর বাইম মাছ রানছে, ভাত খাইয়া যাইবা।"
তুন্দুল হুজুরের কথার উপর কিছু বলার নাই!
মামা, একটা কথা কইতাম আইছি। "
বও, টেবিলে, আমি ক্যাশ সামলাইয়া আসতাছি।"
কিছুক্ষণ পর আবদুল ওহাব এসে কুদ্দুস মাস্টার এর পাশে বসেন।
"কও, কি কইবা।"
"মামা, চলেন কেবিনে গিয়া বসি" মাস্টার বিনীত ভাবে প্রস্তাব দেন।
আবদুল ওহাব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন- সব খবর ভালো নি।"
খবর ভালো মামা, একটু জরুরি আলাপ আছিল।"
পাশেই তিনটা ফ্যামিলি কেবিন, পরদা ডাকা।
ভেতরে বসে কুদ্দুস মাস্টার ইতস্তত করেন।
কি কোন সমস্যা? " তুন্দুল হুজুর আবার জিজ্ঞেস করেন।
"মামা, রফিয়ার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়া আসছি!"
কুদ্দুস মাস্টার এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন।
কথা শুনে তুন্দুল হুজুর চমকে উঠেন!
বকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে!
কলিজার টুকরা রফিয়ার বিয়ার প্রস্তাব!
দীর্ঘ শাস ফেলে নিজেকে সামলান।
মেয়ে বড় হইছে, বিয়ে তো দিতেই হবে! চিরকাল তো আর আগলে রাখা যাবেনা।
" ছেলে ভালো, ঢাকা একটা অসুদ কম্পানিতে চাকরি করে" কুদ্দুস মাস্টার ভয়ে ভয়ে বলেন। তিনি জানেন, রফিয়া মামুর জানের টুকরা!
"বাড়ি গুরিগাও। "
দুজনে এরপর রফিয়ার বিয়ের আলাপে ব্যস্ত হয়ে যায়। কুদ্দুস মাস্টার প্রস্তাব আনছে, এরপর আর কি কথা চলে!
এদিকে রফিয়া আব্বাস ভাইয়ের সাথে স্কুল থেকে ঘরে ফিরেছে।
রফিয়া জানেনা আজই তার শেষ স্কুল যাওয়া।
আর কোন দিন সে স্কুলে পড়তে যাবে না!
তখন
রফিয়া ত জামাই বেভাইরাত সইল মাছ আনছে!" মঞ্জু হাসতে হাসতে বলে।
রফিয়া চোখ বড় করে তাকায়।
মঞ্জু আর রোকেয়া হেসে গড়িয়ে পরে একজন আরেকজনের উপর।
আজ রফিয়ার বিয়ে!
মঞ্জু আর রোকেয়া প্রিয় বান্ধবী! একটার পর একটা খবর এনে দিচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। এ পর্যন্ত পাওয়া সব খবর ই খারাপ!
বর যাত্রী আসার কথা ছিল দেড়শ, আসছে পয়ত্রিশ জন।
সবাই বলাবলি করছ- বরপক্ষ কিপটা, খরচ বাচাতে এই আকাম করছে!
আব্দুল ওহাব এর সংসারে আজ প্রথম বিয়ে!
তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার বিয়ে!
কত সাজ গোস, কত আয়োজন! আসেপাশের তিন বাড়ি ঘীরে পেন্ডেল করেছেন আব্দুল ওহাব! লাইটিং, এমনকি ডেকোরেটারে বড় পেন্ডেল ছিল্মা বলে তিনি টেইলার থেকে অর্ডার দিয়ে সিলাই করেছেন! বরপক্ষ সব কিছুর মধ্যে পানি ঢেলে দিল!
রাহে আব্দুল ওহাব এর শরীর ফেটে যাওয়ার দশা!
বার বার ঘরের ভিতর বাহির করছেন আর বলছেন - জোহরা দেখলা কত বড় বেজ্জতি!"
জোহরা স্বামীর মেজাজ জানেন, সান্তনা দেয়ার জন্য বলেন - আফনে ইহানো বইয়া ইকটু জিরাইন না! বাকি সব আবরু আওয়াল আর আলিম দেখব!"
হুম,পুলাপান দিয়া কোন কাম হয়?"
" হইব, আফনে চিন্তা কইরেন না, কুস্তা অইতো না, আল্লাহ পাক সব ঠিক কইরা দিব, আমরার রফিয়া বড় ভালো মাইয়া" জোহরার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। তিনি মুখ অন্যদিকে ফেরান।
তিনি জানেন স্বামীর মনে আরোও বেশি কষ্ট!
রফিয়া তার কলিজার টুকরো।
পিতলের গ্লাসে পানি এগিয়ে দেন স্বামীকে। মাটির কলসের ঠান্ডা পানি!
পানি খেতে খেতে আব্দুল ওহাব বির বির করেন- কুদ্দুস আমার কি সর্ধনাস করল!"
দীর্ঘ শাস ফেলেন- আমার রফিয়ার কফালো কি আছে আল্লাহ জানে!"
এদিকে পাশের ঘরে রোকেয়া বলছে- রফিয়া, অদুদ কইছে তোর জামাইর বলে মাথা ছুডু!"
রফিয়া ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকে, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পরে!
মঞ্জু রোকেয়াকে ইশারা দেয়, রফিয়া কান্তাছে! চুপ কর!
মঞ্জু রফিয়ার কাধে হাত রাখে, রফিয়া ঠুকরে কেদে উঠে!
"আরে বিহুব, আমরা দ ঠিশারা করছি " রোকেয়া সান্তনা দেয়।
আমি চুফি দিয়া দেখছি, তর জামাই দেখতে সুন্দর! চুল বেশি ছুঢু কইরা কাটছে দেইখা মাথা ছুডু লাগে।"
মঞ্জু চোখ গরম করে তাকায় রোকেয়ার দিকে।
রোকেয়া জিভে কামড় দেয়!
তারাতাড়ি বলে- রফিয়া, তর কফাল কত বালা, আলিম কইছে দুইশ তিপ্পান্নডা পিতলের কলশি উপহার আইছে!"
রফিয়া ঘোমটার ভেতর হেসে ফেলে!
মঞ্জু গুনগুন করে গায়- পিতলের ঘোড়া, পিতলের ঘোড়া....
তখন
আজ রবিবার, অফিস ছুটির দিন।
রাত নয়টা। বি টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক দেখছে বাচ্চারা। নুরুল ইসলাম কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে চা খাচ্ছেন। বড় ছেলে জহির হঠাৎ নাটকের মধ্যে একটা হিন্দি গান শুনে নুরুল ইসলাম কে জিজ্ঞেস করল - "আব্বা, আপনে ত হিন্দি উরদু ভাষা জানেন? পাকিস্তান পিরিয়ডে ত উরদু বলতে হইত, তাই না! "
জহিরের প্রশ্ন শুনে বাবা মুচকি হাসেন।
ভাইবোন সবাই আব্বার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকায়।
চায়ে চুমুক দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন - "আসলে আমরা উর্দু এতটা বলতাম না, সব সময় বাংলা ই বলছি, ইস্কুলে আমরারে উর্দু শিখাইছে, কিন্তু চরচা নাই দেইখা ভুইলা গেছি!"
সুরাইয়া আবদার করে - আব্বা একটু উর্দু কন ত শুনি! "
নুরুল ইসলাম তার ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে! দেখতে দেখতে ছেলে মেয়ে গুলো বড় হয়ে যাচ্ছে!
মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে হইল জহির, চার কি সারে তিন বছর পর সুরাইয়া, এরপর দিলু মনির, মনে হয় এইত সেদিন! কিন্তু মাশাল্লাহ ছেলে মেয়ে গুলো তর তর করে বড় হয়ে গেলো, জহির এখন সিক্সে পড়ে!
"আব্বা, কন না " সুরাইয়া আবার বলে।
ইইতিমধ্যে রফিয়া রান্নাঘর সামলে ঘরে ঢোকেন।
তারও চোখে কৌতুহল।
নুরুল ইসলাম মুচকি হেসে বলেন - উর্দু না হিন্দি জানিনা, ছোট বেলায় একটা গল্প শুনছিলাম, সেইটা বলি শুন।"
ছেলেমেয়েরা টিভি বন্ধ করে নরে চরে বসে।
"তোদের দাদার কাছে শুনা" বহু বছর পর নুরুল ইসলাম এর বাবার চেহারাটা মনে ভাসে!
একদেশে এক রাজা আছিল, বিরাট রাজত্ব। একদিন রাজা তার পাক্কসিরে জিগায় - শুনছি, আমার রাজত্যে একটা গ্রামের মানুষ কুইচ্চা খায়?"
পাক্কসি কয়, হ খায়। রাজা শুইন্না কয় তুমি পাক করতে পারবা? খাইয়া দেখি কেমন।"
কেচোর কথা শুনে বাচ্চারা অবাক হয়ে যায়। আব্বারে উর্দু বলতে গিয়ে একি হচ্চে!
জহির রফিয়ার দিকে তাকায়।
রফিয়া মাথা নেরে ইশারা দেয়- আসতাছে...
ছোট মেয়ে দিলু জিজ্ঞেস করে, "আব্বা হিন্দিতে কননা কেন?"
নুরুল ইসলাম হেসে বলেন - ত রাজা পাক্কসিরে কইছে, তুমি রান্দ। পাক্কসি রান্দছে ঠিক ই কিন্তু একটা সমস্যা হইয়া গেলগা।"
সবাই নুরুল ইসলাম এর দিকে তাকিয়ে।
"রাইন্দা সাইরা বাবরচি গেসে গুসল করতে, আইসা দেখে তরকারি বিলাই খাইয়া ফালাইছে! এখন কি হইব! রাজা দরবারে বসছে, একটু পরে ই খাইতে আসবো, কি করন যায়! চিন্তায় বাবুর্চির অবস্থা খারাপ। দরবারে উজিরনাজির এর সামনে কুইচ্চা কথা কেমনে কয়!
একটা বুদ্ধি পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া দরবারে ঢুকছে।
" হুজুর জাহাপনা,আপকা কুচিয়া পারা থানা ত লুটলিয়া।"
রাজা ত বুঝছে বেটায় কি কয়, পুরা দরবারের লোক চিন্তা করতাছে, কুচিয়া পারা থানা আবার কুনডা,কে আবার লুটপাট করল!
রাজা ত বুঝছে, জিগায়- কোউন"
"হুজুর বিল্লাল খান।" রাজা ঠিকই বুঝছে বিলাই খাইয়া ফালাইছে। জিগায় -
"সরবুদ্দি কাহা থা?" মানে সরা (ঢাকনা) কই!
"ও ত পহেলা থাপ্পড় মেই গিরগিয়া! "
রাজা আবার জিগায় - গদবুদ্দি (গদা, লাঠি জাতীয়) কাহা থা! "
বাবুর্চি চিন্তা করে লাঠি নিয়া ত আমি পাহারা দেই নাই,তাইলে ত চাকরি থাকত না, বুদ্ধি কইরা কয় - ও তো জংগল বাড়ি থা!"
" হুম, আউর কোউন কোউন বাকি হেয়? "
রাজা জানত চায়, পুরা তরকারি ই গেছে না কিছু বাচছে, বেডা সখ করছিল খাইব!
বাবুর্চি কয় - আওর শিরবুদ্দি আর লিজবুদ্দি।"
রাজা বুঝছে কুইচ্চার লেজ মাথা আছে!
একটু চিন্তা কইরা কয় - ওদোন কো বেগুন বাড়ি ভেজ দো।"
বাবুর্চি গিয়া বাকি যেই কুইচ্চা বাচছিল, সেগুলা বেগুন দিয়া ভুনা কইরা রাখে রাজার লেইগা!
এদিকে দরবারের উজির নাজির মনে মনে কয় বিল্লাল খা না জানি কত বড় পালোয়ান! হা হা হা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন