কখন
বৃহস্পতিবার, বাদ মাগরিব, ফেব্রুয়ারী মাস, ১৯৮৩.
ক্রোধে অন্ধ আবদুল ওহাব জোর কদমে হেটে যাচ্ছে তার পরিনতির দিকে, সে জানে না। ব্রাম্মনবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে কখন লোকাল ট্রেনে উঠেছেন, কখন তালশহর নেমেছেন হুশ নেই।
হাটছেন আর বিরবিরিয়ে নিজেই বলছেন, কত বড় সাহস আমার নাতিরে রাখে!
সেই দুপুর থেইকা আমি নাতির জন্য বইসা রইসি! আমার পেটপুড়ার কোন দাম নাই!
তালশহুর রেলস্টেশনে নেমে তিনি পাগলের মত হেটে চলেছেন পশ্চিমে! সামনে একটা কালভার্ট, তিনি মনোযোগ না দিয়ে হেটেই চল্লেন, চোখে চশমা নাই, এদিকে আধার ঘন হয়ে এসেছে।
রাগে তার সারা শরীর কাপছে। সন্তান বাতসল্যে তিনি ভুলে গেছেন রাগ করা হারাম।
আজ দুপুর থেকে অপেক্ষা করছেন, বড় ছেলে বউ ও নাতিকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে ফিরবে, প্রাণ প্রিয় নাতির জন্যে অপেক্ষা!
কথায় আছে_ রাজার বাড়ির হাতি, গরিবের ঘরের নাতি!
দুইটাই বড় প্রিয়!
অবশ্য নাতির শখ আবদুল ওহাব এর পুরো হয়েছে আরো বহু বছর আগেই, তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার ছেলে জহিরের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে। প্রথম নাতিকে নিয়ে কত আনন্দ! কিন্তু মেয়ে থাকে ঢাকায়, চাইলে ই নাতির মুখ দেখা যায় না। তাই বড়
ছেলে আউয়ালের সন্তান হওয়ায় পর যেন তিনি হাতে চাদ পেলেন। আপন খেলার সাথী!
নাতিকে নিয়ে যা-ই করেন মন ভরে না। গত সাপ্তাহে তাই ছেলে যখন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা বলল, ওহাব সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কি করা যাবে, ছেলের বউও খুব ভালো মেয়ে , তাকেও কষ্ট দেয়া যায় না, যাক বাপের বেরিয়ে আসুক, উনার আপত্তি নেই।
বার বার করে বলে দিলেন _বউ, আমার ছেলে তো তোমাদের বাড়ি গেলে আর আসতে চায় না। কিন্তু আমার দিকে চাইয়া মাহবুব রে নিয়া সামনের বৃহস্পতিবার চইলা আইসো।
সারা সপ্তাহ তার নাতিকে ছাড়া কিভাবে কেটেছে তিনি ই জানেন। আজ বিসুদ বার, সকাল থেকে অপেক্ষায়, আউয়াল নাতিকে নিয়ে ফিরবে! নাতির হাসিতে ঘর উজ্জ্বল হবে।
কিন্তু সারাদিন পর ছেলে ফিরলো একা!
ছেলের সাথে নাতিকে না দেখে ওহাব সাহেবের মাথা খাবার হয়ে গেলো।
তিনি তখনি রউনা হলেন তালশহর, ছেলের বউকে জিজ্ঞেস করবেন _ বাপের বাড়ি এসে আমাকে ভুলে গেলা? আমার নাতিকে না দেখলে মন কেমন করে ভুলে গেলা?
রাগে আবদুল ওহাব হাটছেন, জোড় কদম হাটা! সামনে কালভার্ট তিনি খেয়াল করলেন না।
অন্ধকারে পা দিয়ে তিনি নিচে পড়ে গেলেন।
.......
পাশের গ্রাম থেকে দুজন লোক আসছিলো রেলস্টেশন এর দিকে, কালভার্টের কাছে আসতেই ধপ্ করে কিছু পরার আওয়াজ পেল!
এই কি হইলো রে, কালভার্টের উপর থেইক্কা কিছু পরছে মনে হয়!
দুজনে দোউরে এসে দেখলেন, আবদুল ওহাব পড়ে আছেন! অবস্থা খুবই খাবার। দুজনেই ডাকাডাকি করে লোক জরো করে দ্রুত উনাকে রেলস্টেশনে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে বহু লোক জরো হয়ে গেলো, ভাগ্য ভালো তখনই একটা ট্রেন ঢাকা থেকে আসছিল, সবাই মিলে উনাকে ট্রেনে তুললেন।
.….
রাত প্রায় আটটার দিকে এলাকার ছেলেরা এসে খবর দিল, আউয়াল ভাই, জলদি জেলা হাসপাতালে যান। তুন্দুল হুজুরের অবস্থা খারাপ!
বা ১
নুরুল ইসলাম পাগলের মত দোউরাচ্ছে, আর বার বার পিছনে ফিরে দেখছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে শুনেই তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, " আমি জহিররে নিয়া গেলাম, তোমরা সবাই একসাথে থাইকো। "
রফিয়া বলল - তুমি শুধু ছেলেরে নিয়া গেলে হবে! আম্মা, আমি আর অন্যদের কথা চিন্তা করতে হইব না? "
নুরুল ইসলামের জবাব - তোমরারে দেখার জন্য বড় ভাই আছেন, সেই দেখবো, আমি আমার ছেলেরে নিয়া মসজিদে যাইতাছি। আল্লাহ বাচাইয়া রাখলে আবার দেখা হইব। "
বলে তিনি ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে দোউরে বেরিয়ে গেলেন।
পেছন থেকে রফিয়া হতবাক হয়ে সন্তান বাতসল্লে অন্ধ পিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন!
পিতা তার ছেলেকে বুকে জরিয়ে পরিবারের আর সকলকে ভুলে শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কথাই ভাবছেন!
আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও! ও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও!
বাবা ২
জহিরের অফিস যেতে আজ দেরি হবে। খুব সকালে স্বামি স্ত্রী তাদের মেয়ে রাফাকে নিয়ে
পদ্মা ডায়াগনোসিস এ এসেছে, মেয়ের রক্ত পরিক্ষা করতে হবে। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর এল তাদের সিরিয়াল। জহির মেয়ে রাফাকে কোলে নিয়ে নার্সের সামনে দাড়ালো। মেয়ের বয়স মাত্র দুই। ছোট্ট টুনটুনি! নার্স সাভাবিক ভাবে বাচ্চার হাতে টিপে টিপে দেখছেন, কোন হাত থেকে রক্ত নিবেন।
মেয়ে কান্না শুরু করে দিল! নার্সের এদিকে কোন খেয়াল নেই! ইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দিলেন অবলিলায় ছোট্ট শিশুর হাতে। মেয়ে চিৎকার করে উঠলো। জহির শক্ত করে মেয়েকে জরিয়ে ধরলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার বুকের ধন সোনার ময়না ব্যথায় কাদে! পারভীন পাশ থেকে জহিরের কাধে হাত রাখে। বাবা আরোও শক্ত ভাবে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে।
হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে সুস্থতা দাও!
বাবা ৩
জহির অনেক দিন পর জাপান থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরছেন আজ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতে রাস্তা যেন ফুরায় না।
ঘরের দরজায় সবাই অপেক্ষায়। জহিরের সাথে ব্যাগ ভরতি গিফট। হৈচৈ আনন্দের মধ্যে ঘরে ঢুকল।
সবাইকে বুকে জরিয়ে কত কথা আর চোখ খুজছে মেয়েদের। রাফা ইফা কোথায়!
ছোট মেয়ে ইফাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন।
মেয়ে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে!
"আয় হায়, ইফার কি হইছে। "
ইফার মারাত্মক অসুখ হইছিল, তুমি বিদেশে কস্ট পাইবা সে জন্য তোমারে বলি নাই! "
বাবা, ইফার জন্য আনা খেলনা সাইকেল, গাড়ি সবকিছু বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ইফা দুর্বল শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে একমনে খেলতে থাকে। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে।
মেয়েকে আনন্দে হাসতে দেখেও বাবার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ে।
তখন
ভাই, তুমি খাও না যে! " রফিয়ার হাতে আইসক্রিম, মুখে তেতুল! কথা বোঝা যাচ্ছে না।
আব্বাস জিজ্ঞেস করল -কি কস? বুঝিনা!
ইস! " আইসক্রিমে কামড় দিয়ে বলল, তুমি কুলফি খাইবা না?
তুই খা, পাগলি কুনখানকার, কুলফি আর তেতুল মাইনসে একলগে খায়?
আমি খাই, আমার ভালো লাগে, তুমি না খাইলে নাই," রফিয়ার জবাব।
কি, তোর এত্ত সাহস! দাড়া আইজ ঘরে গিয়া মামুরে কইতাছি, তুই আমার লগে ব্যদ্দবি করছস, দেখিস মামু কি করে! " আব্বাস ভয় দেখায়।
ভাই, তোমার আল্লাহর দোহাই, আব্বারে বিচার দিও না, তুমি যা চাইবা তাই দিমু " রফিয়া এখন আব্বাস কে মানাতে চেস্টা করে।
আব্বাস রফিয়ার ফুফাতো ভাই, ওদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে। বোনের ছেলে বলে আবদুল ওহাব খুব আদর করেন। ছেলাটা বাবা মা ছাড়া দুরে আছে! তার সব কথাই আব্বার সায়। ভাই বোন এক সাথে স্কুলে যায় আসে।
অন্নদা স্কুলের সামনে আব্বাস চোখ গরম করে রফিয়ার দিকে তাকায়। আর মনে মনে হাসে। ছোট বোনের ভয় পাওয়া দেখে মায়া লাগছে!
ভাই বোনের খুব মিল। সারাদিন দুই জন একসাথে, পড়া, স্কুল যাওয়া খেলা সব।
ভাই, চাইলতার আচার খাইবা? " রফিয়া আবার জিজ্ঞেস করে।
"না, কিচ্ছু খামু না, চল বাসায় যাই, মামি চিন্তা করবো"
আব্বাস তাড়া দেয়।
ভাই, তোমারে আল্লার কিরা, আব্বার কাছে বিচার দিও না!"
দিমু না, যা। কিন্তু আর বেদ্দবি করবি না ক?
ঠিক আছে, আর করমু না" রফিয়া কথা দেয়।
ভাই বোন বই খাতা নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে।
রফিয়া গায়ের উড়না সামলাতে হিমসিম খায়। তার গায়ের তুলনায় উড়না অনেক বড়। টেনেটুনে কাপড় টা কোমড়ে ভালো ভাবে পেচিয়ে নেয়। কালিবাড়ির মোড় এসে রফিয়া আব্বাসের হাত চেপে ধরে। আব্বাস বোনকে মাথা নেরে সান্তনা দেয়।
এত ভয় পাছ কেন? "
"তুমি জাননা, অই বটগাছে ভুত আছে! " রফিয়া শক্ত করে আব্বাস ভাইয়ের হাত চেপে ধরে.....
যখন
১০৩/৭ নামা গোরান, পোস্ট অফিস - বাসাবো, থানা- খিলগাঁও। রফিয়ার নতুন ঘর। নতুন ঠিকানা। স্বামী স্ত্রীর আপন সপ্নের বাড়ি। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থাকার পর নামা গোরানে ৩ কাঠা জমি কিনে নিজ বাড়ি তৈরি করেছেন নুরুল ইসলাম, তখন ১৯৬৬ সাল। দোচালা টিনের ঘর।
তাও প্রায় দশ বছর হলো।
আজ সোমবার। ঘন্টা দুয়েক আগে নুরুল ইসলাম অফিস গিয়েছে । দেবর রফিক গিয়েছে কলেজ। এরপর সন্ধা পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে একা। সকালে স্বামি আর দেবরকে বিদায় দিয়ে সময় কাটানো মুসকিল হয়ে যায়।
দিনের বেলায় পুরো এলাকা জুড়ে কোন পুরুষ মানুষের মুখ দেখা যায় না! নতুন এলাকা, বসতি কম। ভাগ্য ভালো কিছু দিন আগে মীর সাহেবের পরিবার পাশের জমিতে এসে উঠেছে। মীর ভাবির কাছ থেকে আনা মাসিক পত্রিকা "বেগম " পড়ছে রফিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। পাশে ছেলে জহির মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছে। হঠাৎ গেইট থেকে আওয়াজ এল - দুধ ল--ন!
দুধ ওয়ালা এসেছে দুধ নিয়ে।
পুরো এলাকা সুনসান নীরব। কেউ এসে ডাকলে ই গেইট খোলা যায় না। মাঝে মাঝে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়।
দুধ ওয়ালার পরিচিত গলা শুনে ছেলে আগেই দৌড়ে গেইটে চলে গেছে। সারাদিন ছেলেটার খালি দুস্টামি!
রফিয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেইট খোলে।
"ভাবি আসসালামু আলাইকুম। "
রফিয়া ঘোমটার ভেতর মাথা নেরে নিঃশব্দে সালামের উত্তর দেয়। দুধের পাতিল এগিয়ে দেয়। দুধ ওয়ালা দুধ মেপে দিতেই রফিয়া পাতিল নিয়ে তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়, তার মন পরে আছে "বেগম" পত্রিকার নায়ক নায়িকা "আজিম-সুজাতার" ছবির দিকে। সিনেমার জুটি বাস্তবে ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই খবর ই খুব মন দিয়ে পড়ছিল। অন্যমনস্কতায় রফিয়া খেয়াল করলো না যে ছেলে দুধ ওয়ালার পেছন পেছনে গেইট থেকে বেরিয়ে গেছে!
কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়ার পর ঘরে কোন শব্দ নাই দেখে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলেন, জহির গেল কোই?
ছেলেটারে নিয়া আর পারিনা, সারাদিন দুস্টামি!
পাশের ঘরে উকি দিলেন,"জহির! কই গেলি? "
এই ঘরে নাই!
উঠানে দৌড়ে গেলেন, নাই!
উঠানের শেষ মাথায় বাথরুমে ও দেখলেন, ছেলে নেই!
হঠাৎ কি মনে হতে এক দৌড়ে গেইটের দিকে গেলেন।
আয় হায়! গেইট খোলা!
ছেলে নিঃসচই বাইরে চলে গেছে!
জহির! চিৎকার করতে করতে গলিতে বেরুলেন রফিয়া।
ডানে বায়ে তাকালেন ছেলের খোঁজে। নেই! দৌড়ে হারুনদের বাসায় গেলেন, ও নিলি হারুন, তোর আম্মারে ডাক,জহিররে খুইজা পাইতাছিনা!
হাহাকার করে চিৎকার করছে রফিয়া।
শুনে নিলু ও তার মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে!
ও জহিরের মা, কি হইছে?
আপা, জহিররে খুইজা পাইতাছি না!
হেঃ কন কি? এই নিলু যা তো, সোহেলের মারে ডাক দে।
নিলু দৌড়ে পাশের বাড়ির মীর সাহেবের স্ত্রীকে ডাকতে যায়।
এদিকে রাফিয়ার শরীর ভয়ে কাপছে!
আল্লাহ, আমার ছেলের কি হবে!
***
সারা এলাকার মহিলারা জহিরদের বাসায় একত্রিত হয়েছে, কত বড় সর্বনাস,জহির কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রফিয়ার অবস্থা প্রায় অচেতন।
পাড়ার সকল মহিলা আসেপাশে খুঁজে দেখেছেন,
এলাকার কোথাও জহির নেই।
"আপা,আমার ছেলের কি হইব? "
পলাশের আম্মা ধমকে উঠে - চুপ কর, মাগি! ছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পারছ না,অখন কান্দে! "
চঞ্চলের আম্মা ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকেন, সাথে আরও তিন জন মহিলা, সবার ই শাড়ি জামা সমস্ত শরীর ভেজা!
মুখ থমথমে।
পাশের ডোবায় নেমে দেখেছেন, যদি বাচ্চা ছেলেটি পানিতে নেমে থাকে!
নাহ,গত আধ ঘন্টা তিন জন মিলে সারা ডোবা তন্নতন্ন করেছেন।
আল্লাহর রহমত জহির পানিতে পরেনি।
পাড়ার সব মহিলা ও বাচ্চারা জড়ো হয়েছে। উঠানে বাচ্চারা খেলছে।
টুটুলের মামা কচি আজ কলেজ যায় নি, সাইকেল চালিয়ে গোরান বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখে, জহির একটা সেলুনের চেয়ারে বসে কাঠি লজেন্স খাচ্ছে!
সাইকেল থামিয়ে, সেলুনে ডুকে কচি মামা," কি রে জহির, তুই এইখানে কি করছ? রফিক কই? "
ছয় বছরের বাচ্চা জহির কচি মামাকে দেখে হেসে হাত বারিয়ে দেয়। "মামা!"
সেলুন ওয়ালা জিজ্ঞেস করল - ভাই, আপ্নে এই বাচ্চারে চিনেন! "
হ,চিনি, কি হইছে! "
বাচ্চা টা একা একা রাস্তা দিয়া কান্তে কান্তে যাইতাছে দেইখা আমরার দোকানে বসাইয়া রাখছি, কারো বাচ্চা হারাইছে মনে কইরা! "
"ভাই, খুব ভাল কাজ করছ।"
জহির কে কোলে নিতে নিতে বলল- কি রে পাকনা, হারাইলি কেমনে?
দুধ ওয়ালা... "
চল, আগে বাসায় যাই, তোর আম্মার না জানি কি অবস্থা! "
যখন
রফিয়ার মনটা আজ বেশ খুশি খুশি, কারন তার আব্বা আসছে দেশ থেকে। আব্বাকে বরাবরই একটু ভয় পেলেও রফিয়া জানেন আব্বা তার এই মেয়ে অত্যাধিক স্নেহ করেন। আব্বা আসার সময় এটা সেটা কতকি যে এনেছেন। নদীর মাছ ভেজে, হাসের মাংসের তরকারি তার মায়ো সিদোল শুটকিও রেধে পাঠিয়েছে। কোনোকিছু রান্নার দরকার ছিলোনা তবুও আব্বা আসছে এতোদিন পর তার পছন্দের সজনে ডাল রান্না চড়ায়ে রফিয়া মাগরিবের আজানের আগে আগে ঘরের দরজা জানালা লাগাচ্ছে এমন সময় আব্দুল ওয়াহাব সাহেব ঘরে ঢুকলেন, রফিয়া তাড়াতাড়ি এসে বলে আব্বা ওজুর পানি দিমু। তিনি অপেক্ষাকৃত গম্ভীর, মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন না আমি মসজিদে নামাজ পরে আসতেছি। রফিয়ার মনে সংশয় আব্বা হটাৎ এতো গম্ভীর!! আসরের পরপর তার স্বামী কে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাদের একটা জায়গা দেখতে যেটা কিছুদিন আগেই তার স্বামী নূরুল ইসলাম বায়না করছে। দুজন যখন বেড়হয় তখন রফিয়ার বেশ আনন্দই লাগছিলো এক স্থায়িত্বের প্রশান্তি তার চেহারায়, নিজের একটা বসতি একান্তই নিজের। কত শত স্বপ্ন এসে ভিড় করে তার চোখে।
কিন্তু ফিরে এসে আব্বা ভাব গতিক সুবিধার ঠেকতেছেনা। কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে ডাল বাগার দিয়ে চায়ের পানি বসায়, তার স্বামীও আব্বার সাথে ফিরে নাই এটাও আশ্চর্য লাগতেছে। আবার কোনো ঝামেলা হয় নাইতো? মনের মধ্যে এক উৎকন্ঠা, দুইজনের কাউরেই কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না। দুইজনই বেশ রাগী মানুষ। রফিয়া উৎকন্ঠিত মনে অপেক্ষা তারা কিছু বলে কিনা।
নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে চা দিতে বললেন ওয়াহাব সাহেব, মেয়ের হাতের চা টা তিনি বেশ উপভোগই করেন, রফিয়া সুন্দর করে চায়ের সাথে তার আনা বিস্কুট থেকে দুইটি টোস্ট পিরিচের কোনায় দেয় সাথে এক গ্লাস পানি। তিনি হাত বাড়িয়ে আগে পানিটা নেন এক ডোকে শেষ করেন বিস্কুট টা হাতে নিয়ে বলেন এগুলা তুমগো লাইগ্যা আনছি আবার আমারে দিলা কেন? হাইন আফনে আমরারতো আছোই। আগের ফিল্লা যেইডি আনছেন হেইডিত্তো শেষ হইছেনা। জামাই আমারে যাত্রাবাড়ী নামায়া দিয়া কইলো আফনে বাসাত যান আমি ইট্টু মফিজের এহানতে হইয়া আসি। রফিয়া কইলো হো এই একজনইতো, গেলে হের ঐহানেই যায়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চায় কিছু বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ প্রশ্ন করে জামাইয়ের সবকিছু ঠিকঠাক চলতাছেতো?? রফিয়া অবাক, হো আব্বা সবইতো ঠিকঠাক কোনো কিছু হইলেতো কইতো, লোকটা হুটহাট চেইত্যা যায় কিন্তু কিছু হইলে আগে আমারেই কয়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলোনা। তিনি গায়ের পান্জাবিটা ছেড়ে বিছানায় শরীরটা ইকটু এলিয়ে দিলেন। কখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল করেননি। মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আব্বা আফনের কি শরীরটা খারাপ? ওয়াহাব সাহেব নিজেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন অসময়ে ঘুমিয়ে পরায়। হেসে বললেন নারে বেডি কহন যে চোখডা লাইগ্যা গেলো টের ফাইছিনা।
উউট্টা এশার নামাজটা পড়েন আমি ভাত বাড়তাছি। জামাই আইছে?? আইয়া পরবো আফনে নামাজ শেষে হাইয়া লোন। রফিয়ার মনে আরো সংশয় নিশ্চয়ই কিছু হইছে নইলে এতোক্ষনেতো লোকটা চইলা আসার কথা। খাবার সময়ই জিগাইতে হইবো আব্বারে কিছু হইছে নি। ওয়াহাব সাহেব নামাজ শেষে দেখেন মেয়ে শীতল পাটিতে খাবার বিছায়া রাখছে অনেক আয়োজন সাথে তার পছন্দের সজনে ডালও আছে। আলহামদুলিল্লাহ এতকিছু? সব তুই করছোস?? মেয়ে হাসে ইকটু সাহস পায় আব্বা স্বাভাবিক হইতাছে। মেয়ে বাবার পাতে খাবার তুলে দেয় ওয়াহাব সাহেব খেতে খেতে রান্নার প্রসংশা করে রান্না ভাল হইছে, তোর মায়োর মত, রফিয়া মনে মনে হাসে, আব্বা নিজেও জানেনা তার মেয়ের জন্য মায়ো কি কি দিয়া দিছে। এগুলো তার মায়েরই রান্না সে শুধু ডাল পাকাইছে।
ওয়াহাব সাহেব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আইবো তোরা খাবিনা? হেয় আইলেই খামু আপনি খানতো, ওয়াহাব সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন, সুযোগ বুঝে রফিয়া প্রশ্ন করে আব্বা জায়গা যে দেখতে গেলেন, কেমুন দেখলেন? কিছুই দি কইলেন না?
ওয়াহাব সাহেব ইকটু থামলেন আবার ভাত মাখতে মাখতে বললেন জায়গায় তো যাইতারছিনা ঐহানে এহনো রাস্তা হইছেনা। এই ডেমরার এদিকেত্তে ত্রিমহনি একটা জায়গা ঐহানতে নুরুল ইসলাম আমারে আঙুল দা দেহাইলো উইযে দূরে আমগো জায়গাডা আব্বা। আমি ইকটু অবাক হইছি, টেহাদা কেউ বিল কিনেরে। পয়সাডি ফানিত ফালাইয়া আইসে। আমিতো হেরে ভালই জানতাম ফাগল টাগল হইয়া গেলোনি। রফিয়া এতক্ষণে বুঝলো আব্বা কেন এত গম্ভীর ছিলেন। বাবা-মেয়ে কেউ তখনও জানেনা তাদের সেই বিলের আশপাশটা জুড়ে একদিন মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং থেকে শুরু মার্কেট সিনেমা হল সবই গড়ে উঠবে। সেই সাথে নিজেদের একটা চারতলা বাড়ী।
তখন
সাল ১৯৬৪.
রফিয়ার বিয়ের মেহেদী না শুকাতে ই একটা দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।
নুরুল ইসলাম এর টিবি হয়েছে!
লোকে বলে যক্ষা, হইলে নাই রক্ষা! একেমন কিথা! রফিয়া মাত্র ফিরা যাত্রায় এসেছে বিয়ের পর।এই সময়ে এমন বিপদ। আবদুল ওহাব মেয়ের জামাই এর এই সংবাদ পেয়ে প্রানের ধন, কলিজার টুকরো মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছেন! নুরুল ইসলাম কে বিবাড়িয়া মেড্ডা হাস্পাতালে ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু পিতার প্রাণ তার মেয়েকে হাস্পাতালে যেতে দিতে চান না! লোকজ বিশ্বাস, যক্ষা হইলে....
মেয়ের শশুর বাড়ি থেকে কয়েক বার খবর পাঠানোর পরও আব্দুল ওহাব মেয়েকে যেতে দেননি।
মাইয়ো,কি করতাম,তোমরার জামাই রে তো দেখতে যাওন দরকার! " রফিয়া তার
মা'কে জিজ্ঞেস করে। "আব্বা তো যাইত দিতাছে না!"
তোর জামাই তুই বুঝবি!"মা ঠাট্টা করেন।
মাইয়ো! " রফিয়া প্রায় কেদে দেয়! " কি করতাম কও না।"
কি করবি আর! তোর বাপের কথা শুনলে চলত না। তুই ওদুদ রে লইয়া হাস্পাতাল যা। "
….
রফিয়া ছোট ভাই ওদুদ কে নিয়ে ভিতু পায়ে মেড্ডা হাস্পাতালে ঢুকে। মনে ভয় যদি কেঊ দেখে আব্বাকে বলে!
নুরুল ইসলাম মন খারাপ করে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। ওদুদ এর সাথে রফিয়া কে দেখে তার মনটা অভিমানে ভরে উঠে!
আসছেন, লাট সাহেবের বেটি!
মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
লম্বা ঘোমটা দিয়ে রফিয়া স্বামির পাশে গিয়ে বসে।
মাইয়ো টিফিনকারিতে গাজরের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছেন। ওদুদ টিফিনকারি বিছানার রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যায়,"আফা আমি গেইডো আছি,তুমি যাওয়ার সম ডাক দিও"
নুরুল ইসলামের দিকে চেয়ে রফিয়ার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে!
একি হাল হয়েছে উনার!
বিয়ের সময় সবাই বলাবলি করেছে - বরের স্বাস্থ্য কত সুন্দর! ব্যায়াম বীর!
সেই স্বাস্থ্য এখন কি হইছে!
রফিয়া ঘোমটার ভেতর কাদতে থাকে। রফিয়ার কান্না দেখে নুরুল ইসলাম ও ঠুকরে কেদে দেন।
স্বামী স্ত্রী নিরবে কিছুক্ষন কাদে।
"কি হইল আমার কওত রফিয়া। " নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে।
আমি কি বাছতাম না!"
স্বামীর প্রশ্ন শুনে রফিয়ার বুক ফেটে যায়।
নিরবে টিফিনকারি থেকে হালুয়া বের করে স্বামীকে তুলে দেয়।
মনে মনে দোয়া করে- আল্লাহ তুমি উনারে বাচাও! মাবুদ তুমি উনারে বাচাও!
তখন
যক্ষা হইলে নাই রক্ষা - প্রবাদ কে ভুল প্রমাণ করে আল্লাহর অশেষ রহমতে নুরুল ইসলাম দুই সপ্তাহের মধ্যেই আপাত সুস্থ হয়ে উঠলেন, তার শরীর সুস্থ হয়ে উঠলেও কিছু জীবানু থেকে যায়, যা ধরা পরবে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর! সেটা অন্য গল্প, পরবর্তীতে বলা হবে।
নুরুল ইসলাম ময়দাগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে মনমরা হয়ে বসে, পাশে তার ভাতিজা নান্নু মিয়া। বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুজনে সুখ দুখের সাথি।
লঞ্চ ঘাটের ডিম ওয়ালা আওয়াজ দেয়- ডিম, বল ডিম!
নান্নু মিয়া জিগ্যেস করে - "কাহা, বইদা হাইবা (খাইবা)?
নুরুল ইসলাম মাথা নারে।
"হাউ একটা, সইলো জুর ফাইবা!"
"নাহ, চা পাইলে খাইতাম" নুরুল ইসলাম দীর্ঘশাস ফেলেন।
রফিয়ার কথা মনে পরে! লাটসায়েব এর বেটি হাস্পাতালে চা নিয়া আসত তার জন্য!তিনি রাগ করে বলতেন - তোমার আব্বার হোটেলের চা খাইতাম না! "
"হোটেলের চা না, আমি নিজে রানছি!খাইন! "রফিয়া বলত।
রফিয়ার জন্য বড় মায়া লাগে! নুরুল ইসলাম এর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে।
"কাহা, চাচির লেইগ্যা পেট পুরে নি, কান্দ কেরে? "
নান্নু চাচাকে সান্ত্বনা দেয়।
" বইদা হাউ একটা। "
"তুই খা, এক কাপ চা হইলে খাইতাম! "
"তুমার হালি চা আর চা, ঢাহা গিয়া তুমার অব্বাস হারাপ হইছে।"
দুর্বল শরীর নিয়ে নুরুল মুচকি হাসে,কথা সত্যি।
"দেখ, চা পাছ নি।"
"তুমি বও ইহানো, আমি চা আনতাছি" নান্নু মিয়া চায়ের খোঁজে বেরিয়ে যায়।
নুরুল ইসলাম একা বসে রফিয়ার কথা ভাবে, আল্লাহ ই জানেন, রফিয়ার সাথে তার বিবাহিত জীবনের ভবিষ্যৎ কি! ভাব নমুনা ভালো না। তুন্দুল হুজুরের নিয়ত ভালো মনে হইতাছে না! পাগল বেটা মেয়েরে আর শশুর বাড়ি পাঠাইতে চায় না। একবার হাসপাতালে মেয়ে জামাইরে দেখতেও আইলো না! কেমন পাষাণ!
" এই লও তুমার চা!" নান্নুর কথায় নুরুর ধ্যান ভাংগে।
"তাগদা হাও (খাও), লঞ্চ আইতাছে! "
চা মুখে দিয়ে নুরুর আবার রফিয়ার কথা মনে পরে!
বার বার তার সুন্দর মুখটা চোখে ভাসে!
কিছুক্ষন পর লঞ্চ আসলে দুজনে গিয়ে উঠেন, গন্তব্য নবিনগর, সেখান থেকে নৌকায় বিটঘর,তারপর হেটে গুরিগাও।
বেলা দুপুর। কড়া রোদে নদীর পানি চিক চিক করছে। লঞ্চ ছারে সারেং। ধীরে ধীরে ময়দা গঞ্জ লঞ্চঘাট দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে নুরুল অনুচ্চ সরে বলেন - হে আল্লাহ তুমি রফিয়ারে ভালো রাইখো!"
বিদায়রত ব্রাহ্মণ্ বাড়িয়ার দিকে তাকিয়ে নুরুল ইসলাম কঠিন এক শপথ নেয়, সে
আর কখনও শশুর বাড়ি যাবে না!
তখন
কুদ্দুস মাস্টার কান্দির পাড় রুটিঘর হোটেলের সামনে এসে দাড়ান। মনে ভয়, তুন্দুল হুজুর জানি কি কয়!
যে মেজাজি মানুষ! যথারীতি
হোটেলে কাস্টমার এর ভীড়।
এই রুটি ঘর বিবাড়িয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় হোটেল।
আব ওহাব এই হোটেলে বিবাড়িয়ায় প্রথম তুন্দুল রুটি তৈরী করেন! রুটি ঘর এর গরম গরম তুন্দুলরুটি এত জনপ্রিয়তা পায় যে সবাই আ ওহাব সাহেব কে তুন্দুল হুজুর ডাকতে শুরু করেন!
তুন্দুল হুজুর কাউন্টার এ বসে!
সালাম দিয়ে পাশে গিয়ে দাড়ালেন কুদ্দুস মাস্টার।
মামার সইলডা ভালো নি?
" হ, সইল ভালো, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন পর আসলা? "
ইস্কুলো পরীক্ষা চলতাছে, একটু ব্যস্ততা যাইতাছে, মামা।"
হুম, বস, এই মাসটররে সরের চা দে, লগে মিস্টি সিংগাড়া দিস।"
"মামা, সিংগাড়া খাইতাম না, খালি চা দিত কন।"
"না কইর না, মাত্র নামাইছে কড়াই থেইকা। খাও। আর বাইম মাছ রানছে, ভাত খাইয়া যাইবা।"
তুন্দুল হুজুরের কথার উপর কিছু বলার নাই!
মামা, একটা কথা কইতাম আইছি। "
বও, টেবিলে, আমি ক্যাশ সামলাইয়া আসতাছি।"
কিছুক্ষণ পর আবদুল ওহাব এসে কুদ্দুস মাস্টার এর পাশে বসেন।
"কও, কি কইবা।"
"মামা, চলেন কেবিনে গিয়া বসি" মাস্টার বিনীত ভাবে প্রস্তাব দেন।
আবদুল ওহাব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন- সব খবর ভালো নি।"
খবর ভালো মামা, একটু জরুরি আলাপ আছিল।"
পাশেই তিনটা ফ্যামিলি কেবিন, পরদা ডাকা।
ভেতরে বসে কুদ্দুস মাস্টার ইতস্তত করেন।
কি কোন সমস্যা? " তুন্দুল হুজুর আবার জিজ্ঞেস করেন।
"মামা, রফিয়ার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়া আসছি!"
কুদ্দুস মাস্টার এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন।
কথা শুনে তুন্দুল হুজুর চমকে উঠেন!
বকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে!
কলিজার টুকরা রফিয়ার বিয়ার প্রস্তাব!
দীর্ঘ শাস ফেলে নিজেকে সামলান।
মেয়ে বড় হইছে, বিয়ে তো দিতেই হবে! চিরকাল তো আর আগলে রাখা যাবেনা।
" ছেলে ভালো, ঢাকা একটা অসুদ কম্পানিতে চাকরি করে" কুদ্দুস মাস্টার ভয়ে ভয়ে বলেন। তিনি জানেন, রফিয়া মামুর জানের টুকরা!
"বাড়ি গুরিগাও। "
দুজনে এরপর রফিয়ার বিয়ের আলাপে ব্যস্ত হয়ে যায়। কুদ্দুস মাস্টার প্রস্তাব আনছে, এরপর আর কি কথা চলে!
এদিকে রফিয়া আব্বাস ভাইয়ের সাথে স্কুল থেকে ঘরে ফিরেছে।
রফিয়া জানেনা আজই তার শেষ স্কুল যাওয়া।
আর কোন দিন সে স্কুলে পড়তে যাবে না!
তখন
রফিয়া ত জামাই বেভাইরাত সইল মাছ আনছে!" মঞ্জু হাসতে হাসতে বলে।
রফিয়া চোখ বড় করে তাকায়।
মঞ্জু আর রোকেয়া হেসে গড়িয়ে পরে একজন আরেকজনের উপর।
আজ রফিয়ার বিয়ে!
মঞ্জু আর রোকেয়া প্রিয় বান্ধবী! একটার পর একটা খবর এনে দিচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। এ পর্যন্ত পাওয়া সব খবর ই খারাপ!
বর যাত্রী আসার কথা ছিল দেড়শ, আসছে পয়ত্রিশ জন।
সবাই বলাবলি করছ- বরপক্ষ কিপটা, খরচ বাচাতে এই আকাম করছে!
আব্দুল ওহাব এর সংসারে আজ প্রথম বিয়ে!
তার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার বিয়ে!
কত সাজ গোস, কত আয়োজন! আসেপাশের তিন বাড়ি ঘীরে পেন্ডেল করেছেন আব্দুল ওহাব! লাইটিং, এমনকি ডেকোরেটারে বড় পেন্ডেল ছিল্মা বলে তিনি টেইলার থেকে অর্ডার দিয়ে সিলাই করেছেন! বরপক্ষ সব কিছুর মধ্যে পানি ঢেলে দিল!
রাহে আব্দুল ওহাব এর শরীর ফেটে যাওয়ার দশা!
বার বার ঘরের ভিতর বাহির করছেন আর বলছেন - জোহরা দেখলা কত বড় বেজ্জতি!"
জোহরা স্বামীর মেজাজ জানেন, সান্তনা দেয়ার জন্য বলেন - আফনে ইহানো বইয়া ইকটু জিরাইন না! বাকি সব আবরু আওয়াল আর আলিম দেখব!"
হুম,পুলাপান দিয়া কোন কাম হয়?"
" হইব, আফনে চিন্তা কইরেন না, কুস্তা অইতো না, আল্লাহ পাক সব ঠিক কইরা দিব, আমরার রফিয়া বড় ভালো মাইয়া" জোহরার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। তিনি মুখ অন্যদিকে ফেরান।
তিনি জানেন স্বামীর মনে আরোও বেশি কষ্ট!
রফিয়া তার কলিজার টুকরো।
পিতলের গ্লাসে পানি এগিয়ে দেন স্বামীকে। মাটির কলসের ঠান্ডা পানি!
পানি খেতে খেতে আব্দুল ওহাব বির বির করেন- কুদ্দুস আমার কি সর্ধনাস করল!"
দীর্ঘ শাস ফেলেন- আমার রফিয়ার কফালো কি আছে আল্লাহ জানে!"
এদিকে পাশের ঘরে রোকেয়া বলছে- রফিয়া, অদুদ কইছে তোর জামাইর বলে মাথা ছুডু!"
রফিয়া ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকে, চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পরে!
মঞ্জু রোকেয়াকে ইশারা দেয়, রফিয়া কান্তাছে! চুপ কর!
মঞ্জু রফিয়ার কাধে হাত রাখে, রফিয়া ঠুকরে কেদে উঠে!
"আরে বিহুব, আমরা দ ঠিশারা করছি " রোকেয়া সান্তনা দেয়।
আমি চুফি দিয়া দেখছি, তর জামাই দেখতে সুন্দর! চুল বেশি ছুঢু কইরা কাটছে দেইখা মাথা ছুডু লাগে।"
মঞ্জু চোখ গরম করে তাকায় রোকেয়ার দিকে।
রোকেয়া জিভে কামড় দেয়!
তারাতাড়ি বলে- রফিয়া, তর কফাল কত বালা, আলিম কইছে দুইশ তিপ্পান্নডা পিতলের কলশি উপহার আইছে!"
রফিয়া ঘোমটার ভেতর হেসে ফেলে!
মঞ্জু গুনগুন করে গায়- পিতলের ঘোড়া, পিতলের ঘোড়া....
তখন
আজ রবিবার, অফিস ছুটির দিন।
রাত নয়টা। বি টিভিতে সাপ্তাহিক নাটক দেখছে বাচ্চারা। নুরুল ইসলাম কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে চা খাচ্ছেন। বড় ছেলে জহির হঠাৎ নাটকের মধ্যে একটা হিন্দি গান শুনে নুরুল ইসলাম কে জিজ্ঞেস করল - "আব্বা, আপনে ত হিন্দি উরদু ভাষা জানেন? পাকিস্তান পিরিয়ডে ত উরদু বলতে হইত, তাই না! "
জহিরের প্রশ্ন শুনে বাবা মুচকি হাসেন।
ভাইবোন সবাই আব্বার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকায়।
চায়ে চুমুক দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন - "আসলে আমরা উর্দু এতটা বলতাম না, সব সময় বাংলা ই বলছি, ইস্কুলে আমরারে উর্দু শিখাইছে, কিন্তু চরচা নাই দেইখা ভুইলা গেছি!"
সুরাইয়া আবদার করে - আব্বা একটু উর্দু কন ত শুনি! "
নুরুল ইসলাম তার ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে! দেখতে দেখতে ছেলে মেয়ে গুলো বড় হয়ে যাচ্ছে!
মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে হইল জহির, চার কি সারে তিন বছর পর সুরাইয়া, এরপর দিলু মনির, মনে হয় এইত সেদিন! কিন্তু মাশাল্লাহ ছেলে মেয়ে গুলো তর তর করে বড় হয়ে গেলো, জহির এখন সিক্সে পড়ে!
"আব্বা, কন না " সুরাইয়া আবার বলে।
ইইতিমধ্যে রফিয়া রান্নাঘর সামলে ঘরে ঢোকেন।
তারও চোখে কৌতুহল।
নুরুল ইসলাম মুচকি হেসে বলেন - উর্দু না হিন্দি জানিনা, ছোট বেলায় একটা গল্প শুনছিলাম, সেইটা বলি শুন।"
ছেলেমেয়েরা টিভি বন্ধ করে নরে চরে বসে।
"তোদের দাদার কাছে শুনা" বহু বছর পর নুরুল ইসলাম এর বাবার চেহারাটা মনে ভাসে!
একদেশে এক রাজা আছিল, বিরাট রাজত্ব। একদিন রাজা তার পাক্কসিরে জিগায় - শুনছি, আমার রাজত্যে একটা গ্রামের মানুষ কুইচ্চা খায়?"
পাক্কসি কয়, হ খায়। রাজা শুইন্না কয় তুমি পাক করতে পারবা? খাইয়া দেখি কেমন।"
কেচোর কথা শুনে বাচ্চারা অবাক হয়ে যায়। আব্বারে উর্দু বলতে গিয়ে একি হচ্চে!
জহির রফিয়ার দিকে তাকায়।
রফিয়া মাথা নেরে ইশারা দেয়- আসতাছে...
ছোট মেয়ে দিলু জিজ্ঞেস করে, "আব্বা হিন্দিতে কননা কেন?"
নুরুল ইসলাম হেসে বলেন - ত রাজা পাক্কসিরে কইছে, তুমি রান্দ। পাক্কসি রান্দছে ঠিক ই কিন্তু একটা সমস্যা হইয়া গেলগা।"
সবাই নুরুল ইসলাম এর দিকে তাকিয়ে।
"রাইন্দা সাইরা বাবরচি গেসে গুসল করতে, আইসা দেখে তরকারি বিলাই খাইয়া ফালাইছে! এখন কি হইব! রাজা দরবারে বসছে, একটু পরে ই খাইতে আসবো, কি করন যায়! চিন্তায় বাবুর্চির অবস্থা খারাপ। দরবারে উজিরনাজির এর সামনে কুইচ্চা কথা কেমনে কয়!
একটা বুদ্ধি পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া দরবারে ঢুকছে।
" হুজুর জাহাপনা,আপকা কুচিয়া পারা থানা ত লুটলিয়া।"
রাজা ত বুঝছে বেটায় কি কয়, পুরা দরবারের লোক চিন্তা করতাছে, কুচিয়া পারা থানা আবার কুনডা,কে আবার লুটপাট করল!
রাজা ত বুঝছে, জিগায়- কোউন"
"হুজুর বিল্লাল খান।" রাজা ঠিকই বুঝছে বিলাই খাইয়া ফালাইছে। জিগায় -
"সরবুদ্দি কাহা থা?" মানে সরা (ঢাকনা) কই!
"ও ত পহেলা থাপ্পড় মেই গিরগিয়া! "
রাজা আবার জিগায় - গদবুদ্দি (গদা, লাঠি জাতীয়) কাহা থা! "
বাবুর্চি চিন্তা করে লাঠি নিয়া ত আমি পাহারা দেই নাই,তাইলে ত চাকরি থাকত না, বুদ্ধি কইরা কয় - ও তো জংগল বাড়ি থা!"
" হুম, আউর কোউন কোউন বাকি হেয়? "
রাজা জানত চায়, পুরা তরকারি ই গেছে না কিছু বাচছে, বেডা সখ করছিল খাইব!
বাবুর্চি কয় - আওর শিরবুদ্দি আর লিজবুদ্দি।"
রাজা বুঝছে কুইচ্চার লেজ মাথা আছে!
একটু চিন্তা কইরা কয় - ওদোন কো বেগুন বাড়ি ভেজ দো।"
বাবুর্চি গিয়া বাকি যেই কুইচ্চা বাচছিল, সেগুলা বেগুন দিয়া ভুনা কইরা রাখে রাজার লেইগা!
এদিকে দরবারের উজির নাজির মনে মনে কয় বিল্লাল খা না জানি কত বড় পালোয়ান! হা হা হা
কখন
৪৭৫ দক্ষিণ গোরান, ঢাকা - ১৩১৯.
লোকে বলে বিপদ আসলে সাথে দলবল নিয়ে আসে। আজ সে-ই রকম দিন। বিকেলে আসরের নামাজের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফোন এল,জহিরের বড় মামা আব্দুল আউয়াল আর নেই।
কিছুক্ষন পুর্বে হার্ট অ্যাটাক হ'য়ে মারা গেছে!
দ্রুত সবাই কে ফোন করে একত্রিত করতে বেশি সময় না লাগলেও, মাইক্রো ভাড়া করে রওনা হতে হতে প্রায় ছয়টা বেজে যায়।
মাইক্রোতে যাত্রী বলতে - রফিয়া আর তার ছোট বোন অনু ও জহির, তার বউ পারভিন, সুরাইয়া, দিলু..…
আশুগঞ্জ ফেরিঘাটে পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়নি। লম্বা সিরিয়াল, ফেরি পার হতে সময় লাগবে।
কিন্তু নতুন বিপদ আসল অন্যদিক থেকে।
নুরুল ইসলাম এখন প্রবীন, শারীরিক ভাবে সম্পুর্ণ সুস্থ হলেও প্রস্রাব পেলে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেন না।
"জহির,বাবা আমার একটু টয়লেটে যাইতে হবে, এদিকে কোন ব্যবস্থা আছে কি? "
"ফেরিঘাটে আর কেমন ব্যবস্থা থাকবো, চলেন দেখি, আমি আপনের সাথে যাই।"
বাবা ও ছেলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাংগে প্রথমে। ডানে বায়ে তাকিয়ে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করে সামনে খাবার হোটেল গুলোর পেছনে যায়।
সামনে নালা। ছালার বেড়া দিয়ে কয়েকটা টয়লেট তৈরি করা আছে!
নুরুল ইসলাম এগিয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার, ভালো দেখা যায় না।
জহির আউয়াজ দেয় - আব্বা কোন সমস্যা নাই ত!"
" না, তুমি গাড়িত যাও। আমি আইতাছি।"
জহিরের উচিত ছিল, অপেক্ষা করা, কিন্তু তার ও সিগারেট খাওয়ার প্রয়োজন, তাই আর দিমত না করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একটা বেনসন ধরিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দেয়। বড়মামা আউয়াল এর সুন্দর চেহারাটা মনে পরে জহিরের । তিন মামা, সবাই দেখতে সুন্দর, কিন্তু বড় মামার চেহারা ইরানিদের মত!
এইত মাত্র কয়দিন আগে জহির বন্ধু বান্ধব নিয়ে নানা বেড়িয়ে গেল, তখন তো মামা পুরা সুস্থ। মামার অবশ্য হার্টের সমস্যা ছিল।
আসলে মানুষের কখন কি হয়ে যায় বলা মুসকিল!
বিশেষ করে মৃত্যু! জহির দার্শনিকের মত ভাবে।
সিগারেট ফেলে জহির গিয়ে মাইক্রোতে বসে।
রফিয়া আর অনু দুজনের চোখেই অশ্রু। ভাইকে নিয়ে কত সৃতি, কত কথা যে মনে পরছে! মুক্তি যুদ্ধের সময় ভাইটা কত কষ্ট করে রফিয়ার শশুর বাড়ি গিয়েছিল, শুধু বোনটা এই গন্ডগোলের সময় কেমন আছে জানার জন্য! চানপুর থেকে গুরিগাও যেতে আসতে লেগেছিল সাত দিন! পথে শুধু চিড়া আর সাতু খাওয়া! এমন কি একদিন নাকি ক্ষেতের কাচা সব্জি ডাল ও খেয়েছে ভাইটা!
আউয়াল মুক্তি যুদ্ধের সময় অনেক করেছে! একবার তো মিলিটারিরা ধইরাও নিয়া গেছিল! আব্বা কত দৌড়াদৌড়ি কইরা ছুটাইয়া আনছিল!
সেই ভাইটা আর নাই।
"তোর আব্বারে সাথে নিয়া আসলি না?"
জহিরকে দেখে রফিয়া জিগ্যেস করেন।
"আব্বাই আমারে গাড়িতে বসতে বলছে।"
এখান থেকে শুরু হয় নতুন বিপদ!
দশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও নুরুল ইসলাম এর খবর নাই, কি হইল!
"দেখত তোর আব্বা এত দেরি করতাছে কেন?"
জহির আবার গাড়ি থেকে বেরয়।মনে মনে বিরক্ত, আব্বা যে কি করে মাঝে মাঝে!
টয়লেট গুলোর কাছে গিয়ে আওয়াজ দেয়- আব্বা, কি হইল,এত দেরি কেন?"
কোন উত্তর নাই!
কয়েক বার ডেকেও কোন সারা না পেয়ে জহির আসে পাশে কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে। লোকজন মন্তব্য করে - মুরুব্বি মানুষ, একা রাইখা কেউ যায়!
দেখেন, হয়ত নামাজ পড়তে মসজিদে গেছে!
ফেরির এপারের সকল মসজিদে খোঁজ নিয়েও আব্বাকে খুঁজে পায়না জহির!
এদিকে ফেরির সিরিয়াল এসে গেছে!
জহিরের ভয় হয়- আব্বা নালায় পরে যায় নাই তো!
আসে পাশের দোকান থেকে চারজ লাইট নিয়ে টয়লেট গুলোর চারিদিকে ভালো ভাবে দেখা হয়, কোথাও নুরুল ইসলাম নেই।
দুশ্চিন্তায় জহিরের মাথা খারাপ হওয়ার দশা।
পর পর দুইটা ফেরি মিস করার পর, ড্রাইভার বলল- ভাই, খালুজান অই পাড়ে চইলা যায় নাই ত!"
গাড়ির সবাই বিরক্ত, বার বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফোন আসতেছে, আপনারা কতদুর?
সিদ্ধান্ত হল,ফেরিতে উঠা যাক, অই পাড়ে গিয়ে তারপর কি করা যায় পরামর্শ হবে।
পারভিন জহির কে প্রশ্ন করে- তুমি আব্বারে একা রাইখা আসলা কেমনে? "
জহির বিরক্ত হয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। এমনি মাথার ঘায়ে কুত্তা সামলা অবস্থা, তার উপর আবার বউয়ের খোচা!
কিছু না বলে জহির দীর্ঘ শাস ফেলে।
ফেরিতে ওঠার পরে জহির গাড়ি থেকে নেমে যায়!
নিজের উপর ই বিরক্ত, কেন আব্বাকে একা রেখে আসলাম!
আকাশে পুর্নিমার চাঁদ। রাতের আঁধারে নদীর পানিতে চাঁদের আলোর ঝিলিক! সময় ভালো থাকলে উপভোগ করা যেত, জহির আবার একটা দীর্ঘ শাস ছারে।
গম্ভির মুখে ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে ফেরী এগিয়ে যায়, জহিরের মনে হয় ফেরী এত আস্তে চলে কেন?
জহির আল্লাহকে ডাকে, ইয়া আল্লাহ আব্বার কি হইল! তুমি তারে নিরাপদ রাইখ।
নদীর ওপার নজরে আসছে।
হঠাৎ জহির, হার্টবিট মিস করে!
আরি! আব্বা না! অই দেখা যায় ফেরীর দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক হয়ে!
খুশিতে জহিরের চোখে পানি এসে যায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
দৌড়ে গাড়ির কাছে যায়,আব্বা ঠিক আছে, ঐপাড়ে দাড়াইয়া আছে! "
ফেরী থামার আগেই জহির চিৎকার করে নুরুল ইসলাম এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
নুরুল ইসলাম চরম বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠে!
" দুই ঘন্টা ধইরা দাড়াইয়া রইছি এই পাড়ে, তরা এত দেরি করলি!"
গাড়ির যাত্রী সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকায়।
উল্টা চোর কতোয়াল কো ডাটে!
[7/15, 3:18 PM] Md. Zohirul Islam: কখন... রফিয়া চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন - তুমি কুন আক্কেলে এই পাড়ে আসছ? "
নুরুল ইসলাম এর বিরক্তি আরও বাড়ে। রাগে মুখ থমথমে। নাক দিয়ে গরম সাস ফেলেন। ফুসস....
"আমরা দুই ঘন্টা ধইরা তুমারে খুজতে খুজতে হয়রান, ঐ দিকে বিবাড়িয়া থেইকা একটার পর ফোন আইতাছে, কতগুলা লোক অপেক্ষা করতাছে, আর তুমি এই পাড়ে আইসা বইসা রইস!"
রফিয়া র আক্ষেপ কমে না।
পারভিন পাশ থেকে বলে - আম্মা বাদ দেন, আব্বারে যে খুইজা পাইছি এইটাই একটা বিরাট শুকরিয়া। ড্রাইভার ভাই, গাড়ি ছারেন, অনেক দেরি হইয়া গেছে। "
পারভিনের কথা শুনে নুরুল ইসলাম একটু লজ্জিত হয়।
" হে হে, আসলে হইছে কি, পেশাপ কইরা আমি ভাবলাম, এশার অক্ত হইছে, নমাজ টা পইরা লাই। এই চিন্তা কইরা মসিদো ঢুইকা অজু কইরা নমাজ পরছি, তারপর একটা ফেরীতে উইঠ্যা এ-ই পাড়ে চইলা আসছি, ভাবলাম, তুমরা ত আসবাই।হে হে। "
"তুমারে কত বার বলছি, সাথে মোবাইল রাখ, মোবাইল থাকলে আজকের দিনে কতটা সময় বাচত? " রফিয়া অনুযোগ করেন।
" আরে মোবাইল আমার উসফুস লাগে, ছাতাডা চালাইতাম পারিনা, রাইক্ষা লাভ কি! "
নুরুল ইসলাম এর সহজ উত্তর। কথা সত্য। মোবাইল ছেলে মেয়েরা কয়েক বার কিনে দিয়েছে, কিন্তু মোবাইল চালাতে উনার ভেজাল লাগে, উল্টা পাল্টা হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে মোবাইল ব্যবহার করাই বাদ দিয়েছেন!
মাইক্র দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়, যাত্রীদের মনে হয় তবুও যেন গতি কম!
রফিয়ার মোবাইল আবার বেজে ওঠে, অদুদ ফোন করছে-আফা আপনারা এখন কোথায়!
রফিয়া ফোন জহিরের দিকে এগিয়ে দেয়।
"মামা, আমরা আশুগঞ্জ পার হইতাছি, একটা সমস্যা হইছিল, আইসা বলতাছি।আপনাদের ঐদিকে কি অবস্থা।"
" বাবা, আমরা ত তোমাদের অপেক্ষায় পৌরসভা অফিসে দাড়াইয়া রইছি। ইহানদা জানাজা ফানাজা সব শেষ, তুমরা আসলেই আমরা কবরস্তান যামু।"
জহির বলে - মামা আর একটু অপেক্ষা করেন, আমরা সরাসরি পৌরসভায় আসতেছি। "
প্রায় ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাই ড্রাইভার ভাই, খালুর লেইগ্যা অনেক দেরি হইয়া গেল, তার আবার ঢাকা ফিরে এয়ারপোর্টে খেপ ধরতে হবে।
পোনে এক ঘন্টা পর গাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা অফিসের সামনে থামে। জহির তারাতাড়ি আম্মার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায়।
জেলা অফিসে র সামনে দুনিয়ার মানুষ!
এই পরিবার টি ধনী হয়ত না, কিন্ত বিবাড়িয়া শহরের সবচে চেনাজানা পরিবারের একটা!
নানা তন্দুল হুজুর বেচে থাকলে আজ এই পরিবার কি হত!
রফিয়া দৌড়ে ভাই এর কাছে ছুটে যেতে চায়। জহির সক্ত করে মা'কে এক হাতে ধরে রাখে।অন্য হাত দিয়ে কাধ জড়িয়ে ধরে।
সবাই সরে গিয়ে পথ করে দেয়। কেউ কেউ কৌতুহল নিয়ে তাকায়।
ঢাকা থেকে আউয়ালের বড় বইন আসছে!
আহারে, ভাইরে শেষ সময় এট্টু দেখতে ও পারলোনা ভইনাটা!
ছোট বোন অনু কে পাশে নিয়ে রফিয়া তার পিঠাপিঠি ছোট ভাইকে শেষ বারের মত দেখতে এগিয়ে যায়....
যখন
সাল ১৯৮২.
জহির দৌড়ে সাইফুর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না!
আদর্শ স্কুল এর সামনে থেকে শুরু হয়েছে দৌড়।
জহির এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। ওদের বাসার উল্টো দিকের আজিজ সাহেবের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। দুই ছেলে সাইফু আর পাপ্পু। বাবা হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স এর কর্মকর্তা। সাইফু আর পাপ্পু আসার পর জহির এর সারাদিন এর কর্ম সূচিতে এখন বিরাট উত্তেজনা! সাইফুরা আগে কলোনিতে ছিল। কলোনির সমবয়সীদের জীবন বড়ই আনন্দম্য! সাইফু ওদের কত কিছু শিখিয়েছে! বাঁশ দিয়ে চরকি বানানো (ইয়োইয়ো), রিং চালানো, টিলো এক্সপ্রেস খেলা! আরো কত কি। ওরা আসার আগে জহিরের দিন কাটত মেয়েদের সাথে কুতকুত আর পুতুল খেলে!আজিজ সাহেবের ছোট ছেলে
ফটিক সোহেল, সাইফু এর থেকে কত বিচিত্র খেলা শেখা যায়!
যেমন এখন এই রিং চালিয়ে মতির মাঠে যাওয়া! একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগিতা! কে কার আগে যেতে পারে! মতির মাঠ একটা আজব জায়গা! শুকনার সময় মতির মাঠ, বন্যার সময় মতির ঝিল!
রিং চালাতে ছেলেরা দৌড়াতে থাকে। আদর্শ স্কুল এর পেছনের রাস্তা দিয়ে নামা গোরান হয়ে মেরাদিয়া।কিছক্ষন আগে সাইফু হঠাৎ এসে বলে - ঐ চল মেরাদিয়া যাই, ঐখানে হেলিকপ্টার আইতাছে!
আল্লাহই জানে সাইফু ভাই এই সব খবর কইত্তে পায়- জহির ভাবে আর রিং চালাতে চালাতে দৌড়ায়। নতুন রিং চালানো শিখেছে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মজার ঠেলায় কষ্ট করা কোন ব্যাপার না। এই রিং বানাইতে ও কত উত্তেজনা! ঘরের পুরোন রড যোগাড় করা, আম্মার কাছ থেকে টাকা নেয়া! রিং ঝালাই করতে আট আনা লাগবে শুনে আম্মার ত মাথাই খারাপ হওয়ার দশা! তারপর ফটিক সাইফু সবাই মিলে বাসাবো বাজারে গিয়া রিং ঝালাই করা! দশ পয়সা দিয়া আইস্ক্রিম কিনে খাওয়া!
বিশ পয়সা দিয়া বাক্সের মধ্যে সিনামা দেখা, কত মজা!
সাইফু ভাই এক হাত তুলে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে- ঐ দেখ হেলিকপ্টার নামতাছে!"
ফটিক, জহির, বিদ্যুত, রাসেল আখের পাভেল নিটুল ভাই, মুকুল ভাই সবাই তাকিয়ে দেখে সত্যি হেলিকপ্টার নামছে! মেরাদিয়া হাটের একটু আগে খোলা ময়দানে তিনটা হেলিকপ্টার! হেলিকপ্টার এর পাখার বাতাসে আসে পাশে ধুলো উড়ছে!
সবাই রিং চালানো থামিয়ে অবাক হ'য়ে দুর থেকে হেলিকপ্টার দেখতে থাকে! যদিও পায় আধ মাইল দুর, তবু এত কাছ থেকে ওরা কেউ হেলিকপ্টার দেখেনি আগে!
সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে! ছেলেরা কেউ জানেনা আজ এই হেলিকপ্টার এখানে এসে অবতারণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা!
ইস্টার্ন হাউজিং এর মালিক মোঃ জহুরুল ইসলাম আজ কিছু সরকারি কর্মকর্তার সাথে এসেছে মতির মাঠ ও তার আসে পাশের এলাকা পরিদর্শনে!
ওরা কেউ জানেনা এরপর থেকে এই গোরান এলাকার চেহারা ই পাল্টে যাবে।
একদিন এখানে বনশ্রী আবাসিক এলাকা হবে!
যখন
জহির এখন ২য় শ্রেণির ছাত্র।
জানুয়ারী মাসের সকাল।
বাড়ির পেছনে হারুন ভাইদের আলগা জমিতে পাটি বিছিয়ে বাচ্চারা বসেছে। আল্গা জমি বলা হোলো এজন্য যে এই জমিটুকু আর হারুনদের মূল জমির মাঝ দিয়ে একটি সরু রাস্তা গিয়েছে!
নিলি আপা হাতে চিকন কাঠি নিয়ে একটা জলচৌকিতে বসেছে। সামনে পাটির মধ্য জহির, সুরাইয়া, নিলু আপার ছোট বোন শিল্পী, শিউলি, পাশের বাড়ির সোহেল আর তার ছোট বোন সপ্না বসা।
স্কুল শুরুর আগে স্কুল স্কুল খেলা! স্কুল নিয়ে এই এক মজার ব্যাপার - স্কুল স্কুল খেলতে ভালো লাগে, কিন্তু আসল স্কুল শুরু হলে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করেনা।
পেছনে শিউলি ফুলের গাছ, তা থে মাঝে মাঝে ফুল ঝরে পরছে!
নিলু আপা ধমক দেয় এই পড় সবাই - সাত একে সাত, সাত দুগনে চৌদ্দ। "
বাচ্চারা সবাই সমস্বরে উঠে - সাত একে সাত...
পড়তে পড়তে জহির আর সোহেল চোখের ইশারায় কথা বলে,আহারে নিলু আপা যদি জানতো!
আজই ভোর বেলা নিলু আপাদের বাগান থেকে ফুল চুরি করেছে দুইজন! শীতের ভোরে শিউলি গাছের তলায় সারা রাতের ঝরা ফুল জমে সাদা আর কমলা রং এর কার্পেটের মতো হয়ে থাকে!
যদিও নিলু আপার কড়া নিষেধ বাগান থেকে ফুল নেয়া যাবেনা!
কে শুনে কার কথা!
প্রায় আধ ঘন্টা পড়া লেখার পর জহির সুরাইয়া ঘর থেকে আনা মেরাপিঠা বের করে সবাইকে দেয়, সকলে মিলে খাওয়া ও খেলায় কাটে শীতের আয়েসি সকাল!
যখন
সন্ধ্যায় আম্মার সামনে বসে পড়াশোনা করছে জহির আর সুরাইয়া, পাশে দিলু বর্ণ পরিচয় শিখছে।
হঠাৎ শুরু হল ঝুম বৃষ্টি!
টিনের চালে বৃষ্টির ঝনঝন আওয়াজ হয়।
হাওয়ায় তেজ বাড়তে থাকে।
সুরাইয়া ভাইয়ের দিকে তাকায়।
জহির বই বন্ধ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেস্টা করে। রফিয়া একমনে কুশি কাটার কাজ করছে, মনে ভাবছে বৃষ্টি বাড়লে নুরুল ইসলাম এর বাসায় ফিরতে কষ্ট হবে!
বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে।
বৈশাখ মাস, কাল বৈশাখী ঝড়!
জহির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে - আম্মা পলিদের ঐ আম পরতাছে, কূড়াইতে যাই,ঝড়ের মইদ্যে আম পরতাছে!"
"মাইর খাবি, চুপচাপ পড়!"
রফিয়া ধমক দেয়।
"আম্মা, এট্টু যাই, দুইটা আম লইয়া চইলা আসুম - জহির অনুনয় করে।
" শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজলে সইল খারাপ হইব, দরকার নাই।"
"আম্মা! এট্টু যামু আর আসুম।"
"না, জর আসলে তোর আব্বা বকা দিব।"
এবার সুরাইয়া বলে - "আম্মা দেখ সব আম পলিরা লইয়া যাইবগা, আমরা খালি যামু আর আসমু, দেরি করমু না, আম্মা, যাই!"
ছোট্ট সোনা দিলুও নেরে চেরে বসে- আমিও যামু!"
হ,তুই ত যাবিই, আমরাই যাইতে পারতাছি না- জহির জবাব দেয়।
মুখ গোমড়া করে জহির আর সুরাইয়া বসে থাকে।
বাচ্চাদের মন খারাপ দেখে রফিয়ার ছোট বেলার স্মৃতি মনে পরে! তিনি ও তো ঝড়ের মধ্যে কত আম কুড়িয়েছেন, আলিম আওয়াল,আব্বাস ভাইকে নিয়ে!
"যা,কিন্তু দেরি করবি না,যাবি আর আসবি, ঠিক আছে!"
জহির আর সুরাইয়া লাফ দিয়ে উঠে বিছানা থেকে। দৌড়ে বেরিয়ে যায় দুই বাড়ি পর পলিদের আম বাগানে। ভাইবোন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পলিদের আম বাগানে ঢুকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে!
আয় হায়, ওদের আগেই জায়গা দখল হয়ে গেছে! শিল্পী, শিউলি এসে হাজির!
বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আম কুড়াতে থাকে।
জহির চিৎকার করে বলে - তোরা আইসছ কেমনে? "
শিল্পী বাকা উত্তর দেয়- ক্যান, খালি তোরাই আসতে পারছ, আমরা পারি না।"
বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে, আর বাচ্চারাও আম কুড়াতে থাকে। সময় বয়ে যায়, জহির সুরাইয়া ভুলে যায়, আম্মাকে বলে এসেছে, এই যাবে আর আসবে.....
এখন
২০০৩ সাল।
এপ্রিল মাসের রাত,জহির আজ সিএনজি নিয়ে বাড়ি ফিরছে!
সাধারণত রাত হলেও বাসে করেই বাসায় যায়। আজ মনের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না!
বস এসেছে দিল্লি থেকে কয়েক দিন আগে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছিল, আজ কনফার্ম হলো জহির। বস বলবন্ত সিং বলেছেন - জহিরকে অফিসের কাজে পাকিস্তান যেতে হবে!
যদিও পাশের দেশ, কিন্তু জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা!
উড়োজাহাজ ভ্রমণ! এয়ারপোর্টে যাওয়া!
সব মিলিয়ে জহিরের মনে এখন ভীষণ উত্তেজনা! কখন বাসায় পৌছাবে, কখন আব্বা আম্মাকে বলবে,কখন পারভিন কে বলবে!
জহির চেস্টা করে সব কিছু প্রথম বাবা মাকে বলতে,বিশেষ করে মা'কে। ছোট বেলা থেকেই মা'ই সব কিছুতে জহির কে প্রস্রয় দিয়েছেন, কত আবদার মা, বাবাকে না জানিয়ে পুরো করেছেন গুনে শেষ করা যাবে না!
ফেরার পথে খিলগাঁও রেলগেইট থেকে এক প্যাকেট মিস্টি কিনে নিল জহির।
ঘরে ঢুকে প্রথম পারভিনকে জিজ্ঞেস করল, আম্মা আব্বা ঘরে আছে?
পারভিন মাথা নেরে বলে, আছে, মনে মনে অবাক হয়, কি হলো আবার!
জহির ইশারায় পারভিন কে সাথে আসতে বলে বাবা মার ঘরে ঢুকে।
"আম্মা, আব্বা, একটা সুখবর আছে!" জহির নিজের খুশি ধরে রাখতে পারে না!
নুরুল ইসলাম রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে ছিলেন। ছেলের ডাক শুনে বিছানা থেকে উঠলেন।
কি হইছে বাবা, কি হইছে! "
"কিছু হয় নাই আব্বা, একটা সুখবর! আমারে অফিস থেকে বিদেশে পাঠাইতাছে!"
আনন্দে জহিরের চোখ মুখ উত্তেজিত!
রফিয়া, নুরুল ইসলাম ও পারভিন সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
বাঃ এইটাত খুবই ভালো খবর!" রফিয়া বলে।
"আলহামদুলিল্লাহ, বাবা, কোথায় পাঠাইতাছে, ইন্ডিয়া? " নুরুল ইসলাম জানতে চায়।
"নাহ, ইন্ডিয়া না, পাকিস্তান! একটা কম্পানিতে আমাদের সফটওয়্যার সেল হইব,সেটার ট্রেনিং দিতে আমারে যাইতে হবে!"
জহির নিচু হয়ে বাবা মাকে পা ছুয়ে ছালাম করে।
"বাবা,খুবই খুশির খবর, খুব খুশি হইলাম, আল্লাহ তুমারে সফল করুন, যাও ঘর গিয়ে হাত মুখ ধুইয়া খাওয়া দাওয়া করগা,যাও।"
নুরুল ইসলাম মন ভরে সন্তানকে দোয়া করেন, মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন।তার চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরে পড়ে!
নুরুল ইসলাম এর মনে সপ্ন ছিল - তার ছেলে জহির ডাক্তার হবে! কিন্তু ডাক্তার না হোক, ছেলে বড় মানুষ হয়েছ,জীবনে সফল হয়েছে, আল্লাহ করুন, ছেলে যেন দেশ বিদেশ করতে পারে তিনি আল্লাহর কাছে সে-ই দোয়া করেন!
সন্তানের জন্য বাবা মার দোয়া আল্লাহ তায়া’লা সব সময় ই কবুল করেন!
আমরা তা পরবর্তীতে জানতে পারব......
যখন
১৯৮৭ সাল।
মার্চ মাসের সকাল।
জহির বারান্দায় ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে।
আয়োজন সামান্য, সিদ্ধ রুটি আর ডিমের অমলেট। সবে নাস্তা মুখে তুলেছে এই সময় গেইটে নক করার শব্দ!
কে?
আমি সুভ্র"
সুভ্র জহিরের ক্লাস ফ্রেন্ড, ক্লাস সেভেন থেকে দুজন এক সাথে।
গেইট খুলে সুভ্রকে নিয়ে ডাইনিং এ বসল জহির।
" নাস্তা খাও।"
" না, আমি খাইয়া আসছি, তুমি খাও।"
আঃ সুভ্রূ রে খাবার সাধলে খায় না!
ঘটনা কি! জহির অবাক হয়।
বন্ধুদের মধ্যে সবচে রুচি বেশি সুভ্রর!
আরে খাও, ডিম ভাজতে বলতাছি আরেকটা, তুমি শুরু কর" জহির আবার সাধে।
না, আমি খামু না, তুমি নাস্তা কর" সুভ্রর জবাব।
নিশ্চয়ই কিছু হইছে!
রুটি মুখে দিয়ে জহির জিজ্ঞেস করে - কি হইছে কও ত?"
"শুনলাম, রেজাল্ট দিছে " সুভ্রর তড়িৎ জবাব।
আঃ
জহিরের গলায় রুটি আটকে যায়।
কো কি! সত্যি! "
হ, ভাইয়া বলল।"
মাথা চুলকাতে-চুলকাতে জহির একটা দীর্ঘশাস ফেলে।
গত তিন টা মাস কত আনন্দে কাটছে!
নানার বাড়ি,দাদার বাড়ি কত জায়গায় বেরানো!
রেজাল্ট এতো তারাতাড়ি দিয়া দিল!
আল্লাহই জানে কপালে কি আছে!
জহিরের গলা দিয়ে আর নাস্তা যায় না।
তাইলে এখন কি করতে হইব?
"চল দেখি, হেডুর বাসায় যাই।স্যার কি কয়" সুভ্র তার সাভাবিক শান্ত স্বরে বলে।
কোন মতে একটা রুটি শেষ করে, আম্মার কাছে যায় জহির।
"আম্মা, দোয়া কইরো, আজকে নাকি আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দিছে। "
রফিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলের মুখে দুশ্চিন্তা! বলেন- বাবা দরুদ শরিফ পড়তে পড়তে যা।তোর রেজাল্ট ভালো হইব, চিন্তা করিছ না।"
ঘর থেকে বেরিয়েই তিতু আর রাসেলের সাথে দেখা।
ওরাও রেজাল্ট এর খবর পেয়ে গেছে!
সবাই মিলে হেড স্যার এর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল।
এখন বাজে মাত্র দশটা, স্যার এখন বাসায় থাকবেন।
হেড স্যারের বাসা কাছেই, জহিরদের কয়েক বাড়ি পর।
দরজায় নক করতে স্যার ই দরজা খুললেন।
আসসালামু আলাইকুম স্যার।
"ওয়ালাইকুম আসসালাম, তোমরা!এই সময়! "
ছেলেরা মনে মনে বলে - স্যারের দেখি খবর ই নাই!
"স্যার, শুনছি আমাদের রেজাল্ট দিছে! "
"তাই নাকি! ভালো ই ত।"
হেড স্যার এর ভাব সাব হাস্পাতালের কর্মচারিদের মত, যেন রেজাল্ট দেয়া কোন ব্যাপার ই না।
ডাল ভাত!
এদিকে টেনশনে ছেলেদের অবস্থা খারাপ!
শুভ্র জিজ্ঞেস করে - স্যার, আমরা এখন কি করব,রেজাল্ট কখন আসবে স্কুলে? "
"আরে আমাদের মতো ছোটো স্কুলে কি আর সাথে সাথে রেজাল্ট আসে, তোমরা এক কাজ কর, সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলে চলে যাও, ঐখানে গেজেট বই আসে " স্যারের নির্লিপ্ত জবাব।
রাসেল আস্তে করে - স্যার যদি একটু ফোন কইরা দিতেন!"
হুম, তোমরা প্রথমে যাও, সমস্যা হইলে আমি ফোন দিবনে।"
ছেলেরা নিরবে প্রস্থান করে!
একটু দুরে এসে তিতু বলে - হেডুর ভাবটা দেখলি!"
আমগো রেজাল্ট নিয়া কোন আগ্রহ ই দেখাইল না!"
রাসেল অনুযোগ করে।
"স্যার এর মন পইড়া রইছে টিউশনির দিকে, আমাদের রেজাল্ট নিয়া তার কোন টেনশন নাই "- শুভ্র বলে।
চারজনে একটা রিকশা নিয়ে সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
চারজন এক রিকশায় বসার মজাই আলাদা!
দুইজন সামনে, বিচিত্র পদ্ধতিতে দুইজন পেছনে!
এক সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যায়।
যদিও রেজাল্ট এর চিন্তায় কারোও মুখে আজ কোন কথা নেই!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট এ পৌঁছে দেখা গেল এলাহি কারবার!
হাজার হাজার ছেলেদের ভীড়!
আসে পাশের সব স্কুল থেকে ছেলেরা এস হাজির!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলের স্যাররা এত ছাত্র সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন!
" আপনারা শুনেন মন দিয়া, আমাদের এখানে এখনো রেজাল্ট আসে নাই, আপনারা শান্ত ভাবে অপেক্ষা করেন, রেজাল্ট আসলে জানানো হবে! "
জহির শুভ্র তিতু রাসেল স্কুলের মাঠের এক কোনে গিয়ে দাড়ায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
"হেডুর উপরে রাগ উঠতাছে আমার- রাসেল আবার বলে।
আমার ও" তিতুর উত্তর "গতমাসে আমরা যখন খাতা দেইখা দিলাম, কত খাতির, আর এখন যেন চিনেই না!"
"বাদ দে ত, এখন কি করা যায় সেটা বল" জহির তারা দেয়। ওর অস্থির লাগছে রেজাল্ট এর চিন্তায়।
ওদের স্কুলের আরও কিছু ছাত্র এসেছে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল - ইত্তেফাক অপিসে যাওয়া যাক।
রেজাল্ট এর খবর নিশ্চয়ই পত্রিকা অপিসে আগে আসবে!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুল থেকে ইত্তেফাক অফিস বেশি দুর না, সবাই হেটেই রওনা হলো।
পরীক্ষার রেজাল্ট জানার এই সব পদ্ধতি ছেলেদের কাছে নতুন, কিন্তু মুখে মুখে খবর ছড়াচ্ছে, আর ছেলেরাও সেটা সাবলীলভাবে করে যাচ্ছে, ওরা জানেনা এই সব অভিজ্ঞতাই ওদেরকে পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এক কদম এগিয়ে রাখে!
কপাল মন্দ, ইত্তেফাক অফিসে গিয়েও জানা গেল, রেজাল্ট আসেনি!
তবে একটা খবর পাওয়া গেল- আজ রেজাল্ট হবে!
বেলা দুইটার পর রেজাল্ট আসবে!
ইত্তেফাক অফিস এর সামনে আজ মনে হয় ঢাকার সব এসএসসির ছাত্র এসেছে, রাস্তার দুই পাশেই ছাত্রদের ভীড়।
শুভ্র হঠাৎ বলে- খিদা লাগছে, কিছু খাওয়া দরকার। "
এটা একটা সমস্যা। কারো কাছে ই তেমন বেশি টাকা নেই, দুপুর হয়ে গেছে, বাইরে খেতে হবে এমন প্রস্তুতি কারোই ছিলো না!
কিন্তু ছেলেরা এটা কে সমস্যা মনে করছে না।
পকেটের সামান্য যা আছে তা দিয়ে ই কলা পাওরুটি চা সিংগাড়া খেয়ে নিল।
এরপর অপেক্ষা!
কখন আসবে রেজাল্ট!
কিভাবে আসবে!
কৌতূহল আবার দুশ্চিন্তা!
অস্থির অপেক্ষা, সময় কাটে না।
বেলা তিনটার কে এসে বলল- রেজাল্ট এসেছে!
ছেলেরা ডানে বামে তাকায়, কই রেজাল্ট কোথায়? ক্লাস ফ্রেন্ড ইকবাল বলে - রেজাল্ট এর জন্য ভিতরে যাইতে হইব, চল দেখি ইত্তেফাক অফিস এ ঢুকি।"
কিন্তু ইত্তেফাক অফিস এর দরজা বন্ধ!
কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
ভেতরে ঢুকতে দিলে এত ছাত্র নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।
কি করা যায়!
কেউ এসে বলল- মতিঝিল থানায় যাই, থানায় গেজেট বই আসে!
এক দল রওনা হলো থানার দিকে।
ইকবাল জহিরদের বলল- যাইছ না, দাড়া একটু, আমার এক আত্তিয় আছে ইনকিলাব অফিসে, দেখি ঢুকতে পারি কিনা।"
বেলা সারে চারটার পরে সুযোগ হলো ইনকিলাব অফিসের ভেতরে ঢুকার, এখানে ও ভীড়, সবাই পরীক্ষার রেজাল্ট এর অপেক্ষায়!
ইকবাল জহিরদের নিয়ে ওর আত্তিয়র অফিস রুমে ঢুকে।
ইকবাল বলে - সবার রোল নাম্বার লেইখা দে।"
ওরা চারজন যার যার রোল লেখা কাগজ এগিয়ে দেয়।
ইকবালের ভাই নাম্বার নিয়ে গেজেট বই এর সাথে মিলাতে থাকে।
" হুম,..... কার নাম্বার? "
শুভ্র বলে, আমার!"
হুম, সেকেন্ড ডিভিশন। "
আঃ শুভ্রর বিসশাস হয় না, সেকেন্ড ডিভিশন কিভাবে হয়!
ফাস্ট ডিভিশন হওয়ার কথা!
একে একে জানা গেল - তিতু রাসেলের রেজাল্ট ও সেকেন্ড ডিভিশন!
জহিরের রোল নাম্বার কোথাও নেই!
আয় হায় কয় কি! জহির মাথায় হাত দিয়ে বসে!
তাইলে কি ফেল?
আব্বা আম্মারে মুখ দেখামু কেমনে!
ক্লান্ত হতাশ ও মনমরা হয়ে জহির তিতু শুভ্র রাসেল আর ইকবাল বেরিয়ে আসে ইনকিলাব অফিস থেকে।
সবার মনেই আশা ছিল - ফাস্ট ডিভিশন পাবে।
এটা কি হলো!
সবচে বেশি মন খারাপ জহিরের। বার বার খুঁজেও ওর নাম্বার গেজেট বই এ পাওয়া যায়নি!
ক্লান্ত শরীরে ছেলেরা এবার রিকশা নিল। কারোই এখন হাটার শক্তি নেই।
চারজনেরই মন খুবই খারাপ।
বাসায় গিয়ে কি বলবে, কিভাবে মুখ দেখাবে!
বাসায় সবাই কত আশা নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে।
কস্টে জহিরের চোখ দিয়ে পানি পরছে, বার বার আব্বার কথা মনে হচ্ছে।
বাবা কত পরিস্রম করে ওদের চার ভাই বোনের পড়াশোনার জন্য! সেই সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, রাত হলে বাড়ি ফেরে! কত কষ্ট করে ওদেরকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য। কষ্টে জহিরের বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
"আমি বিসশাস করি না,আমার রেজাল্ট এমন হইতে ই পারে না! "
তিতুর চোখেও পানি ঝরছে, কোন ভাবে ই ওর রেজাল্ট মানতে পারছে না!
রিকশা যখন ফকিরাপুলের সামনে দিয়ে পার হচ্ছে, তিতু বলল- আমি মতিঝিল থানায় আবার রেজাল্ট দেখুম, রিকশা থামা!"
জহির ও বলে - চল আমিও যাই তোর সাথে। "
শুভ্র আর রাসেল বাসায় চলে যাবে, তিতু আর জহির মতিঝিল থানার দিকে ক্লান্ত পায়ে হেটে যায়।
যথা রীতি এখানে ও ভীড়।
তবে থানার ভিতর বলে ছাত্ররা সবাই লাইন ধরে ভদ্র ভাবে অপেক্ষা করছে। ওরা দুজন লাইনে দাড়ায়।
প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর ওদের সিরিয়াল আসে। সামনে তিতু পেছনে জহির।
"রোল কত - কাউন্টার থেকে জানতে চায়।
তিতু রোল নাম্বার বলার পর লোকটা গেজেট বই চেক করে বলেন - সেকেন্ড ডিভিশন। আগে?"
জহির মনে আশা নিয়ে রোল নাম্বার বলে।
লোকটা যথাযথ ভাবে চোখ বুলিয়ে বলে - হুম,সেকেন্ড ডিভিশন এ নাই!"
কাঁদতে কাঁদতে জহির বলে - আংকেল একটু থার্ড ডিভিশনে দেখবেন? "
লোকটা প্রায় ধমক দিয়ে বলে - থার্ড ডিভিশনে কেন ফাস্ট ডিভিশন এ দেখতাছি, হুম...."
জহির ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে।
"নাম্বার কত?" লোকটা আবার জানতে চায়।
"......৮৩" জহির জবাব দেয়।
"ফাস্ট ডিভিশন! আগে " লোক টা অবলীলায় বলে তারা দেয়।
জহিরের বুক ধক করে উঠে!
"আংকেল, আবার দেখেন, প্লিজ! "
"আবার দেখার কিছ নাই, আমি চেক কইরা ই বলছি,আগে!"
জহির খুশিতে চিৎকার করে উঠে!
দুই হাত উচু করে লাফিয়ে লাইন থেকে বের হয়।মনে মনে কাউন্টার এর অপরিচিত লোকটার জন্য দোয়া করে, সেই ইনকিলাব অফিস থেকে অন্যদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর কারো ফাস্ট ডিভিশন এ চেক করার কথা মনেই আসেনি!
পাশে তিতুর মন খারাপ, তবুও জহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
"যাক, তোর রেজাল্ট ত ভালো হইছে,চল বাসায় যাই।"
এক রিকশায় দুজনে বসা। রিকশা চলছে রাজার বাগ মোড় পেরিয়ে শাজাহান পুরের দিকে। তিতু আর জহির দুজনেই কাঁদছে!
একজনের মন খারাপ, আরেক জনের মনে আনন্দ!
মানুষ যে আনন্দে ও কাঁদে জহির তা জীবনে প্রথম উপলব্ধি করে!
বিঃদ্রঃ এই ঘটনার বর্ননার কিছুই বানানো নাই, সকল ঘটনা ই হুবহু লেখা হয়েছে! বরং হেড স্যারের ব্যাপার এ আমাদের মন্তব্য এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভদ্র ভাষায় লিখেছি, বাস্তবে আমরা যেসব গালি দিয়ে ছিলাম তা উল্লেখ করা হয় নাই।
মাশাল্লাহ, এখন ছেলে মেয়েরা কত সহজে মোবাইলে রেজাল্ট পেয়ে যায়! আমাদের সময়ের চিত্রটা ধরে রাখার জন্যই এই প্রয়াস।
যখন
ছেলেটা দেখতে রাজপুত্রের মত! চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের হবে।
মাথায় টুপি, সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা গায়ে।
মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল পেরিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। হাটার মধ্যে ইতস্তত ভাব! এদিক ওদিক তাকায়, সামনে একটা কাচা বাজার দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে দোকান পাঠ কম।
মাদারটেক বাজারের সামনে এসে দাড়ায়।
একটা পান দোকানের এসে ঢোক গিলে।
এর নাম ঢাহা, কুন কিছু চিনন যায় না! মনে মনে বলে।
তার ভাব সাব দেখে দোকানদার জিজ্ঞেস করে - এই ছেলে কিছু খুজতাছ নাকি!"
লোকটার প্রস্ন শুনে চমকে উঠে ছেলেটা!
আবার ঢোক গিলে বলে - বড় বইনের বাসা খুজতাছি, নামা গোরান, দুলা ভাইয়ের নাম নুরুল ইসলাম! "
"এহ, নামা গোরান! নামা গোরান এর রাস্তা ত পিছনে ফালাইয়া আসছ! বাসার নাম্বার কত?"
বাসার নাম্বার ত জানি না!"
কউ কি! বাসার নাম্বার ছারা ঢাকা শহর এ ঠিকানা খুইজা পাওয়া যায়? "
বেলা প্রায় তিনটা বাজে।
রফিয়া মাত্র বাচ্চাদের নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে শোয়ার ঘরে রেডিও নিয়ে বসেছে, কোলকাতা আকাশ বাণী ধরার চেষ্টা করছেন, আজ সাপ্তাহিক নাটক হওয়ার কথা।
হঠাৎ জানালার পাশ থেকে আওয়াজ শুমা যায় - আফা, জহির! "
রফিয়া চমকে উঠেন।
জহির বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে।
দুজনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
"আরে! ওদুদ তুই! "
তুই কইত থেইকা আইলি!"
জহির দৌড়ে গিয়ে গেইট খোলে।
অবাক হয়ে ছোট মামার দিকে তাকায়।
ওদুদ মামাকে একদম চেনা যাচ্ছে না!
মাথায় টুপি! গায়ে পাঞ্জাবি পায়জামা!
"কিরে তুই কেমনে? আব্বা মায়র শইল ভাল নি, আব্বারে বইলা আসছস নাকি না"
রফিয়া জিগ্যেস করেন।
"হ, সবাই ভাল" সেই রাজপুত্রের মত ছেলেটা মুচকি হেসে বলে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে বোনের বাসা খুঁজে পাওয়া গেছে! ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ঠিকানা ছাড়া বুঝি বোনের বাসা খুঁজে পাবে না!
রফিয়া চোখ বড় করে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
মুখ ভরা হাসি দিয়ে ওদুদ জিজ্ঞেস করে - আফা তুমরা কেমন আছ? দুলাভাই কই?"
"তর দুলাভাই ত এই সময় অফিসে থাকে, তুই কেমনে আইলি সেইটা ক?"
রফিয়ার কন্ঠে সন্দেহ!
ওদুদ আবার মুচকি হেসে বলে - আফা ভুক লাকছে, ভাত দেও।"
ওহ হো,হ হ, তুই হাত মুখ ধুইয়া ল, জহির তোর মামারে গোসল খানা দেখাইয়া দে।"
জহির ওদুদ কে নিয়ে গোসল খানা দেখিয়ে দেয়।
পেছনে রফিয়া বির বির করেন- নিশ্চয়ই মাদ্রাসা থেইকা আবার ভাগছে!
ছোট ভাইয়ের স্বভাব রফিয়ার জানা। এই ভাইটার লেখা পড়ায় মন নেই, আব্বা অনেক চেস্টা করে শেষে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছে,যদি হাফেজি লাইনে কিছু হয়!
কিন্তু এই ছেলের ঘর পালানো স্বভাব!
শিতল পাটি বিছিয়ে ভাইকে খাবার বেরে দেয় রফিয়া।
আয়োজন আজকে তেমন ভালো না। লাল শাক ডাইল আর আতপ চালের ভাত!
রেশন কার্ডে আতপ চাল দেয়। জহিরের খুব প্রিয় আতপ চালের ভাত!
" আমরা ত আতপ চাইল খাই, রেশনে দেয়, তর খাইতে কস্ট হইব!"
"আফা যে কি কউ, মাদ্রাসার খাওনের লগে এই ভাত ত অম্রিত!"
অদুদ লাল শাক দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলে। সাদা আতপ চালে লাল শাক এর রং টুক টুক করে!
"আফা, আমরার জহির ত দেখি এই এলাকায় খুবই জনপ্রিয়! বাসার নাম্বার ছারা আমি ত তুমরার বাসা খুইজাই পাইতাছিলাম না! শেষে জহিরের বয়সি একটা ছেলে আমারে কইল, আপনে জহির গো বাসা খুজেন, আমার সাথে আসেন, ছেলেটার নাম কচি না টুটুল জানি কইল!"
ওদুদ হাসতে হাসতে ডাল আর ভাত মজা করে খায়।
এদিকে রফিয়া মনে মনে টেনশন করে, আব্বা রে কেমনে খবর পাঠাইব, মায়ো না জানি কত দুশ্চিন্তা করতাছে!
Monir:
মামাদের কথা বলতেছিলাম, আম্মার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ওয়াদুদ মামা, আমার সবচেয়ে পছন্দের মামা, উনাকে আমার খুব পছন্দ, ছোট মামা মানেই আমার কাছে ছিলো আনন্দের খোড়াক, মামাকে আমি মোটামুটি আমার জীবনের আদর্শ হিসাবেই নিয়া নিতাম যদি দেখতাম উনি ইকটু অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ মানে যাকে আমরা আক্ষরিক ভাবে স্যাটেল্ড বুঝি। ছোটমামার জীবন টা কোন অংশে কম এ্যাডভেঞ্চারাছ ছিলো না, উনার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাতো সবাই কম বেশি শুনছো, আমার কাছে ছোটমামা মানেই এক মজার মানুষ, কথা নাই বার্তা নাই হুট করে এক প্যাকেট মিস্টি নিয়া হাজির, আরে বেপার কি!!! মিস্টি?? কোন কারন নাই, ঐ সময় কারন ছাড়া মিস্টি ভাবা যায়না, আম্মা জিজ্ঞেস করে সত্যি কইরা কো তোরকি বেতন বাড়ছে? মামার নির্বিকার উত্তর ধুরো দিদি, বেতন বাড়লে তুমরারে কইতে আমার আমার অসুবিধা আছে, আম্মার মনে সন্দেহ থাকলেও আমার বেজায় আনন্দ, দারুন মিস্টি বংশালের নামকড়া মিস্টি, আলাউদ্দিনের মিস্টির চেয়ে দামি, সেইরকম টেস্ট, মামা তখন আমাদের বাসায় থাকে বংশালে চাকরি করে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে হুট করে বলে চলো ভাইগনা আজকা মজা দেখতাম যামু আমি উঠে ঝটপট রেডি। মামাকে জিজ্ঞেস করি কি মজা মামা?? মামা বলে খাইয়া নাচুনি
আমার মজা লাগে কিন্তু খাইয়া নাচুনিটা কি সেইটা বুঝি না, ২৬শে মার্চ বেশ সকাল সকাল আমাকে নিয়া মামা বেড় হলেন, নিয়া গেলে ঢাকা স্টেডিয়াম যেটা এখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামে ঢুইকাতো আমি টাস্কি, আয় হায় এইটা কই আইলাম!!! এতো এতো মেয়ে ছেলে এতো এতো কালারের ড্রেস পরে আছে কেন? এরমধ্যে আবার ইয়া বড় বড় ঘোড়া বেশ দারুন খেলা দেখাইলো একদিকে কুচকাওয়াজ অন্যদিকে ভারতশ্বরী হোমস এর মেয়েদের এক্সেলেন্ট এক্রোবেট কিছু এতিমখানার ছেলেরাও দুর্দান্ত পারফর্ম করলো, রাস্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আসলেন মিশুক(হরিণ) এর লোগো যেটা পরবর্তী তে সার্কের বাংলাদেশের লোগো উন্মোচন করলো হাজার হাজার বেলুন উড়ানো হলো প্রচুর কবুতর ছারা হইলো আমার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে রইলো, আবার সামনে হয়তো কোন একটা ছুটির দিন আসতাছে মামা আগেভাগে এসে আম্মা বলবে দিদি পুরশুদিন সকাল সকাল সব রান্না শেষ কইরা লাইবা, একদম রাইতেরটা শুদ্দা কাহিনি কি? কাহিনি আছে ব্যস নির্ধারিত দিনে দেখা গেলো মামা কইত্থিকা জানি ভিসিপি ভাড়া কইরা নিয়া আসতো সাথে ৫-৬টা সিনেমার ক্যাসেট, ১৫-২০ঘন্টা একটানা মুভি চলবে, ঐদিন লোন লেখাপড়া নাই আহা কি আনন্দ!!! শুক্রবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রেডিওতে নাটক শুনতাম মামা আমাদেরকে লাগায় দিতো পাকা চুল বাছতে প্রতিচুলে পয়সা পাবো মোটামুটি মামার সবকিছুই আমাদের ভাল লাগে যা করে তাই আনন্দ। ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফুটবল, ঐ সময় চির প্রতিদন্ধি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা, তখন সাপোর্টাররা এখনকার মত এতো ম্যাচিওর ছিলোনা, তখন সাপোর্টার মানে সাপোর্টার বিপক্ষের কোনো প্লেয়ার ভাল খেললেও প্রশংসা করা যাবেনা কেউ যদি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হয়ে ব্রাজিল এর কারো খেলার সুনাম করে তাইলে ও দালাল, ঐ বেটা শেষ ওর জীবন তেজপাতা, সো যে ব্রাজিল ব্রাজিলই যে আর্জেন্টিনা সে আর্জেন্টিনা ই। নো ধুন ফুন। খেলা শুরু হইছে আর্জেন্টিনা ব্রাজিল। ব্রাজিলের খেলা কি সুন্দর নান্দনিক, কিন্তু আমাদের সবার পছন্দ ম্যারাডোনার জন্য আর্জেন্টিনা, মামা কোন পক্ষে বুঝা যাচ্ছে না। ম্যারাডোনা বল নিয়া আগাইতে পারেনা তার আগেই ফাউল করে ফেলে দেয় আমরা হতাশ হই রাগ হই ব্রাজিলের প্লেয়ারদের বদদোয়া দেই। পুরা খেলা ব্রাজিল ভালো খেলেও আর্জেন্টিনা গেলো জিত্তা, ওহঃ সেকি আমগো খুশি হঠাৎ চাইয়া দেহি ছোটমামা কলপাড়ে আমাদের টিউবওয়েল এর নিচে মাথা দিয়া বইয়া আছে পানি ঢালতাছে, এতক্ষণে বুঝাগেলো মামা কোন দলের, আব্বা কয় হেরে জিগাও বাজিটাজি ধরছেনি কারো লগে🤪🤪🤪
Suraiya:
মনির মাহাবুব এর চাচা শশুর আর কেন নানা বাড়ি আইব না কিন্তু ক্লিয়ার ভাবে বুঝতে পারলাম না। নানি বাড়ি তে চা বানানো নিয়া ঠেলাঠেলি বিশেষ করে মেজমামির সাথে অত্তন্ত কমন একটা ব্যাপার আমরা এই ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর মামার এই বাজিতে হারার গল্পটা আমি বহুবার তোর দুলাভাই এর সাথে সেয়ার করেছি আর হেসেছি। তবে আব্বা ও মে আমাদের সাথে বিশ্ব কাপ ফুটবল দেখত ভুলে গিয়েছিলাম। দৃশ্য টা এখন ও চোখে ভাসছে । খেলা দেখতে দেখতে যে দিন ঘুম পেয়ে যেত তখন বলতে খেলোয়াড় রা খেলতে কি কম খেলতে কি কম খেলব ওরা খেলুক আমি ঘুমাই।অথচ আব্বার ঘরে ই টিভি থাকার জন্য আমরা ও ঘরে বসে ই খেলা দেখতাম কিন্তু একটু ও বিরক্ত হতো না যেটা আব্বার পরিচিত কেরেকটারের সাথে যায় না। কি বলিস? আমি কিন্তু আব্বাকে বাংলা ছবির গানের সাথে নাচতে ও দেখেছি। কি রকম এক অদ্ভুত মুরগি করে আব্বা নাচত।
Suraiya:
মনির তোর সাথে কথা টা সেয়ার করেই ফেলি ছোট মামা তার উল্লেখযোগ্য অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সব সময়ই ভাগছি দেন ঠিক ই আসল সময় টা তেই ভাঙ্গতে পালন নাই। কি বলিস?
যখন
সাল ১৯৭৫
১৫ আগস্ট।
জহির ওর আব্বার হাত ধরে হেটে যাচ্ছে, যাবে বাসাবো বাজার। ছোট মানুষ! সাত বছর বাচ্চা! বাবার সাথে হেটে কুলাতে পারছে না। তবুও কোন অভিযোগ নেই। বাবার সাথে বাজারে আসার সুযোগ কমই হয়। যদিও বাজারের ভিতরে যাওয়া হয়না জহিরের।
বাসাবো বাজারে আগে মোড়ে নুরুল ইসলাম এর বন্ধু আজিজ সাহেব এর ওষুধের দোকান আছে। সেখানে জহির কে বসিয়ে নুরুল ইসলাম বাজার করেন, যাওয়ার সময় জহিরকে নিয়ে যান।
আজ রাস্তা ঘাট ফাঁকা! এমনিতেই হালকা বসতি, তার উপর আজ যেন রাস্তায় কোন লোকই নাই!
পাটোয়ারী বিল্ডিংয়ের মোড়ে এসে নুরুল ইসলাম ডানে বায়ে তাকায়, ব্যাপার কি, সব দোকান পাট বন্ধ! দূরে দুরে একটা দুটি লোক নজরে আসে। কাল রাতে কোন একটা সমস্যা হইছে মনে হয়! নুরুল ইসলাম বির বির করেন।
হঠাৎ বাম দিকের রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়- মিলিটারি আইতাছে, মিলিটারি আইতাছে!
"কয় কি! মিলিটারি কইত্তে আইলো" নুরুল ইসলাম জহিরের হাত ধরে শক্ত করে।
রাস্তায় কিনারায় দুই কদম পিছিয়ে দাড়ায়!
দুর থেকে দেখা যায় মিলিটারি ট্রাক আসছে! পর পর তিনটা মিলিটারি ট্রাক ওদের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে পার হয়ে গেল,ট্রাকের ভিতর কালো পোশাকের সৈনিক! হাতে মেশিন গান!
জহির অবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে!
পেছন থেকে কে যেন বলে - এক্কেরে মিলিশিয়া বাহিনীর মত!"
শিশু জহিরের শরীর কাপতে থাকে ভয়ে! বাবা জহিরকে কোলে তুলে নেয়!
"কি হইছে রে ভাই, কি হইছে! "
কেউ কোন কথা বলে না! সবাই ভীত!
এলাকায় সবার ঘরে রেডিও নেই, তাই ওরা জানে না, কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে!
১৪৪ ধারা!
আজ এই দেশের সবচেয়ে বড় কলংকের দিন!
গত রাতে সপরিবারে শেখ মজিবুর রহমান কে হত্যা করা হয়েছে!
যখন
আজ আবাহনী মোহামেডান খেলা!
হারুন ভাইয়ের সাথে জহির আর সোহেল যাচ্ছে খেলা দেখতে। জহির সোহেল এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। হারুন ভাই এখন কলেজে পড়েন। খিলগাও মডেল কলেজ। তিন জন এক রিকশায় বসা।
জহির খুব উত্তেজিত, আজ ওর জীবনের প্রথম স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখা হবে! সোহেল অবশ্য এর আগে কয়েক বার ওর মামাদের সাথে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখেছে।জহিরের দিকে তাকিয়ে হারুন ভাই জিগ্যেস করে - তাইলে কি বলছি মনে আছে তো? আমরা কোন দলের সাপোর্টার? "
সোহেল জহির দুইজন ই এক সাথে বলে - আবাহনী! "
যদিও জহির সোহেল এত সিরিয়াস না, সাপোর্ট এর ব্যাপার নিয়ে কিন্তু হারুন ভাই আবার বলে - মনে থাকে যেন, জীবনে ও মোহামেডান এর নাম লবি না, কিরা খাইয়া ক।"
দুইজনই অবলিলায় মাথা কিরা খায়।
রিকশা এসে বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে এসে থামে।
জহির সোহেল রিকশা থেকে নেমে হারুন ভাই এর পাশে দাড়ায়।
হারুন ভাই বলেন - সব সময় আমার হাত ধইরা থাকবি,নাইলে কিন্তু হারাইয়া যাবি!"
সোহেল ও জহির শক্ত করে হারুন ভাইয়ের হাত ধরে।
স্টেডিয়াম লোকে লোকারণ্য, তীল ধারনের জায়গা নাই, আবাহনী মোহামেডান খেলায় এটা সাভাবিক!
কোন মতে টিকেট কেটে ওরা গিয়ে ভেতরে ঢুকে গ্যালারিতে বসে। খেলা শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই।
জহির অবাক হয়ে স্টেডিয়ামের চারিদিকে তাকিয়ে দেখে।
হারুন ভাই আংগুল দিয়ে ইশারা করে দেখায় - ওইদিকে মোহামেডান এর সাপোর্টার বসে,জীবনে ভুলে ও ঐদিকে গিয়া ববিনা! মাইর খাইয়া ভুত হইয়া যাবি।"
জহির মনে মনে আরো অবাক হয়! ঐদিকে বসলেই মাইর খিতে হবে।
আবাহনী মোহামেডান এর সাপোর্টার এর পাগলামির কোন শেষ নাই।
আসে পাশে কিছু ফেরিওয়ালা হাটে আর ডাক দেয়- ঝালমুড়ি! বাদাম বুট! সিগারেট!
হারুন ওদের বুট কিনে দেয়, আর নিজের জন্য এক্টা সিগারেট কিনে ধরায়।
সোহেল চোখ বড় করে বলে - আপনে সিগারেট খান!"
"অই চুপ, খবরদার কইতাছি, বাসায় কাউরে কবিনা! কইলে ঠুয়া খাবি!"
জহির ও সোহেল বুট যেতে খেতে মাথা নারে।
কিছক্ষন পর খেলা শুরু হয়। দুই পাশের সাপোর্টারদের মধ্যেই চরম উত্তেজনা!
হারুন ভাই তার বাবরি চুল ঝাকিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। আবাহনীর দলের কেপ্টেন সালাউদ্দিন এর মত লম্বা চুল এখন ফ্যাশন!
তাকে চিন্তিত দেখায়। মাঠের ভাব ভালো না।যে কোন সময় মারামারি লাইগ্যা যাইতে পারে!
পনের মিনিটের মাথায় টুটুল একটা গোল করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় মারা মারি!
আয় হায় কি হইতাছে এইসব! খেলা তো মনে হয় বানচাল হইয়া যাইবো!
হারুন আক্ষেপ করে, তার দুশ্চিন্তা আরও বারে।
সাথে দুইটা বাচ্চা ছেলে! ওদের আম্মা বার বার করে বইলা দিছে - বাবা, আবাহনী মোহামেডান খেলা! তুই কিন্তু অগরে দেইখা রাখিস!
শালা , পরবি পর মালির ঘারে! আইজই মারামারি লাগার দরকার ছিলো!
হারুন জহির ও সোহেল কে দুই হাতে ধরে - উঠরে, মারামারি লাগছে, খেলা বাতিল হইব, চল তাড়াতাড়ি, না-ই লে পরে বাইর হইতে পারুম না!"
জহির ও সোহেল ভয় পেয়ে যায়। হারুন ভাই ওদের নিয়ে লোকের ভীর সামলে এগুতে থাকে। ও লোকই খেলা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে!
হারুন জহির আর সোহেলকে দুই হাতে জড়িয়ে মাথা নিচু করে দৌড়াচ্ছে! সবাই যেন একসাথে বের হতে চায়! কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতা! এদিকে স্টেডিয়ামের ভিতর তোলপাড় অবস্থা! উগ্র জনতা ভি আই পি গেলারির সিট ভাংচুর করছে, লোহার গ্রিল ভাঙচুর করছে, হুলুস্থুল অবস্থা! আবাহনী মোহামেডান খেলায় যদি মারামারি লাগে পুলিশ বা কারোও পক্ষে ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়না!
এনিয়ে বার বার দৈনিক পত্রিকা, টিভি তে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কে শুনে কার কথা!
শত হলেও হুজুগে বাংগালী বলে কথা!
হারুনভাই ওদের দুজনকে শক্ত করে ধরে বলে - মাথার উপরে হাত রাখ, বদমায়েশের বাচ্চারা ঢিল মারবো কইলাম, সাবধান! "
জহির এবং সোহেল দুজনেই ভয়ে আধমরা অবস্থা! বাইতুল মোকাররম মসজিদের পাশের গেইট দিয়ে হারুন ওদের দুজনকে নিয়ে কোন মতে বেরিয়ে আসে! ওদের মাথার উপর পানির ফোটা পড়ে!
খবরদার উপরে তাকাইছ না,শালার পুতেরা উপরের থেইক্কা মুত্তাছে!"
চোখ বন্ধ করে ওরা দোউড়ে জায়গাটা পেরিয়ে আসে। ভাগ্য ভালো, তিন জনের শরীরেই অল্প পানির ছিটা লেগেছে!
এক দৌড়ে হারুন ওদের নিয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে এসে দাড়ান। এদিক ওদিক তাকায়, যদি রিকশা পাওয়া যায়। রিকশা দুরে থাক, একটা যানবাহনও নজরে পরে না! মারামারির খবর ছড়িয়ে পড়েছে! এদিকে আজ আর কোন পরিবহন আসবে না।
"কপাল খারাপ, তোগরে লইয়া আইজ খেলা দেখাইতে আনলাম" হারুন আক্ষেপ করে বলে - আইজ মারামারি লাগলো!"
জহির সোহেল কোন উত্তর দেয় না, ওরা খুবই ভয় পাচ্ছে!
হারুন ভাই আবার বলেন- ভয় পাইছ না, আমরা এক সাথে থাকলে কোন ভয় নাই!"
একটু দম নিয়ে বলেন - হাইট্টা যাইতে হইব, পারবিনা?"
দুজনেই মাথা নারে,মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না!
চল আগাই" বলে হারুন ভাই ওদের নিয়ে ফকিরাপুল এর দিকে হাটতে থাকে।
দুইহাতে দুজনকে শক্ত ভাবে ধরে রেখেছেন!
রাস্তার দুই পাশে ই লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে। জহির আর সোহেলও ভয়ে দৌড়াতে চায়! হারুন ভাই বাধা দেন।
"দৌড়াইছ না, তোগ কস্ট হইব, ছোট মানুষ, হাপাইয়া যাবি!"
তিন জনই দ্রুত গতিতে হাটছে! হঠাৎ পিছনে চিৎকার শুনা যায়,কিছু লোককে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখা যায়! মনে হয় মোহামেডান এর সাপোর্টার!
জহির ও সোহেল ভয়ে কাঁপতে থাকে!
হারুন ভাই ঘাবড়ে গেলেও ওদের দুজনকে শক্ত করে ধরে রাখেন।
"ভয় পাইছ না, তোরা ছোট মানুষ, তোগরে কিচ্ছু করব না, আর আমারে যদি কিছু করেও তোরা একদম চুপ থাকবি, খবরদার ভয় পাইছনা!"
ভেতরে ভেতরে নিজেই ভয়ে কাপছে! লোকগুলো একদম কাছে এসে গেছে! প্রায় বিশ তিরিশ জন! আল্লাহ ই জানেন কোন দলের সাপোর্টার! এমন সময় নয়া পল্টনের গলি থেকে লাঠি সোটা হাতে কিছু ছেলে দৌড়ে আসে! মুহুর্তে দুই দলের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়!
হারুন ভাই তারাতাড়ি ওদের দুজনকে নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে দৌড়াতে থাকে।
জহির আর সোহেল কষ্ট হলেও দৌড়াতে থাকে। এক দৌড়ে রাজার বাগ পুলিশ লাইন!
তিন জনের দলটা এখানে কিছক্ষন দাড়ায়, মনে আশা পুলিশ লাইন এর কাছে কোন সমস্যা হবে না।
একটু পর আবার হাটতে থাকে, রাজার বাগ মোর এসে ভাগ্য ক্রমে একটা রিকশা পায়!
তিন জন ই লাফিয়ে উঠে রিকশায়।রিকশা ওয়ালা তারা দেয়, রাস্তার অবস্থা ভালো না।
কিছক্ষন চুপচাপ চলার পর হারুন ভাই বলেন - বাসায় গিয়া কিন্তু ভুলেও মাঠের মারামারির কথা কবিনা, নাইলে আর জীবনে ও স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দিব না কইলাম! "
জহির আর সোহেল একজন আরেকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়, হারুন ভাই কয় কি! স্টেডিয়ামে আরও খেলা দেখতে আসব!
সুরাইয়া
আজ একটু অন্য রকম বিষয় নিয়ে লিখি। দিন টি ছিল উনিশ শতকের জুলাই মাসের কোন একটি দিন তারিখ মনে করতে পারছি না। ভাইয়া কোথা থেকে এসে বললো সুরাইয়া তুই চিন্তা করিস না তোর জামাই অনেক সুন্দর। ভাইয়ার এই কথা টা ছিল স্মরনীয় তাই লিখে ফেললাম কোনো রকম ভুমিকা ছাড়া ই। এবার ভুমিকায় আসা যাক। বিয়ে দুই অক্ষরের এই শব্দটার সাথে ছোট বেলা থেকেই আমার ছিল কেমন যেন একটা মনের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি কাজ করত। কেননা আব্বা আম্মার ঝগড়া গুলো ছিল কখনো বৈচিত্র ময় আবার কখনো ভীতিকর। আবার কখনো বিরক্তকর। ছোট বেলায় আম্মা কে প্রশ্ন করতাম কেন ঝগড়া করে? তেই ঝগড়ার কোনো লাভ নেই।যেই প্রশ্ন টা সে দিন আমার ছেলে আমাদের করে বসল। উত্তরে তার বাবা তাকে বলল এটা ঝগড়া না এখন এইটা ই আমাদের কথপোকথন।এখন বুঝবি না বয়স হলে বুঝবি। আমি ও যেন ততখনাৎ বুঝতে পারলাম যে আব্বা আম্মার ঝগড়া ঐটা ঝগড়া ছিল না ছিল কথোপকথন। শুধু স্বভাব সুলভ আচরণ বা চিল্লাচিল্লি টা বাদ দিয়ে।যাই হোক আম্মা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিল। মনে সান্তি পাই। অর্থাৎ আমি আমার জীবনের শিক্ষা থেকে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। বিয়ের কথা বা প্রস্তাব আসা শুরু করে ছিল আমার স্কুলের জীবন থেকে ই। আম্মা হয়তো আমার মনের কথা ঠিক ঠিক বুঝতে পারত।তাই ঐসময় থেকে বিয়ের কথা চুড়ান্ত নাহওয়া পর্যন্ত আমাকে কিছুই বলেনি ব বলতনা।তাক বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার মনে ও একটা পরিবর্তন দেখতে পেলাম। মনে হতে থাকলো বিয়ে একটা বাস্তবতা এটাকে এভয়েট করা যাবে না। বাকি টা হেল্প করল দিলু।ও সব সময় আমাকে প্রটেক্ট করে রাখতো।বলতে সুরাইয়া আপা তুমি চিন্তা করো না আমার পছন্দ না হলে তোমার বিয়ে হবে না। আমি যেন হাতে জান পেলাম।যাই হোক আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো চৌঠা অক্টোবর। আমার বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে মনির দিলু এসে আম্মা কে বলল সুরাইয়া আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আমাদের কে পার্টি দেওয়া উচিত চল আপাকে নিয়ে ফুচকা খাইতে যাই। আমি খুবই অবাক হলাম আম্মা একটুও বাধা দিল না বরং আমাদের কে দুই শত টাকা দিয়ে বলল যা কিন্তু দেরি করিস না।এটাই ছিল বিয়ের আগে আমাদের তিন জনের একসাথে মজা করা। অল্পক্ষনের জন্য হলেও আমরা তিনজন মিলে একটা রিক্সা ভাড়া করে তালতলা গিয়ে ফুচকা খেলাম মনে হয় আইসক্রিম ও খেয়েছিলাম। কথায় বলে একশ একটা কথা না হলে নাকি বিয়ে সম্পুর্ন না। আমার মনে হয় আমার বিয়েতে একশ এগারো টা কথা হয়েছিল। কারন ঝামেলা র পর ঝামেলা লাগছিল। পুরো বর্ননা দিতে গেলে আরো অনেক সময় লাগবে । কিন্তু আজ আর লিখতে পারছিনা কারন প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। শুধু এটুকু বলছি যে ঐসময় বিয়ের সকল সমস্যার সমাধান করেছিল ভাইয়া আমার বাবা হয়ে।যার কথা মনে হলে আজও আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। আমার দোয়া সব সময়ই থাকবে তার জন্য।
ঐ বাড়ি থেকে খবর এল ওরা হলুদের অনুষ্ঠান করবে না শুনে আমাদের পক্ষ থেকে অনেক রিকোয়েস্ট করলেও ফেল হওয়ার সাথে আমার মন খারাপ হবে চিন্তা করে ভাইয়া এসে বললো সুরাইয়া তুই চিন্তা করিস না তোর এমন হলুদ অনুষ্ঠান করমু যে বরং পক্ষ টাষকি লাইগা যাইবো। আসলেই বরপক্ষ থেকে কেউ না আসলে ও আমার হলুদের অনুষ্ঠান অনেক সুন্দর হয়েছিল সব কিছু মিলিয়ে ।রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে ঐ অনুষ্ঠান। হলুদে অনেক লোক আসছিল গ্ৰুপে গ্ৰুপে জিলুর বান্ধবীদের আমার বান্ধবী দের এবং তিন জন বন্ধু ভাইয়াদেরগ্ৰুপ মনির এর গ্ৰুপ এসে ছিল কিনা মনে করতে পারছি না। ভাড়াটিয়ারা।পাড়া প্রতিবেশী সবাই মিলে অনেক লোক হলুদের খাবার মেন্যু ছিল ভাইয়া দারা সিলেক্ট করা পরটা আর গরুর মাংস ভুনা।
সব আয়োজন ই করে ছিল ভাইয়া তার ডিরেকসনে এবং আমার যে মন খারাপ না হয় তা ভেবে তাই দিলু মনির স্পেসালি ভাইয়া কে আবার ও অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা ও দোয়া সবার জন্য।
আজ আমার জন্য একটা ইমোশনাল দিন অনেক সৃতি অনেক ঘটনা চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। আব্বা আম্মার কথা বিশেষ করে। মনে আছে আমার হলুদের দিন ও আব্বার অফিস ছিল আব্বা একটু দেরি করে বাসায় আসে। আম্মা ও যথারিতি সকল দিকের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আব্বা আসার অনেক ক্ষন হয়ে যাওয়ার পরও অনুষ্ঠান শুরু করা যাচ্ছিলনা কারন আব্বা আস্তে চায়না। আসলে চায়না বলাটা মনে হয় ঠিক হলনা। আব্বা তার কমন অথবা প্রিয় কাঠের চেয়ারে বসে কাঁদতে ছিল তাই তাকে আনা যাচ্ছিলনা পরে জুলেখা খালাম্মা এসে ধমকিয়ে আব্বাকে উঠান। কাপড় চেঞ্জ করার ব্যাপারে আব্বার বরাবরই অসুবিধা ছিল তা ও করানো গেল জুলেখা খালাম্মার ধমকের মাধ্যমে। তার পর ই অনুষ্ঠান শুরু হয় আব্বা আম্মার হলুদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আমি আজ তাদের কে খুব ই মিস করছি আমার চোখ কিছু ক্ষন পর পর পানি তে ভরে উঠছে । রাব্বির হাম হুমা কামা রববাইয়ানি ছগিরা।
মনির
এটাতো 🤔 ঠিক আমার ক্ষেত্রে যায় না, আর ঐদিন টার কথা মনেরাখার কথাও না, কারন আমরাতো শুধুই বন্ধু ছিলাম, বেপারটা ডে বাই ডে হয়ে গেছে। তবে ঠিক কবে বুঝলাম সামথিং গড়বড় সেটা বলতে পারি, আমরা জুয়েলের পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় ছিলাম সবাই, সবাই বলতে পপি,রুবা,বিকাশ শুভ্র আকাশ আমাদের কলেজ গ্রুপটা, ঐদিন জুয়েলের বার্থডে ছিলো। আড্ডার পুরাটা সময়ই রুমানা বেশ চুপচাপ, বন্ধুরা জিগায় কিরে কি হইছে ওর?? আমিতো অবাক ওকে জিজ্ঞেস কর, আমারে জিগাসকে, যাই খানাদানা শেষ যে যার বাড়ী ফেরা পালা। রুমা আর আমি একই সাথে ফিরতাম যেহেতু তুলনামূলক কাছাকাছি ডিস্টেন্সে ছিলাম ও দয়াগন্জ চলে যেতো আমি সায়দাবাদ থেকে বাসায় চলে আসতাম। সেদিন জুয়েলের বাসা থেকে বেড় হয়ে গ্রীন সুপার মাকেটের আগে মহিলা হোস্টেলের সামনে এসে ভাবছি কিভাবে ফিরবো, বললাম ফার্মগেট থেকে বাস নিবো নাকি এখান থেকে টেম্পোতে এলিফেন্ট রোড তারপর রিকশা?? রুমা বলল একভাবে গেলেই হয়। কি যেনো ভাবতেছিলো আল্লাহই জানে ডিসিশন নিলাম এলিফেন্ট রোড থেকে রিকশায় ফিরবো এরজন্য টেম্পো ধরতে হবে রাস্তার ঐপাশ থেকে। যারা জানো ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেট এর টেম্পো গুলো তখন রাস্তায় চলেনা রীতিমতো উড়ে, আমরা দেখেশুনে রাস্তা পার হবো দাড়ায় আছি এরমধ্যে ম্যাডাম চললেন, আমি পাশে তাকায়া দেখি উনি নাই!!! কই?? উনি রাস্তা পাড় হইতাছেন কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই কিছুটা আনমনে পথচলার মতকরে, আমি ঠিক কি করবো বুঝে উঠার আগেই দুইপাশের দ্রুত গতিতে চলমান কিছু গাড়ীর জন্য আর এগুতে পারিনা, কিছুটা পাজেল্ডই মনে হচ্ছিলো ঐ মুহূর্তে হঠাৎ ফার্মগেট সিনেমা হল টার কাছথেকে দ্রুতগতিতে একটা টেম্পো আসতে দেখি আমার কেনো যেনো মনেহয় এই বুঝি দূর্ঘটনা ঘটতে চলল, হার্টবিট বাড়তে থাকে পুরা ঘটনাটাই ঘটতেছে মুহূর্তে আমি উপায়ান্তর না দেখে খুব আমার আছে খুব জোরে চিৎকার করে উঠি, এতো জোরে চিৎকার করি যে চলমান গাড়ীগুলা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ব্র্যাক করে, ম্যাডাম সম্ভিত ফিরে পান ঐ দ্রুতগামী টেম্পোর ড্রাইভার কিজানি বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে যায় আমি দৌড়ায় গিয়ে হাত ধরে রাস্তা পার হই। আর এই হাত ধরাটাই সর্বনাশ হইছিলগো সুরাইয়া আপা
গল্পের নাম - ইকারতা মা ইকারতা!
২০২০
আদ্দিস আবাবা, ইথিয়পীয়া।
ডুকেম ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন এর রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি আর আনমনে বিভিন্ন কথা ভাবছি,
করোনা কাল!
জুলাই মাসের এক বিকাল।
কি এক আশ্চর্য সময় যাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে!
সারা দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গেছে। কেউ নিরাপদ না।
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ গেল একটা মোরগ ফুল গাছে। এই গাছ আজকাল আর দেখা যায় না ঢাকায়। গাছ টা দেখে আমার আম্মার কথা মনে পড়ল। আমি তখন সম্ভবত ক্লাস সিক্সে পড়ি। আম্মা সব সময় ই গাছ পালা ফুল ফল শাক সব্জির বাগান করার সখ ছিল। আমাদের উঠানে আম্মা ফুল ও ফলের গাছ লাগিয়ে ছিল। তার মধ্যে এই মোরগ ফুল গাছটা ছিল।
আমি ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা টিয়া পাখি এনে পালতে শুরু করলাম! পাখির যত্নের কিছুই বুঝি না, জানিনা! সারাদিন পাখিটা খাচায় বন্দী থাকে, আর আমি মজাসে স্কুলে যাই, খেলতে যাই, পাখিটা যে কস্টে আছে আমার সে দিকে খবর নাই!
এটা যে পাখির উপর অত্যাচার হচ্ছে সেই ভোধ আমার তখন ছিল না!
আম্মার কিন্তু টিয়াপাখিটার জন্য মায়া লাগতো।
মা জননী আমার!
স্মার্ট একজন মানুষ ছিলেন।
তো একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি, পাখিটা নাই!
খাচা খালি!
কি হইল?
আম্মা প্রথমে কিছু না বললেও শেষে বলেন, পাখিটা সারাদিন খাচায় কস্ট পায়, তুই ঠিক মত যত্নও করছ না, বনের পাখি! আমি ছাইরা দিছি।"
কথা শুনে আমার খুব রাগ হলো, আমি আম্মাকে কিছু না বলে আম্মার বাগানের পুইশাক গাছ, জবা মোরগ ফুল গাছ সব কাইট্টা সমান কইরা ফালাইলাম!
আমার মমতাময়ী মা সেদিন আমার অবুঝ রাগ দেখে কিচ্ছু বলেন নাই!
চুপচাপ ছেলের ছেলেমানুষী একগুঁয়েমি সহ্য করেছিলেন।
আজ এই মোরগফুল গাছ দেখে মনে পড়ল, জীবনেও সেই বাগানের গাছ কাটার জন্য মায়ের কাছে মাপ চাই নাই!
বলি নাই - মাপ কইর মা, আমি সরি।
এই দেশে সরি শব্দটা খুব সুন্দর।
ইকারতা - সরি।
আজ মনে মনে মাপ চাই মায়ের কাছে।
ইকারতা, মা ইকারতা।
তখন
১৯৭৯/৮০
গুরিগাও।
নান্নু দাদার বাড়ির পাশে প্রাইমারি স্কুল মাঠ পেরিয়ে জহির হেটে যাচ্ছে চাচাত ভাই শফিকের সাথে। শফিক নুরুল ইসলাম এর বড় ভাই সিরাজুল এর ছেলে। দুজনের মধ্যে এক বছর ব্যবধান। শফিক ছোট কিন্তু সাস্থ ভালো , জহির হ্যাংলা পাতলা ।
নুরুল ইসলাম সপরিবারে গ্রামে এসেছে। একটা জরুরি প্রয়োজন! তাদের ছোট মেয়ে দিলু অসুস্থ! এবং অসুখটা বিচিত্র! ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ কান্না করে। সব শিশু ই কান্না করে, কিন্তু ওর কান্না একটু অন্যরকম। মেয়েটা কান্না শুরু করে টাসকি খেয়ে যায়!
দম আটকে যাওয়ার মত হয়!
এই সমস্যা আগে ছিল না দিলুর।
কয়েক দিন আগে নুরুল ইসলাম এর একটা বড় বিপদ গিয়েছে। ঢাকায় তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে! সেই সময় ডাকাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর থেকেই মেয়েটা চমকে চমকে উঠে! তখন থেকে এই কান্না সমস্যার শুরু।
বিভিন্ন ডাক্তার দেখানোর পরও কোন উপকার না হওয়ায় নুরুল ইসলাম আত্তিয়দের পরামর্শে গ্রামে এসেছে।
সবাই বলল, গ্রামের খরম হুজুরকে দেখাইতে। খরম হুজুর নিদান দিলে দিলুর অসুখ ভালো হয়ে যাবে।
সেই খরম হুজুর এর কাছে যাচ্ছে জহির। পরা পানি আর তাবিজ আনতে! হাতে পানি ভরা গ্লাস নিয়ে হাটতে সমস্যা হচ্ছে। খলি পানি ছলকে পরে যায়।
খরম হুজুর এর বাসায় যেতে হয় কবরস্থানের পাশ দিয়ে! ভয়ে তাই জহিরের অবস্থা খারাপ। কিন্তু শফিকের কোন বিকার নাই! কবরের পাশ দিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার ই না!
তার উপর আছে সয়ং খরম হুজুর! ইয়া লম্বা! সাদা লুংগি আর সাদা চাদর পরে সব সময়। কথা খুব কম বলেন।
পুরো বাড়িতে আর কোন জনমানুষ নাই! নিজেই রান্না করে খায়, কোন বাড়ি থেকে কেউ কিছু দিলে নেন না!
সব সময় খরম পায়ে চলেন বলে এই গ্রামের সবাই তাকে খরম পীর ডাকে।
সবার বিস্বাস খরম পীর এর নিদান ধনন্ত্ররি!
" ভাই, ডুরাইয়না, আমি আছি লগে " শফিক জহিরের অবস্থা দেখে বলে।
জহির কোন কথা না বলে মাথা নারে। চুপচাপ হেটে কবরস্থান পেরিয়ে হুজুরের বাড়ির উঠানে গিয়ে দাড়ায় দুই কিশোর।
শফিক ডানে বামে তাকিয়ে সালাম দেয়- দাদা, আসসালামু আলাইকুম, বাইত আছ নি? আমরা আইছি! "
ঘরের ভেতর থেকে থেকে কোনো জবাব আসে না!
জহির ভয়ে ঢোক গিলে।
" চল যাইগা , মনে হয় কেউ ঘর নাই!"
"উবান, " শফিক বলে " হুজুর মনে হয় ঘর ধেনো বইছে, চলেন বিতরে গিয়া দেখি।"
" তুই ভিতরে যা, আমি এইখানে দাড়াই" দ্রুত মাথা নেরে জহির বলে!
" আইচ্ছা, আমি গিয়া দেহি, আমনে উবাইন" বলে শফিক জহিরের কাছ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঘরের ভেতরে যায়। খরম হুজুরের ঘরের দরজা সব সময় খোলা থাকে।
দাদা কই" শফিক ডাক দেয় আবার।
একা জহিরের উঠানে দাড়িয়ে থাকতে আরো বেশি ভয় লাগে! পুরো বাড়ি শুনসান, পাশে কবরস্থান।
ভাগ্য ভালো শফিক তারাতাড়ি ই বেড়িয়ে আসে, হাতে নারিকেল নারু!
" লও হাও, খরম দাদা দিছে! এই তবারুক হাইলে বুদ্দি বারবো, পড়া মুখস্ত হইব, তাগদা হাও।"
দম নিয়ে শফিক বলে - ইকটু দিরং অইব, হুজুরের শইল বালা না।"
জহির চুপচাপ নারু হাতে নেয়।
কিছুক্ষণ পর দুজন পানি পড়া আর তাবিজ নিয়ে বের হয়।
নান্নু দাদাদের বাড়ি পেরিয়ে জহির হাপ ছেরে বাচে!
এক দৌড়ে হান্নান কাকা আর হামদু কাকার বাড়ি পেরিয়ে ওদের দাদার বাড়ির উঠানে পৌঁছে।
" আম্মা! " জহির চিৎকার দেয় " তাবিজ আনছি!"
ডাক শুনে রফিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন সুরাইয়া আর দিলু।
শিফন শাড়ির আঁচল গুছিয়ে রফিয়া বলে - বাজান আনছস তাবিজ, দে তোর দাদিরে নিয়া দে।"
সবাই মিলে দাদির ঘরে ঢুকে।
অত্যন্ত যন্তের সাথে দাদি দিলুকে কোলে নিয়ে সাবধানে তাবিজ পরিয়ে দেন।
এক ঢোক পড়া পানিও সাথে সাথে খাইয়ে দেন।
আল্লাহর অশেষ রহমতে এর পর দিলুর কান্নার মধ্যে টাসকি খাওয়ার রোগ ভালো হয়ে যায়।
সুরাইয়া
আজ আবার কিছু কথা সেয়ার করতে ইচ্ছে করছে! ছোট্ট বেলা থেকেই দিলু আমাদের সবার প্রিয় তাই ওর যখন মন খারাপ থাকে বা চুপচাপ থাকে তখন আমাদের কারো কাছে ই ভালো লাগে না। বিশেষ করে আমার কাছে আমি এটা নিতেই পারিনা। ভাইয়া তোর মনে আছে কিনা জানিনা ছোট বেলায় ওর মন খারাপ দেখলে বাইরে নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে আনতি। অর্থাৎ দিলুর মন ভালো করার চেষ্টা করতি। তাই বলে যে আমার প্রতি ও যে তোর খেয়াল কম ছিল তাও নয়। মনে পড়ে ছোট্ট বেলায় আমার মারত্মক টাইফয়েড জ্বর হয়ে ছিল। তাই আমি বিছানায় শুয়ে থাকতাম তুই যখনই ঘরে ঢুকতি দেখতি আমি শুয়ে আছি। তুই আমার দিকে তাকিয়ে বলতি ছুড়ি পেটলি তুই বুমা। তূই ঘুমা এর জায়গায় ইচ্ছে করে আমাকে চেতানোর জন্য বুমা বলতি।যাই হোক সেদিন তোর কি মনে হলো তুই আমার দিকে ভালো করে দেখে বললি কি সর্বনাশ তুই তো একেবারে খাটের সাথে মিশে গেছস। কি হইছে তোর? আমার মনে হয় এই প্রথম তুই জানতে পেরেছিলি যে আমার টাইফয়েড জ্বর হয়েছে। তুই আমার কাছে এসে বসে বললি কিছু কি খাবি খেতে ইচ্ছে করে এনে দেব? আমি বললাম না রুচি নেই। ছোট বেলা থেকে আমার বিয়ে হওয়া পর্যন্ত জীবনের কোনো ডিসিশন আমাকে নিতে হয়নি ।সে জন্য আমি সারাজীবন তোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ভাইয়া মনে পড়ে তোদের টেকনাফে যাওয়ার কথা তোরা ঝড়ের মধ্যে পড়ে ছিলি লিংকু ভাই পাঁচ শত টাকা দিয়ে হেলিকপ্টার ভাড়া করে চলে আসতে চাইল। অনেক কষ্ট করে তুই বাসায় ফিরে সোজা গিয়ে পড়লি আম্মার কোলের উপর।বললি আম্মা শুকুরানা নামাজ আদায় করো তোমার ছেলে জীবীত ফিরে এসেছে। আজ এটুকুই, ভাইয়া, তোর লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
মনির
এটা ঠিক আমাদের জন্য ভাইয়া সব সময় কিছু না কিছু করার চেস্টা করতো, যেমন নিজে কিছু রান্না করলো অথবা বাহির থেকে খাবার নিয়ে আসলো, আমাদের মত ফ্যামিলিগুলোতে তখন বাহির থেকে কিছু শুধু মেহমানরা ই আনতো অথবা মিলাদের মিস্টির প্যাকেট। আমার এখনও মনে আছে, ভাইয়া একবার কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে আসলো তাও আবার বেইলি রোডের সুইস থেকে। কি সুন্দর কাগজের প্যাকেট ঐ প্রথম আমি স্যান্ডউইচ খেলাম, চিকেন প্যাটিস এতো মজাহয় এটাই জানতামনা। এই গল্প আমি রুমার সাথেও করছি বেশ আগে।সুইস তখন উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে দের একটা ট্রেন্ড প্লেস। আর ভাইয়ার রান্নার বেপারটাতো তোমরা ইতিমধ্যে জানোই।
যখন
১৯৮২
জহির আর সোহেল এর নাচ দেখে মেজোমামা আলিম হতভম্ব!
তার সামনে জহির আর সোহেল গান গাইতে গাইতে নাচছে।
"চুপিচুপি বল কেউ জেনে যাবে, জেনে যাবে কেউ জেনে যাবে " সোহেল গায় আর নাচে। ওর সুর ভালো।
পাশে জহির ও গাওয়ার চেস্টা করে - ভয় করি না তো কোনো কিছু, যদি তুমি আমি রই একসাথে! "
আলিম মামা আশ্চর্য হয়ে ওদের দুজনের নাচ দেখে!
" আফা, আশ্চর্য কান্ড! এই দুইটা তো দেহি হুবহু জাভেদ আর ববিতার মত নাচতাছে! "
আলিম মামা রফিয়াকে ডেকে বলে।
রফিয়া রান্নাঘর থেকে উত্তর দেন - হ, সিনামা আর টিবিতে যা দেখবো সেইটা এক্কেরে টায় টায় করতে পারে, কিন্তু পড়ার বেলায় গোল্লা!"
সোহেল চোখ বড় করে জহিরের দিকে চেয়ে ইশারা করে। কি?
জহির মাথা নারে, ঘটনা কি ওরা দুজনেই জানে!
এরপর নাচ গান জমে না, খেলা শেষ!
গতকাল আলিম মামা জহির আর সোহেল কে নিয়ে মধুমিতা হলে "নিশান " ছবি দেখতে গিয়েছিল, তারই আলাপ চলছিল মামা আর ভাগ্নেদের মধ্যে।
" দেখি তরা, জাভেদ এর গান টা গা ত পারছনি দেখি " আলিম মামা ওদের সাথে ঠাট্টা করছিলেন, কিন্তু ওরা যে সত্যি ই পারবে ধারনা ছিল না।
ভাইগ্নারা ত দেহি বেডা এনা!
আলিম মামা জহিরদের বাসায় এসেছেন আজ প্রায় দেড় মাস। মামা এসেছেন একটা প্রয়োজনে। তাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে!
বিয়ের পর পর নুরুল ইসলাম এর শশুর বাড়ির সেই মুরগী কাটার ঘটনার পর থেকে ওদের মধ্যে শালা দুলাভাই এর মধুর সম্পর্ক আর হয়ে উঠেনি!
কিন্তু এবার আলিমকে জরুরি তলব করে আনা হয়েছে।
হয়েছে কি জহির মোটামুটি ভালো ছাত্র হলেও এবার দিতিয় সাময়িক পরিক্ষায় অংকের রেজাল্ট দেখে সবাই অবাক!
মাত্র সাতাইশ! আয় হায়!
কি করা যায়?
লেখা পড়ার এই অবস্থা হইলে তো সর্বনাশ!
গৃহ শিক্ষক রাখা এই মুহুর্তে সম্ভব না, রফিয়ার সাথে পরামর্শ করে নুরুল ইসলাম আলিমকে খবর দিয়ে আনিয়েছে।
আলিম বার্ষিক পরীক্ষার আগে যদি ভাগিনাকে কয়েক দিন পড়িয়ে মানুষ করতে পারে। নইলে তো ভবিষ্যৎ ভালো দেখা যাইতেছে না!
তো আলিম আসার পর থেকে জহিরের জীবন পুরো তামা হয়ে গেছে!
কোন খেলাধুলা নাই, শুধু স্কুল আর পড়া! জিন্দেগী পুরা তেজপাতা!
আলিম মামার উপর দিয়েও বলা যায় ঝড় গিয়েছে।
দুলাভাই একটা দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটার সম্মান রাখতে হবে না!
প্রতিদিন জহিরকে নিয়ে কঠিন রুটিন করে পড়িয়েছেন । মামার বয়স ও খুব বেশি না, মাত্র মেট্রিক পাশ করেছেন।
এক তরুন আর এক কিশোর এর একটানা কঠোর নিয়মিত পড়া লেখার পর গত পরশু পরীক্ষা শেষ হয়েছে!
রফিয়া বলল - যা, মামা ভাইগ্না অনেক কস্ট করছস, কালকে গিয়া সিনামা দেইক্ষা আয়।"
সেই জন্যেই কাল ছবি দেখতে যাওয়া! দিনগুলো কিভাবে কেটে গেল আলিম বলতেও পারবে না।
আগামী কাল আলিম বিবাড়িয়া চলে যাবে, ভাবতে ই জহিরের চোখ ভিজে আসে!
....
কয়েক দিন পর ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়! জহির প্রথমে অংকের নাম্বার দেখে।
সাতাশি!
জহির দৌড়ে রফিয়াকে নিয়ে রেজাল্ট দেখায়।
রফিয়া ছেলের রেজাল্ট কার্ড হাতে নিয়ে তার ভাই আলিমের জন্য দোয়া করেন।
আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন।
আয় আল্লাহ তুমি আমার ভাইয়ের ইজ্জত রাখছ, তার পরিশ্রম সার্থক হইছে!
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন," তুই অনেক কস্ট করছস বাবা, এইজন্য দেখ, রেজাল্ট ও কত ভালো হইছ! "
খুশিতে জহিরের বুক্টা ভরে উঠে।
মেজমামা দেখিয়ে দেয়া সেই পড়াশোনা পরবর্তীতে জহিরের জীবন বদলে দেয়।
এরপর থেকে জহির আর কখনো কোনো পরীক্ষায় ফেল করেনি!
জহিরের বউ পারভিন
~ তোমার ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখার ঘটনা ~
দিনটা ছিলো শুক্রবার। সোহেলভাই আর তোমার ভাই বড় আপার বাসায় গিয়েছিলো। বড় আপা দুপুরবেলা খাবারের পর আমাকে হঠাৎ বলে,"পারভীন শুন,জহির তোকে দেখতে আসতেছে।" "কি বলো আপা?মামি,দিলু না দেখে গেলো?" তখন আপা বলে,"ছেলের দেখার দরকার আছে না?" তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। আমার তখন মনে ভয় ছিল যে কি প্রশ্ন করবে আল্লাহই জানে। ঐসময় আমার ভিতরের পরিস্থিতির কথা বলে শেষ করা যাবেনা। এর মধ্যে বড় দুলাভাই বলে,"ভয় পাওয়ার দরকার নেই,আমি আছি না?"
এখনো আমি লিখতে গিয়ে আমার হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
তারপর,তোমার ভাইরা আসেএবং ড্রইংরুমে বসে।আপা আমাকে তোমার ভাইয়ের বর্ণনা দিয়েছে। ছেলে হাফহাতা শার্ট পরে আছে। প্রথম যখন রুমে ঢুকে সালাম দেই, তোমার ভাইয়ের সাথে তখনি প্রথম চোখাচোখি এবং খুব ভালো লাগলো তোমার ভাইকে দেখে আমার। সোহেল ভাই জিজ্ঞেস করলো, "কিসে পড়েন?" বললাম,"ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ার" তারপর আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে নাই। এর মধ্যেই বড় আপা চা-নাশতা নিয়ে আসলো। আপা বল্লেন, "তোমাদের বাসায় কত আসা যাওয়া করেছি। এখন তো যাওয়া হয়না। তোমার ভাই বললো," ইনশাআল্লাহ এখন থেকে যাবেন।" এই কথা নিয়ে হাসাহাসি করলেন আপারা।
তোমার ভাই যখন এসে পড়ে, তখন যে আমার কি খারাপ লাগতেছিল,বলার মতো না। এরপরে আমি বারান্দায় গেলাম তোমার ভাইকে দেখার জন্য। দেখি,ঠিক যাওয়ার পরপরই তোমার ভাইও উপরে তাকালো। আমি লজ্জায় চলে আসলাম এই ভেবে যে,কি মনে করবে!
জানো,এই প্রথম দেখায়ই তোমার ভাইয়ের প্রেমে পরে গেলাম।
বিয়ে
আচ্ছা বিয়ে দিনের ঘটনা। রমনা চাইনিজে আমার বিয়ে হয়।যখন বরযাত্রা চলে আসছে গেইটে তখন সবাই বলে, আর জামাই কে নিয়ে আসে।বড়ভাই বলেন গেইটে কোনো রকমের ঝামেলা করবানা।বড়ভাই তোমরা যাওয়ার সাথে সাথে খাওয়ার টেবিলে বসাইয়া দিলেন। তোমরা বসার পরে, তোমার ভাইয়ের সাথে আমাকে বসাইল।খাওয়ার সময় তোমার ভাই আমার সাথে কতো দুষ্টামি করল।যাক দুষ্টামি করাতে সবাইর ভালো লাগছে। আমার ফেমেলির সবাই ভাল বলছে তোমার ভাইকে। জামাই নাকি মজার মানুষ হবে। সত্যিই আমার স্বীকার করতে হবে, তোমার ভাই মজার মানুষ। আচ্ছা সব শেষে যখন তোমাদের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম তখন তোমার ভাই গাড়ির ভিতরে কি মজাটাইনা করলো। তোমাদের মনে আছে কি-না জানি না।আমি কান্না করতেছিলাম তখন তোমার ভাই বলে আইসক্রিম খাবা না চকলেট খাবা? এই নিয়ে কতো না মজা করলো। আসলে কি তোমার ভাইয়ের মজার ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না।
#####
জান মনির, মা আর দিলু আমাকে কিভাবে দেখতে গিয়েছে। একদিন সকাল দশটা বাজে আপার বাসায় গিয়ে কোলি্ংবেইল দেয়।আবার লুকিংগ্লাসে হাত দিয়ে রাখছে দেখে দেখতেও পারতেছিনা। তারপরে আমি দরজা খুলে ফেললাম,যেহেতু আপা বাসায় আছে,আমার কোন ভয় নেই। তখন আপা স্কুলে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিলেন,আমি আপাকে গিয়ে বলি,আপা দেখ কে এসেছে, আমি চিনিনা। আপা মা আর দিলুকে দেখে অবাক হলেন। 'মামি আপ্নি?আমাকে আসার আগে সংবাদ দিবেন না?' মা বলে,'সংবাদ দেওয়ার দরকার কি?তুমি তো আমাকে চিনোই।' চা-নাস্তার পর মা আমাকে বলে, 'পান দাও' দিলু বলে,'আপনি সুপারি কাটতে পারেন?' আমি বল্লাম,'পারি,অল্প'
বললো 'অসুবিধা নাই,আস্তে আস্তে শিখে ফেলবে'
মনির,তোমার সাথেও দিলু যেমন মজা করছে,তেম্নি প্রথম দিন আমার সাথেও মজা করছিলো। এই ঘটনা দিলুর মনে আছে কিনা জানিনা
সুরাইয়া
স্মৃতির যন্ত্রনায় তাড়িত হয়ে ই এই লেখা তাই ভুল ত্রুটি হয়ে গেলে আগে ভাগেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এবার আসল ঘটনায় আসা যাক। ছোট বেলা থেকে ই একটা কথা আব্বা কে বলতে শুনেছি আমাদের জেঠি প্রসঙ্গে আব্বা বলতেন গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলে ও নাকি তার মানে জেঠির ঋন ষোধ করা যাবে না। আম্মা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর দিলু ঠিক করল জেঠিকে দেখতে যাবে শুনে আমি ও যেতে চাইলাম আব্বা ও যেতে চাইল এবং পরে ভাবীও যাবে বলল।যাক প্ল্যান মত সবাই রেডি হয়ে সকাল দশটায় কি সাথে দশটায় রওনা দেওয়া হলো দিলুর গাড়ি নিয়ে।গন্তব্য উত্তরখান ইয়ারপোর্ট রোড পার হয়ে আরও সামনে শফিক ভাই এর বাসায়।জেঠি তখন ঐখানেই ছিলেন। শফিক ভাই কে আগেই ফোন করে বলে দেওয়া হয়েছিল। দিলু আমাদের বাসার সামনে থেকে ই কিছু ফল কিনে নিয়েছিল ওদের জন্য। প্রথমে ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হলে ও পরে শফিক ভাই কে ফোন দেওয়াতে উনি এসে আমাদের কে নিয়ে যান। পৌঁছতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল।জেঠির শরীর তখন মোটা মুটি ভালো যতটা খারাপ ভেবে ছিলাম ততটা নয়। তাছাড়া জেঠির একটা হাঁপানির সমস্যা উনার সব সময় ই ছিল।যাক সবার সাথে ভালো মন্দ কথা বার্তা আদান-প্রদান করার পর খাওয়া দাওয়ার পালা। খাওয়ার আয়োজন ভালো ই।সব কিছু ই ছিল । পোলাও মাছ মাংস ডিম সবজি ও সালাদ সবই আছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা এক এক জন এক এক রুমে বসে গল্প করছি। কিছু ক্ষন পর আমাদের ফিরে আসার সময় হয়ে এল আব্বা ও স্বভাব সুলভ অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকল। আমি ও দিলু জেঠির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম জেঠি কিছু কিনে খাইয়েন। ঠিক ঐ সময় আব্বা তার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট জেঠির হাতে দিয়ে বলল এটা আমার তরফ থেকে রাহ পান টান। কিননা খাইও।আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আব্বার দেয়া ঐ পঞ্চাশ টাকা জেঠির কতটা ঋন ষোধ করতে পেরেছিল জানিনা। কিন্তু আমার মনে হয় আব্বা জীবিত থাকা অবস্থায় ই তার সমস্ত ঋন ষোধ করে গেছেন। এবার আমাদের পালা।
জহির
সুরাইয়া, তোকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবেনা এইসব মধুর স্মৃতি লেখার জন্য।
আমি একবার রফিক কাকার শশুর বাড়ি থেকে মাত্র খেয়ে আসার পরও আমাকে আবার কবুতরের মাংস দিয়ে ভাত খেতে বাধ্য করেছিলেন!
এই ঘটনা খুবই মজার।
সুযোগ হলে উপন্যাস এর ভেতর লিখবো ইনশাআল্লাহ।
একান্নবর্তী পরিবার থাকা অবস্থায় দেখেছি জেঠি ফজরের আজানের আগে উঠে পাকঘরে ঢুকতেন, আরে বেরুতেন রাত্রে এশার নামাজের পর।
খেতেন সবার শেষে গোপনে যেন খেতে গিয়ে অপরাধ করছেন!
আম্মা যখন গুরিগাও ছিল, জেঠি খুব হেল্প করতেন।
সুরাইয়া
আজ কিছু টুকরো স্মৃতি স্মরন করা যাক তখন বিটিভিতে মমতাজ উদ্দিন এর জব্বার আলি নামে একটা নাটক দেখাত নাটকে জব্বার আলি তার চার ছেলে মেয়ের নাম ধরে তার বউকে ডাকতেন যেমন জবা কুসুম রোকন দুলালের মাউ বলে উচ্চ স্বরে ডাক দিতেন। নাটকের এই ডাকটা আমার খুব পছন্দ ছিল।নাটকটা ঐ সময় দেখতনা এমন মানুষ মনে হয় কমই পাওয়া যাবে। আমরা সবাই মিলে অর্থাৎ আব্বা কে নিয়ে নাটকটি দেখার পর আমি আব্বাকে বলতাম আব্বা আপনেও আমগোরে এই ভাবে ডাকতে পারেন না যেমন জহির সুরাইয়া দিলু মনিরের মা।কি খালি জহিরের মা জহিরের মা বলে ডাকেন মা কি খালি জহিরের আমাদের না। এখন থেইকা চার জনের নাম ধরে ডাকবেন আর নাইলে জহিরের মা বলে ডাকতে পারবেন না। আব্বা হাসি দিয়ে বলত মাইও মুহেদা আইয়েনা অভ্যাস হইয়া গেছে।
শুক্রবার মানে আব্বার অফিস বন্ধ। মানে পরিবারের আনন্দের দিন। আব্বা সকাল থেকে জুম্মার নামাজের আগ পর্যন্ত এক বাজার তিন চার বারে করতেন। আমার মনে হয় আব্বা এটা ইচ্ছা কৃত করতেন নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য।কাছকি মাস আব্বার অতি প্রিয় ছিল রাস্তাদিয়ে বাসায় আসার সময় যদি দেখতেন এই মাস নিয়ে বসে আছে তক্ষুনি তা কিনে নিয়ে আসতেন এসে যথারীতি আম্মা কে ডাক দিতেন জহিরের মা জলদি আইও একটাতো কাম করছি । আব্বা কিছুটা হাসি কিছুটা অপরাধ বোধ মিশ্রিত হাসি দিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকত। আম্মা মাছের অবস্থা ভালো হলে কিছু বলতো না কিন্তু বেশিরভাগ ই মাছ নরম হইত। আম্মা আব্বা কে উদ্দেশ্য করে বলত এইডা কি আনছ।মাছতো নরম? আব্বা নির্বিকার হাসি হেসে বলতেন দুনিয়ার মানুষ লাইন ধইরা নিতাছে। আমি কি পেডের ভিতরে ঢুকছিলামনি।
শুক্রবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে আমাদের দুই বোনের মধ্যে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়ে উনার পাকা চুল বাছতে দিতেন বলতেন পঞ্চাশ টা চুল বাছতে পারলে পঁচিশ পয়শা। আমরা দুই বোন আব্বার সাথে বারগেনিং করতাম।বলতাম আব্বা আট আনা দিবেন। আব্বা রাজি হতো না হাসি দিয়ে বলত না চাইলে আনা। দিলু প্রায়ই আব্বার মাথায় দু একটা বিলি দিয়ে বলত আব্বা আমার পঞ্চাশ টা হইছে আমারে চাইল আনা দেন আব্বা দিয়ে দিত ও চলে যেত।পরে আমি একাই আব্বার পাকা চুল বেছে দিতাম বেশির ভাগ ই এমন হতো আমার পয়শার কোন হিসাব থাকতনা আমি চুল বাছতে থাকতাম আব্বা আরাম করে ঘুমাতেন।
শুক্রবার দুপুরে বাংলা ছবি দেখাত ছবির গানের সাথে কিরকম যেন একটা অঙ্গ ভঙ্গি করে আব্বা কে আমি নাচতে দেখেছি । আব্বা নাচত আর বারে বারে আর চোখে আম্মা কে দেখতেন আমরা আব্বার ঐ হাস্যকর অঙ্গ ভঙ্গি ওয়ালা নাচ দেখে অবাক হতাম আর হাসতাম।
ঈদ এলে বিশেষ করে কোরবানির ঈদে আমার মনে হয় আমাদের চাইতে আব্বারা মজা করত বেশি। অর্থাৎ এলাকায় আব্বার সম বয়সিদের একটা গ্ৰুপছিল।তাদের আবার এক একজনের এক একটা নাম ছিল।যেমন আব্বার নাম ছিল ডক্টর সাব সাথির আব্বার নাম ছিল বাকি সাব।আর একজনের নাম ছিল ভর্তা কম্পানি এরকম আর কি।বাবারা এক এক বেলা এক একজনের বাসায় দাওয়াত খেতেন।আরকি আজ এটুকুই।
জহির
বাত্তাম গোঞ্জ। আর জব্বার আলি আমজাদ হোসেন এর লেখা ও পরিচালনা, মমতাজ উদ্দিনের না। চমৎকার সৃতি!
যখন রবিবার ছুটি ছিল- আব্বা বিকাল বেলা বারান্দায় এক পায়ের উপর আরেক পা বাকিয়ে বিচিত্র ভংগীতে চেয়ারে বসতেন, আম্মা আমাদের মুরি ভেজে দিত, সবাই মিলে ভাড়াটিয়াদের নিয়ে খেতাম। আহা কি মধুর স্মৃতি!
দিলু
আসলেই অসাধারন সব স্মৃতি। আমরা বকরি ঈদে কাপড় কিনে জামা বানাতাম।আর রোজার ঈদে বাইতুল মোকারম মার্কেট থেকে মার্কেটিং করতাম। বাইতুলমোকারম ছাড়া যে কোনো মার্কেট আছে তা জেনেছি অনেক পরে। এক বৃদ্ধ লোক আসতেন শাড়ি কাপড় নিয়ে। আমরা সবাই তাকে নানা বলতাম। আম্মা নানার কাছ থেকে শাড়ি কিনতেন। আমাদের যারা ভাড়াটিয়া ছিল তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আত্মীয়ের মত হয়ে যেতো। ভাইয়া মোহন কাকার কথা মনে আছে। উনারা বাসা ছেড়ে যে বাসাটায় গিয়ে ছিলেন সেই বাসাটা আমার মনে আছে। পাগলা কাকা, রানু খালা, মামুন সুমনের বাবার কথা। এরা অন্য জগতের লোক ছিলেন। অন্য রকম মানুষ। এরা সবাই আত্মীয়ের মত ছিল এর কারন আমাদের আম্মা- আব্বা। আমার বাবা মায়ের সাথে সবার সম্পর্কই এমন ছিল।
জহির
মোহন কাকা ছিলেন আমাদের প্রথম ভাড়াটিয়া। এবং উনি আমাদের দোকানের ও প্রথম ভাড়াটিয়া! খুব মজার মানুষ ছিলেন। বউটা ছিলো মাটির মানুষ, মোহন কাকা প্রায়ই বলতেন- তোমাদের কাকি পেটে ডাকছে না মেঘে ডাকছে বলতে পারে না!
সুরাইয়া
আজ ছোট্ট বেলার দুই টা ঘটনা সেয়ার করা যাক। আমার তখন বয়স কত ছিল মনে করতে পারছি না। তবে ছোট বেলা কার ঘটনা এটা নিশ্চিত। কি কারনে জানিনা বেশ কয়েক বার আম্মা আম্মা ডাকার পর আমার মনে কি রকম যেন প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেল মনের অজান্তেই হয়তো আরো কয়েক বার আম্মা বলে ডেকে ছিলাম । রান্না ঘর থেকে আম্মার উত্তর এল কি হইছে ম্যা ম্যা করতাছস কেন এত বার ডাকন লাগে নি?ঐ ছোট্ট মনে কেমন যেন একটা অজানা কষ্ট দাগ কেটে যায়। আম্মা উত্তরটা এভাবে দিল? কি কারনে ঐ দিন এভাবে ডেকেছিলাম মনে করতে পারছি না কিন্তু আম্মার ঐ নির্দয় এরমত উত্তর টা আমার ছোট্ট মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটে ছিল। আমি ঐসময় কার কষ্টটাকে যেন এখন ও ফিল করি না হলে এই ঘটনা টা আমার প্রায়ই মনে হতো না । আমার মনে হয় আর সবাই আমার মতের সাথে একমত হবে যে মা আম্মা ডাকের মধ্যে যে মধু আছে তা আর অন্য কোনো ডাকে নাই ।যেই ডাক আমরা চার ভাই বোন চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি প্রায় তিন বছর হতে চলল। তাই আমার পরিচিত সব মাদের অর্থাৎ রুমা দিল ভাবী সবার কাছে আমার অনুরোধ তোমরা সন্তান দের ডাকে বিরক্ত হয়ে কখনো এরকম করে উত্তর দিওনা বিকজ ইয়োর চাইল্ড অনলি অয়ান্টস্ ইয়োর কনসেনট্রেশন গিব দেম দ্যাট ।ইউ উইল ফিল বেটার এন্ড দে অলসো। এমন না যে আম্মা আমাদের প্রতি খেয়াল কম দিয়েছে তা কিন্তু নয় বরং আমাদের চাহিদার
তুলনায় হয়তো বেশি ই দিয়ে ছিল কিন্তু
ঐসময় কার কষ্টটাকে কেন জানিনা এখনও ভুলতে পারি নাই।
আরেকটা ঘটনা সেয়ার করা যাক।ঐসময় কেন জানিনা আম্মা কিভাবে খুশি হবে অর্থাৎ কি করলে আম্মা খুশি হয়ে বলবে মাশাআল্লাহ আমার সুরু এটা কি ভাবে করল আর আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে এমন একটা নেশা আমার মধ্যে সব সময়ই কাজ করত। সেদিন সন্ধ্যায় আম্মা আব্বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছিল । বাসায় মনে হয় আমি একাই ছিলাম। আম্মা রা বের হয়ে যেতেই আমার মধ্যে সেই নেশা চেপে বসল। আমি তারাতাড়ি বিছানা ঝাড়ু নিয়ে আব্বার রুমের বিছানা ঝাড়ু টাড়ু দিয়ে মশারী ও টানিয়ে ফেললাম । আমার স্পষ্ট মনে আছে মশারীর মাথা লাগল পেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল । বিছানার উপর মুড়া বসিয়ে তার উপর উঠে আমাকে মশারীর মাথা লাগাতে হয়ে ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ঐদিন ঘন্টা খানেক পর আম্মারা এসে পরে।এবং এসে দেখে বিছানায় মশারি টানানো দেখে আম্মা চিল্লাচিল্লি শুরু করে বলে এত তাড়াতাড়ি মশারী টাঙিয়ে ফেলল কে আমি খুবই আগ্ৰহী হয়ে দৌড়ে এসে বললাম আমি । আম্মা বলে উঠলো আর কাম পাইছস না এত তাড়াতাড়ি কেউ মশারী টানায় ।এহনো ঘুমাইতে কত দেরি আছে। আমি ঐ ছোট্ট মনে ভীষণ আঘাত বা কষ্ট পেলাম বা আশাহত হলাম। হয়তো আমার কাজটা ভুল ছিল কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল আম্মা কে খুশি করা অর্থাৎ আম্মার আদর পাওয়া। হয়নি তাই আবার ওকষ্ট ঐ ছোট্ট মনে দাগ কেটে গেল । সেই দাগ এখনো মুছতে পারিনি।ঐ ছোট্ট ছোট্ট কষ্ট গুলোকে মুছে ফেলার জন্য কোন ইরেজার পাওয়া যায় কিনা আমার জানা নেই। পাওয়া গেলে ভালো হতো।
জহির
প্রিয় সুরাইয়া, কস্ট টুকু শেয়ার করে ভালো করেছিস। আশা করি এর পর আর এই কস্টটা থাকবে না।
তুই এই দুইটা ঘটনারই ব্যাখ্যা তোর কাছে আছে। আমাদের সময় বাবা মা ও সন্তানের মধ্যে কনভারসেশন ব্যাপার টা ছিল ই না! এটা শুরু হয়েছে আমরা বড় হওয়ার পর।
আমরাও বাবা মাকে অনেক কস্ট দিয়েছি যা উনারা আমাদের শেয়ার করার সুযোগ ই পায়নি, কেউ শুনার মত ছিলো ই না। বোঝ, উনারা কত কস্ট মনে নিয়ে চলে গেছেন! তাই, বাবা মা ও সন্তান সকলেই কনভারসেশন প্রেক্টিস করা জরুরি।
যখন
১৯৮৩.
জহিরের হাটতে গিয়ে এখনো শরীর কাঁপছে।
তার উপর হাতে ভাংগা মুরগীর ডিম!
জানের ছদকা!
ছোট ভাই মনিরের জানের ছদকা। ছোট্টো মনির, মাত্র দেড় কি পৌনে দুই বছর বয়স! আজ পানিতে ডুবে যেতে নিয়েছিল!
বর্ষাকাল।
এলাকার চারিদিকে পানি উঠেছে। বাবুদের বাড়ির পেছনে খেলার মাঠ। তার একটু সামনে হিন্দু বাড়ির পাশেই পানি এসে গিয়েছে।
পানি তেমন গভীর না, তাই বাচ্চাদের খুব আনন্দ, যখন ইচ্ছা এসে ডোবাডুবি করে।
বন্যার জন্য স্কুল বন্ধ। জহির ও এসে মায়ের কাছে আবদার করে " আম্মা, বালুর মাঠে গোসল করতে যাই! "
জহির মাত্র কিছুদিন হয় সাতার শিখেছে।
ওর দেখাদেখি দিলু সুরাইয়া ও আবদার করে " আম্মা আমরা ও যামু।"
জহির সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় মাইর দেখায়।
সুরাইয়া গাল ফুলিয়ে না দেখার ভান করে রফিয়ার কাছে আবদার করতেই থাকে।
প্রায় দুপুর বেলা, রফিয়া রান্না নিয়ে ব্যস্ত, এই সময় বাচ্চাদের ঘেনর ঘেনর ভাল্লাগে!
বিরক্ত হয়ে বলেন - তরা সবটি যদি গোসলে যাস, মনিররে দেখবো কে? আমার এদিকে পুরা রান্না বাকি! "
জহির তারাতাড়ি বলে - সবাই যাওয়ার দরকার নাই, আম্মা শুধু আমি যাই!"
" না! " সারে তিন বছরের দিলু চিৎকার করে উঠে, "আমরাও যামু।"
রফিয়া চোখ গরম করে জহিরের দিকে চায়।
জহির চুপসে যায়।
সবাই জানে দিলু কানলে সমস্যা আছে।
এই মেয়ের কান্না বিরাট ভয়ংকর। পুরা এলাকা গরম হইয়া যাইব!
নাদুসনুদুস সুরাইয়া আবার বলে - আম্মা, যাই না একটু, তারাতাড়ি চইলা আসুম! "
রফিয়া কোনো উত্তর দেন না।
মিটসেফের উপর থেকে মসলার ডিব্বা নামিয়ে নিচে রাখছেন।
কোনো আশা না দেখে সুরাইয়া বলে - আম্মা, আইচ্ছা তাইলে মনিররে সাথে নিয়া যাই! "
জহির ধমক দেয় - "অই ভুটকি, মনির রে নিয়া কি করবি, অরে দেইক্ষা রাখবো কে হেহ! "
সুরাইয়ার তড়িৎ জবাব - আমরা দেখুম। "
দিলু ঘার নারিয়ে সায় দেয়, যেন সব বুঝতে পারছে, ভাব গম্ভির।
জহির বিরক্ত, বলে - আমি জানিনা। "
রফিয়া কাজ থামিয়ে ওদেরকে দিকে তাকিয়ে বলেন - শুন, যদি মনিররে নিয়া যাস, তাইলে যাইতে পারছ, কিন্তু অর দিকে খেয়াল রাখতে হইব, নাইলে কিন্তু বিপদ হইতে পারে! "
সুরাইয়া মাথা নারে।
জহির ওর দিকে চোখ গরম করে তাকায়।
মনির রে কোলে নিতে হবে ওরই! সুরাইয়া, দিলু এতদুর মনির কে কোলে নিয়ে যেতে পারবে না।
জহিরের বিরক্তি বাড়তে থাকে !
ভুটকিরে নিয়া আর পারা গেল নাহ!
রাগ উঠলে জহির সুরাইয়া কে ভুটকি ডাকে।
"আইচ্ছা চল্। "
সুরাইয়া দিলু খুশিতে লাফিয়ে উঠে!
খালি গা হয়ে জহির মনিরকে কোলে নেয়। মাশাল্লাহ ছোট্ট মনির এর সাস্থ ভালো। কিছক্ষন কোলে নিয়েই জহির হাপিয়ে উঠে!
যাই হোক তিন ভাই বোন মনির কে সাথে নিয়ে বালুর মাঠের পুকুরে গোসল করার জন্য বের হয়।
পেছন থেকে রফিয়া ডেকে বলে - জহির, বাবা মনিররে দেইখা রাখিস কিন্তু।"
সবাই একবাক্যে উত্তর দেয় - আইচ্ছা আম্মা! "
গলির বাইরে ইটের রাস্তা। কয়েক দিন আগেই রাস্তায় ইট দিয়ে বাধিয়েছে। এর আগে মাটির রাস্তা ছিলো। গাড়ি যাতায়াত করলে প্রচুর ধুলা উড়ত!
এখন শান্তি! পাভেলদের বাসার পাশে খশরু ভাইদের বাসা। এরপর ই আরেকটা গলি। এই গলিতে এখনো পানি আসেনি।
গলির ভেতরেই বালুর মাঠ। এলাকার সব ছেলেদের একমাত্র খেলার মাঠ।
মাঠ পেরিয়ে ঝুন্নু ভাইদের দোতালা বাড়ি।
তাদের দক্ষিণে হিন্দু বাড়ি৷ ছাপড়া ঘর।
হিন্দু বাড়ির পুর্ব দিকেই একটুকরো নিচু জমি।
সেটা এখন পানিতে ভরা।
সেই পানিতে মহল্লার সব শিশু কিশোর নাইতে এসেছে!
আসলে গোসল করা হয় না কারোই, পানি তেমন গভীর না, ছেলে মেয়েরা পানিতে নেমে লাফা লাফি করে মন ইচ্ছা মত। এতে ই আনন্দ।
সবাই মিলে মনির কে একটা শুকনো জায়গা দেখে বসায়।
"এএএ" মনির কেদে উঠে।
"অই চুপ" জহির ধমক দেয়, " একদম কানবিনা কইলাম। "
"এএএএ..." মনিরের কান্না আরও বাড়ে!
জহির সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে - "এখন দেখছস, কি যন্ত্রণা! "
সুরাইয়া কিছু না বলে ছোট্ট মনিরকে জড়িয়ে ধরে।
" উম্, কান্দে না, ভাই না ভালো। ওই দেখ সবাই গোসল করতাছে। "
সুরাইয়া আংগুল তুলে পানিতে দেখায়, মনির অবাক হয়ে সেদিকে তাকায়।
কান্না নাই!
তিন ভাই বোন মনির কে ঘীরে বসে।
পিছন দিকে তাকিয়ে জহির দেখে ওর বন্ধুরা পানিতে ফুটবল দিয়ে হাতবল খেলছে।
এইবারের বন্যায় এই খেলাটা নতুন শুরু হয়েছে। জহিরের আর তর সয় না, সুরাইয়া দিলুর দিকে তাকিয়ে বলে - তোরা মনিররে দেখ, আমি ইক্টু খেইলা আসি।"
"আইচ্ছা " দুই বোন শান্ত বালিকার মত বলে।
জহির এক দৌড়ে গিয়ে পানিতে নামে।
দিলু আর সুরাইয়া বালু দিয়ে পারে বসে ঘর বানানোর খেলা শুরু করে। মনির হাত বাড়িয়ে বালু ধরার চেষ্টা করে আর খিক খিক করে হাসতে থাকে।
দিলু মনির এর হাত সরিয়ে দেয়, " উহু ময়লা, আক্কা ধরে না! "
আসে পাশে সব শিশুরা পানিতে দাপাদাপি করছে!
"দিলু, তুই একটু দেখ, আমি পানিতে নাইমা আসতাছি, হুম্ । "
"আইচ্ছা,ভাইয়া আসলে আমারে নিয়া যাইবা।"
সুরাইয়া ভয়ে ভয়ে পানির কাছে যায়।
সাতার জানে না বলে অল্প পানিতেও ওর ভয় লাগে।
হাটু পানিতে নেমে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে চলে আসে দিলুর কাছে।
পেছন থেকে পাশের বাড়ির লিপি শিউলি ডাকতে থাকে।
"আয় খেলি! "
দুই বোন চোখে ঈর্ষা নিয়ে তাকিয়েই থাকে।
আহারে ওরা কি আনন্দ করছে!
এই দিকে জহিরের কোন মনযোগ নাই, সে এক মনে বন্ধুদের সাথে পানিতে হাত বল খেলছে। খেলার চে ঝগড়া বেশি!
" হয় নাই, ওয়াটার বল এমনে খেলে না, ওমনে খেলে! "
" হ, তুই তো জানছ, সারাজীবন তুই ওয়াটার বল খেলছস! "
এই সব তর্কবির্তক চলছে।
যে যেভাবে পারে হাত দিয়ে বল ছুড়ে মারা ছাড়া আর কোন নিয়মনীতির বালাই নাই।
সুরাইয়া আর দিলু দুজনেই মুলত শিশু। কতক্ষন আর ছোট ভাইকে পাহারা দিবে, মনির তো সুন্দর হাসতেছে, খেলতেছেই! যাই পানিতে নামি গিয়া! দুই বোন পানিতে নেমে অন্যদের সাথে খেলায় মত্ত হয়ে যায়।
হঠাৎ সুরাইয়া পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মনির নাই!
"ভাইয়া!"
চিৎকার শুনে জহির খেলা ফেলে দৌড়ে আসে- পাড়ে দাড়িয়ে দিলু সুরাইয়া কানতেছে!
" কি হইছে, মনির কই!"
" ভাইয়া, মনির রে দেখতাছিনা! "সুরাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে -আমরা একটু পানিতে নামছিলাম, পরে তাকাইয়া দেখি মনির নাই!"
"আয় হায় কস কি! " জহির হাহাকার করে উঠে।
হতভম্ব হয়ে পানির দিকে তাকায়।
সামনে ই নজরে পরে - একটা বাচ্চার পায়ের মত দেখা যায়!
জহির দৌড়ে গিয়ে পা টাকে জাপ্টে ধরে পানি থেকে আলগি দেয়, মনির!
শক্ত করে কোলে চেপে পাড়ে উঠে আসে। উত্তেজনায় হাপাতে থাকে। দিলু আর সুরাইয়া কাঁদতেই থাকে!
জহির দুই বোন কে জড়িয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
ছোট ভাই মনির কে বুকে জরিয়ে জহির কাপতে থাকে!
মনিরের শরীর ঠান্ডা, নাকে মুখে পানি ঢুকছে!
এক দৌড়ে ঘরে এসে জহির রফিয়াকে ডাকে - আম্মা! "
ওর ডাক শুনে রফিয়া চমকে উঠেন।
"কি হইছে রে, কি হইছে! "
জহির কাঁদতে কাঁদতে বলে-
" আম্মা, মনির পানিতে ডুইবা গেছিলো গা! "
"কস কি! " রফিয়া হাত বাড়িয়ে মনিরকে কোলে তুলে নেন।
জহির, সুরাইয়া, দিলু সবাই কাঁদতে থাকে।
কান্নার আওয়াজ শুনে আসে পাশে বাড়ির মহিলারা চলে।
কি হইছে, কি হইছে!
হারুনের আম্মা, সোহেলের আম্মা, পাভেলের আম্মা সব হাজির!
সবাই মিলে মনির কে পরিচর্যা করতে থাকে!
যখন বোঝা যায় মনির সুস্থ আছে, শুরু হয় কুসংস্কার!
আফা,আল্লাহর রহমত, ছেলেটার কিছু হয় নাই!
আফা, জানের ছদকা দিয়া দেন!
আফা, একটা মুরগী জব দিয়া ঐ পানিতে ছাইড়া দিলে ভালো হইত!
এখন, বন্যার সময়, মুরগী কিনুম কইত্তে!
সেটাও ত কথা, আফা এক কাজ করেন, দুইটা মুরগীর ডিম ওই পানিতে নিয়া ফালাইয়া দেন (মহিলা মুফতিদের কাছে যে কোন সমস্যার সমাধান আছে)!
সেই ডিম নিয়ে জহির যাচ্ছে সদকা দিতে!
ও আশ্চর্য হয়ে দেখে এই মুহুর্তে পানিতে কেউ নেই!
কিছুক্ষণ আগে এই জায়গাটায় কত ছেলে মেয়েরা ছিল!
পানির দিকে তাকিয়ে জহিরের গা শিহরিত হয়ে উঠে ! মনিরের পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। ও চোখ বন্ধ করে দুই হাতে ডিম গুলো পানিতে ছুরে মেরেই বাড়ির দিকে দেয় এক দৌড়!
মনির
স্কুল থেকে আইসা দেখি আমগো বাসা আমগো নাই, বাসা ভর্তি অন্যলোক, আমাদের ঘরের লোকজন সীমাদের বাসায়। বাসায় স্যুটিং চলছে তাও আবার সিনেমার। আনন্দ বেদনার কাব্য বা এই জাতীয় কোনো নাম। সিনেমার প্রেক্ষাপট মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী তাই আমাদের বাসাটাই বেস্ট। আমরা সীমাদের ছাদ থেকে আমাদের বাসার তেলেসমাতি দেখতেছি হঠাৎ কে জানি ঐযে জহির ভাই। আমি জহির ভাইরে তো আর খুইজা পাইনা। কই? কই ভাই? ঐযে লিপস্টিক দেয়া নায়কের বড় ভাইয়ের পাশে। আমিতো অবাক নিজের ভাইরে চেনা যাইতেছে না কাহিনী টা কি!!! ভাইয়া এরুম মেয়েদের মত সাইজ্জা আছে কেন!!!
সিনেমার একটা সিকোয়েন্স এখনও মনে পরে বা প্রায়ই আমরা আমি আর দিলু বলি "কইফেত কিসের কইফেত"
বেপারটা ছিলো এমন সিনেমার মেইন নায়ক তার বড়ভাইয়ের কাছে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কৈফিয়ত চায়। আজ তোমাকে এর কৈফিয়ত দিতেই হবে এমন কোন ডায়লোগের উত্তরে বড়ভাই চিৎকার করে বলে কইফেত কিসের কইফেত। সারাদিন শেষে সন্ধ্যার পরে আমরা আমাদের বাড়ী বুঝিয়া পাইলাম।
সুরাইয়া
আজ মন খারাপ করা কিছু লিখবনা বলে ঠিক করেছি। তবে কেন জানিনা লেখা শুরু করলে কোন না কোন ভাবে সেই মন খারাপ করা টপিকস এ ই টার্ন নেয় যেটা আমার নিয়ন্ত্রনে থাকে না। সেই জন্য আজ ভিন্ন বিষয়।
মুরুব্বিরা সব সময় একটা কথা বলে থাকেন যে মা হলে বুঝবা। তবে আমি মনে করি মা বাবা দুজনেরই প্রথম সন্তান হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদিও বাবা হওয়ার অনুভূতি একটু দেরি তে জন্মায় আর মার টা আগে কেননা মা তার গর্ভে সন্তান ধারণ করেন। তাই মায়ের অনুভূতি আগে জাগে।তাই আজকের বিষয় প্রথম মা ও বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা সবাই ব্যক্ত কর।প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার মত এরিয়ে গেলে চলবে না। কারন এই ফিলিংস সবার সাথে শেয়ার করা যায়।তাই আজকের বিষয় নিয়ে সবার লেখা চাই ।সবাই মানে ভাইয়া ভাবী দিলু মানিক মনির রুমা এবং আমার সুলতান আহমেদ।ইউ আর ইনক্লুডেড।এভরিবডি মাস্টবি রাইট এবাউট দেয়ার ফাস্ট ফিলিংস অফ বিয়িং মাদার এন্ড ফাদার।
যাক আমিই শুরু করি ।দিনটা ছিল ১৯৯৭ সাল বারটা মনে হয় শুক্র বা বৃহস্পতিবার হবে। যথারীতি সিডিউল মত নাস্তা খেতে বসে ছিলাম তখন ই তল পেটে কি রকম একটা চাপ অনুভব করতে পারলাম। বসে থাকতে পারছিলাম না। একবার বসছি একবার দারাচ্ছি । আমার এই অবস্থা দেখে আমার শাশুড়ি বলে উঠলো ওকে উদ্দেশ্যে করে বিয়াইনরে ফোন দে বউ রে হাসপাতালে নেওন লাগব। আম্মাকে খবর দিতে ই আম্মা চলে আসল । আমাকে নিয়ে হলিফেমেলি হাসপাতালে যাওয়া হলো। ওখানে রং নার্সরা আমাকে লেভার রুমে নিয়ে গিয়ে চেকাপ টেকাপ করে বলল সময় লাগবে। বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে।সময় লাগবে শুনে তারা একটু রিল্যাক্স হলো। এদিকে আমি ব্যথায় চিৎকার করছি। আমাকে পেইন বাংলার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হলো সেলাইন লাগানো হলো। আমার ব্যথা বারার অপেক্ষায় সবাই।অথচ তখনকার ঐ ব্যথাই আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। এভাবে দুপুর গড়িয়ে আসরের সময় হয়ে আসল ।আসচর্য হলেও সত্য যে ঐসময় হাসপাতালে শুধু ছিল ভাইয়াও দিলু। পড়ে জানতে পারলাম ওরা সবাই বাসায় খেতে গেছে। আমি আজও মনে হলে ভাবি আর সবাইরে কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু আমার সুলতান সাহেব তিনি ও নাই বাসায় খেতে চলে গেছেন খাওয়া দাওয়া করতে আমাকে এই অবস্থায় রেখে।তাই হোক হঠাৎ করেই একজন নার্স এসে বলল বাচ্চার গলায় নার পেঁচিয়ে গেছে বাচ্চা পেটের ভিতর বাথরুম করে দিয়েছে এখনই সিজার করা লাগবে কাগজে সিগনেচার করেন । আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বলছিলাম আমার স্বামি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়না? নার্স বলল দেরি হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লেভার রুম থেকে বের হতে ই দেখি ভাইয়া ও দিলু অধির আগ্ৰহে অপেক্ষা করছে। ভাইয়া বলল তুই চিন্তা করিস না সুলতান ভাইকে খবর দেওয়া হয়েছে ওরা আসতাছে। ট্রলি ঠেলে লম্বা কড়িডোর পেড়িয়ে আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাইয়া ওদিলু সাথে সাথে যাচ্ছে। ভাইয়া জোরে জোরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা শুরু করে দিল । ভাইয়া ও জোরে জোরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়া আমি ঐসময় এর কথা মনে হলে আজও আমার কানে স্পষ্ট শুনতে পাই। ভাইয়া কি নিজের ভয় বাঅস্থিরতা কাটানোর জন্য নাকি আমাকে সাহস দেওয়ার জন্য ঐভাবে জোরে জোরে পড়ছিল তা আজও একটি প্রশ্ন হয়ে আছে আমার কাছে ।কারন ভাইয়ার ঐ জোরে জোরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ার ফলে আমার ভয় আর ও বেড়ে গিয়েছিল। এরপর ওটিতে নেয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে ই আমার সিজার হয়ে গেল। একটু পরেই আমি কান্না শুনতে পেলাম। সেইটা যে কি আশ্চর্য এক ফিলিংস বলে বোঝানো যাবে না আমার দুই চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে নার্সদের দিকে তাকিয়ে আমি বলতে লাগলাম আমার হাসবেন্ড দেখেছে?এরপর আমার জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমাকে ওটিতে পাশের রুমে রাখা হয়েছে তাকিয়ে দেখি দরজার বাইরে ও দারিয়ে আছে আমি বারবার বলতে থাকলাম তুমি দেখেছ?ও ইশারা করল হে। আমাকে ইশারা করে বললো সব ঠিক আছে তুমি ঘুমাও।এর কতক্ষন পর বলতে পারবনা আমার জ্ঞান ফেরার পর বাচ্চা আমার কাছে দেওয়া হলো বেস্ট ফিডিং এর জন্য। এই ফিলিংস ও ব্যখ্যা করা যায়না। ছোট ছোট হাত পা আঙ্গুল সহ নয়ন জুড়ানো একটা মুখ সহ জলজ্যান্ত একটি মানুষ আমার কোলে। আল্লাহর কি অপার লিলা অথবা কিঅদ্ভুত সৃষ্টি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আর মন ভরে দেখতে থাকলাম আমার চোখ বেয়ে আবার পানি ঝড়তে থাকল।এই ছিল আমার প্রথম মা হওয়ার অভিজ্ঞতা। এবার তোমাদের পালা। অপেক্ষায় রইলাম।
দিলু
সাকিবের জন্মের দিন থেকে বাসায় আসা পর্যন্ত আমাকে ভালোই ডিউটি দিতে হয়েছিল। সে সময়ের কিছু মজার, ভালো লাগার ঘটনা যেমন ছিল তেমন কিছু তিক্ত ঘটনাও ছিল। ভালো লাগাটা ছিল অন্য রকম। আমাদের পরিবারে একটি নতুন শিশুর আবিরভাব।সে কি আনন্দ। হাসপাতাল কতৃপক্ষ বাচ্চা তাদের নিজেদের বেবী কেবিনে রাখতেন। শুধু খাবারের সময় নিয়ে আসতেন। আমি সেই কেবিনের আসপাশে দাড়িয়ে থাকতাম, ভিতরে উকি দিয়ে দেখে আসতাম। আমার ভয় হতো, এতগুলো বাচ্চার মাঝে আমাদের বাচ্চা যদি হারিয়ে যায়। আমি বেশির ভাগ সময় ঐ ছোট্ট সাকিবকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করতাম। অনেক কথা বলতাম ওর সাথে। আজ এই সাকিব মাশাল্লাহ্ কত বড় হয়ে গেছে। বাবা সাকিব, আজও ভয় হয় আমাদের সাকিব আমাদেরি থাকবেতো হারিয়ে যাবে নাতো!!
সুরাইয়া
সেই জন্য ই লিখেছিলাম তুই আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছস বিশেষ করে আমার দুই বাচ্চার জন্মের সময় থেকে বাসায় ফিরে আসা পর্যন্ত। তোর উপর অসম্ভব ভাবে নির্ভর করতাম আমি তখন।তাই তোর ঋন বিশেষ করে ঐ সময় গুলোর জন্য। তুই ছাড়া অন্য কারও উপর ডিপেন্ড করতে পারতাম না। তোর চেহারা দেখলেই আমার মনে এক প্রশান্তির ছোঁয়া খেলে যেত অথচ এসময়টাতে তুই অনেক কিছু মেনেজ করে এসে আমার সাথে হাসপাতালে ডিউটি দিতি। সেই জন্য তোর ঋন আমি কোনো দিন শোধ করতে পারবনা না।তাই অন্তর থেকে দোয়া করি আল্লাহ যেন সব সময়ই এরকম প্রানচ্ছল রাখেন আর আমরা ও তোর সাথে সাথে প্রান ফিরে পাই।
আজ কি লিখি
দিন তারিখ ক্ষন মনে পড়ছে না তাই ঐগুলো বাদ দিয়ে ঘটনায় আসা যাক। তখন বিকেল চারটা বাজে আমি আমার শাশুড়ি কে বলে দিলুকে নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির হলাম। এসে দেখি ভাবী ও রেডি হয়ে আছে ।আছ আমাদের মনিরের বিয়ের মার্কেটিং করতে যাওয়ার কথা। অন্য সবার কথা জানা নেই তবে আমি খুব এক্সাইটেড ভাইয়ের বিয়ের মার্কেটিং বলে কথা।শাড়ি কি কিনব কোথা থেকে কিনব সবই ঠিক করা আমরা শুধু কালারটা দেখে দামটা ফিক্স করে কিনে নিয়ে আসব। আমরা রওনা দিলাম। আমরা অর্থাৎ ভাবী দিলু আমি ও মনির । আম্মা কে বলে আমরা রওনা দিলাম । আমাদের সকলের মুখে যেন খই ফুটছে । অর্থাৎ আনন্দের সীমা নেই। আমাদের গন্তব্য মিরপুর বেনারসী মার্কেট। যথারীতি যায়গা মত পৌঁছলাম। আমরা কয়েক টা শাড়ির দোকান ঘুরে খুব কম সময়ের মধ্যে ই পছন্দ করে দুটো শাড়ি কিনে ফেললাম। একটা বেনারসী আর একটা ইসপ্রিং এর কাজ করা জর্জেট কাতান টাইপের।যাই হোক শাড়ি কেনা শেষে মনির আমাদের কে একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মনে হয় লুচি ই ছিল নয়তো লুচির মতো ছোট ছোট পরটা সাথে বুইন্দা কাবাব খাওয়ালো। ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে নাকি হোটেলের খাবার ই অসাধারণ ছিল জানিনা। আমরা সবাই খুব ই মজা করে খেলাম।ঐখাওয়ার মজা বা মার্কেটিং এর মজা কখনো ভুলবার নয় ।তাই সবার সাথে শেয়ার করলাম। মনির মনে আছে কিনা লিখিস।
মনির
সুরাইয়া আপাকে যখন লেভাররুমে নিয়ে যায় তখন আমি আর দিলু ছিলাম হাসপাতালে, হঠাৎ নার্স এসে দিলুকে জানি কি বলল, বেশ চিন্তিত মনেহলো ওদের ভাবভঙ্গিতে। দিলুকে জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে?? ও বলল বাচ্চা নাকি নাড়ি প্যাচায়া ফেলছে পেটে হাগুও করে দিছে, এখন কেসটা ইকটু কমপ্লিকেটেড হয়েগেছে সিজার করাতে হবে ইমার্জেন্সি । আমরা দুইজন অপেক্ষা করতেছিলাম এরমধ্যে যদি সুলতানভাই বা বড় কেউ চলে আসে। এরমধ্যে জানলাম সুরাইয়া আপা নিজেই নাকি পেপার সই করে দিছে অপারেশন এর। আমি জুয়েলকে আসতে বলছিলাম রক্ত লাগতে পারে এইজন্য। সকল ক্লাইমেক্সের অবসান ঘটিয়ে একটা ফুটফুটে ছোট্ট বাবু আসলো এই পৃথিবীতে, সুবহানাল্লাহ। ইসলাম পরিবারের প্রথম নেক্সট জেনারেশন। আমি ওর নাম রাখছিলাম "আপন"। পরে নামটা বদলে গেলো অবশ্য সাকিব নামটাও আমার খুব পছন্দের।
শাড়ী কিনতে রুমাও গেছিলো আমাদের সাথে। ভাইয়ার গাড়ীতে করে গেলাম কাউছার তখন নতুন নতুন গাড়ী চালায়, গাড়ীব্যাক করতে গিয়া রুমার পায়ের উপর উঠায় দিছিলো। ঘটনাগুলো মনেহয় ঐইতো সেদিন।
সরি শাড়ী কিনার ঘটনা আমি প্যাচ খাওয়াইয়া ফেলছি, রুমানা গিয়েছিল ২০০৭ এ আমাদের প্রোগামের সময়। আর গাড়ী ব্যাক করতে গিয়া না, গাড়ীর দরজা লাগাইতে গিয়া হাতের আঙ্গুলে চাপ লাগছিলো
সুরাইয়া
আজ আমি আমার বাবাকে নিয়ে সকল স্মৃতি খুব মিস করছি। আব্বার কথা বলতে বলতে মুচকি হাসি আব্বার চেয়ারটাতে বসে কোরআন শরীফ পড়া ডাইনিং টেবিলের কোনায় দাঁড়িয়ে কোমরে একটা হাত দিয়ে চাপ চাওয়া টেবিলের কোনায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়া আমাকে ঈদের পরের দিন দেখে আমার দিকে মুখ করে আর বাচতাম না বলা । আম্মা মারা যাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে র চেয়ারটাতে বসিয়ে বোঝানো। মাঝে মাঝে আব্বা কে দেখতে গেলে তুই আছিস কেরে বলা পরক্ষনেই দিলু আইছেনা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার বিয়ের বেশ কিছু দিন পরের ঘটনা আব্বা দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন লাল সটকির ভর্তা দিয়ে। আব্বা যে কিরকম সুন্দর করে ভাতটা মাখছিলেন ।মাখা শেষে স্বভাব সুলভ ভাবে বড় করে একটা নলা ধরতেন। আব্বার ঐ নলাধরা দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আমি বলে বসলাম আব্বা আপনে কি সুন্দর করে ভর্তা মাখা ভাতের নলা ধরছেন যে দেখে আমার ই লোভ হচ্ছে। আব্বা বলে উঠলো খাবি? আমি বললাম হ খামু আব্বা আমার হাতে নলা তুলে দিলেন আমি খেলাম আহা কি মধুর মাখা ছিল ঐএকটা নলাতে আমি আজ ও তা ফিল করি। আমার মনে হচ্ছে চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই হয়তো দেখতে পাব আব্বা আমার পাশে বসে আছেন। আবার তাকতে ভয় হয় যদি না থাকে।তাই অনুভব করি এই ভাল । আব্বা আছেন আমার চারপাশে ঘিরে । আব্বা আছেন আমাদের সবার হ্রিদয়ে মা কখনো মিটবার নয়। আল্লাহ আমাদের আব্বা কে বেহেশত নসিব করুন আমিন।
পারভিন
জান সুরাইয়া ঐদিন টা আমার সবচেয়ে ভালো দিন ছিল, কারণ আমি আববাকে গিয়ে সালাম দিয়ে বলি বাবা কেমন আছেন।আববা বলে আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন আছ। আমি বলছি ভালো আছি আল্লাহ রহমতে। আমি বলছি বলেন তো আববা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বাবা বলে মোহাম্মদ দুর রসুলল্লাহ। এই কথা বলে আমার হাতে ধরে।পরে আমি বলছি আববা আমাকে মাফ দেন তখন বাবা সাথে সাথে বলে আমাকেও তুমি মাফ দিও।আমি কখনো এই দৃশ্য ভুলতে পারবো না। কয়েক দিন আগে আববাকে সপ্নে দেখেছি আমাদের বাড়িতে। আমি, সুরাইয়া , সুলতান ভাই সকাল এগারোটার সময় আববা কে দেখতে যাই হাসপাতালে। আমরা গিয়ে দেখলাম আববা ঘুমিয়ে আছে।শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।
সুরাইয়া
এই সেই সময় যখন দিলূ কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ফোন করে বলে ছিল সুরাইয়া আপা ভাইয়ারা আব্বা কে বাসায় নিয়ে আসছে । আমাদের আব্বা আর নেই। তুমি চলে আসো । আমি দিক বেদিক না দেখে কাঁদতে কাঁদতে সিড়ি দৌড়ে নামতে থাকলাম আর চিৎকার করে ওকে ডাকতে থাকলাম তুমি কি যাবা নাকি আমি একাই যাব।আমি তখন পারলে উড়াল দিয়ে চলে যাই। বাসায় গিয়ে দেখি হারুন ভাই দের ঐখালি জায়গা টাতে আব্বাকে শেষ গোসল দেওয়া হচ্ছে।এরপর আমাদের নিয়ে দেখানো হলো। আমার আব্বা ঘুমিয়ে আছেন। মাহাবুব বলল আহা আপনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন । প্রথমে সাহস হচ্ছিল না মনে হচ্ছিল আব্বার গায়ে হাত দিলে হয়তো আব্বার এই প্রশান্তির ঘুম ভেঙ্গে যাবে।পরে সাহস করে হাত বুলিয়ে দিলাম আব্বার কপালে মুখে কিন্তু আব্বার ঘুম ভাঙ্গলনা আর ভাঙ্গবেওনা কোনদিন। আব্বা চলে গেছেন আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে।তাই তাঁর জন্য দোয়া করো সবাই মিলে। রাব্বির হাম হুমা কামা রববাইয়ানি ছগিরা। আল্লাহ আমাদের আব্বাকে বেহেশত নসিব করুন আমিন।
তখন
১৯৭৬
নুরুল ইসলাম এর গলার আওয়াজ জগৎ বিখ্যাত। যখন কথা বলেন, মনে হয় চিৎকার করছেন। যখন চিৎকার করেন, এলাকায় খবর হয়! আর যখন ফিসফিস করে কিছু বলেন, সাভাবিক বার্তালাপ মনে হয়!
আজ নুরুল ইসলাম এর মনটা খুবই ভালো। বহুদিনের চেষ্টায় আজ সোনালী ব্যাংক বাসাবো শাখা থেকে তার লোনটা পাওয়া গেছে। ব্যাংক ম্যানেজার কিছুদিন আগে লোন সেংশন হওয়ার সুসংবাদ দিলেও নুরুল ইসলাম রফিয়া কে শুনায়নি। ভেবে রেখেছে - একবারে টাকা উঠিয়েই বলবেন।
আজ সেই দিন।
আরোও একজনকে ও জানাতে হবে, আজিজ ভাই।
বাসাবো মোড়ের আজিজ ক্লিনিক এর আজিজ ভাই, যার গ্যারান্টি আর সরাসরি সাহায্য সহায়তায় এই লোন্ টা পাওয়া গেল।
ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে নুরুল ইসলাম উত্তেজিত পায়ে আজিজ ক্লিনিকের দিকে হেটে যায়। ক্লিনিক টা সোনালী ব্যাংক এর কয়েকটা বিল্ডিং পরেই। ক্লিনিকে ঢুকেই নুরুল ইসলাম বলেন - আজিজ ভাই, লোনের টাকা উঠাইছি! "
দুর থেকেই তার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়!
আজিজ ভাই তারাতাড়ি বলেন - আস্তে কথা বল, কেউ শুনব, তোমার যে গলা! "
"হে হে " নুরুল ইসলাম হেসে উঠেন।
লোন পাওয়ার আনন্দে নুরুল ইসলাম খেয়াল করেন নি - দুজন লোক তার পিছু নিয়েছে সোনালী ব্যাংক থেকে । লোক দুজনের আচরণ সন্দেহজনক!
###
রাতে খাওয়ার পর স্বামী স্ত্রী বসেছেন পানের বাটা নিয়ে।
নুরুল ইসলাম এর বহুদিনের সপ্ন - বাড়ির সামনে মেইন রোডে দুটো দোকান করবেন। একটায় নিজে বসবেন, অষুধের দোকান! নামও ঠিক করে রেখেছেন - জহির মেডিকেল স্টোর! এখানে পাইকারি ও খুচরা সকল প্রকার ঔষধ পাওয়া যায়। ১০৩/৭ নামা গোরান। "
আরেকটা দোকান ভাড়া দিবেন। পাকা দেয়াল করে টিন শেড হবে। এলাকায় এখনো কোন পাকা দোকান হয় নি। একটা দুইটা টং দোকান আছে।
আশা করা যায়, পাকা দোকান হলে ভালো চলবে।
সে উদ্দেশ্যেই ব্যাংক থেকে তিরিশ হাজার টাকা লোন নিয়েছেন!
বাচ্চারা ঘুমিয়ে পরেছে। দিলু হওয়ার পর আজকাল শোয়ার ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এসেছে।
রফিয়া সুরাইয়া দিলুকে নিয়ে বড় ঘরে শোয়, আর নুরুল ইসলাম ছেলেকে নিয়ে পাশের ঘরে ঘুমান।
হারিকেনের আলো একটু কমিয়ে নুরুল ইসলাম আবার ব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করেন। চোখে সপ্ন নিয়ে টাকা গুলো গুনতে থাকেন!
"এক, দুই... "
" ইস, চুপচাপ গনতে পার না!" রফিয়া সতর্ক করেন, " কে না কে শুনবো!"
হুম" নুরুল ইসলাম চেষ্টা করেন নিঃশব্দে গুনতে। তবু মাঝে মাঝে তার বির বির করে বলা শব্দ শুনা যায়!
"তের হাজার! এক, দুই...."
সুনশান-নিস্তব্ধ এলাকা। রাত্রি অন্ধকার! কিছু দিন আগে তার খাম্বা আসলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় নাই। সন্ধার পর তাই পুরো এলাকা নিরব হয়ে যায়।
নুরুল ইসলাম জানেন না সেই দুইজন লোক তার পিছু নিয়ে এসে বাড়ি চিনে গেছে!
এখনো পালা করে দুর থেকে বাড়ির দিকে নজর রাখছে। আর মাঝে মাঝে গলির ভেতর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে!
###
তখন
১৯৭৬
রাত তিন টার পর সেই লোক দুজন আরও ছয়জন নিয়ে গাছের গুরি দিয়ে দরজা ভেঙে প্রথমে রফিয়ার ঘরে ঢুকে। একটানে মশারী সরিয়ে দুজন লোক ছয় ব্যাটারি টর্চ জেলে ধরে!
দরজা ভাংগার শব্দে রফিয়ার ঘুম ভাংগ্লেও নিজের চোখ কে বিসশাস করতে পারে না!
তিন জন পাশের ঘরে ঢুকে মশারী সরিয়ে একলাফে নুরুল ইসলাম এর বুকের উপর উঠে বসে। হতভম্ব নুরুল ইসলাম চিৎকার করে উঠে - বাচাও! "
"এই চুপ! একদম চুপ, নাইলে জানে মাইরা ফালামু " বুকের উপর চেপে বসা লোকটা ধমক দেয়।
নুরুল ইসলাম তবু চিৎকার করার চেষ্টা করে, লোকটা টর্চের আলোয় রাম দা দেখায়।
আরও দুইজন নুরুল ইসলাম এর মুখে বালিশ চেপে ধরে।
এদিকে পাশের ঘরে দলের সরদার রফিয়াকে জিজ্ঞেস করে -" টাকা কই রাখছস ক। "
রফিয়া ভয়ে কথা বলতে পারে না! এত লোক আর টর্চের আলোয় দিলু চমকে উঠে কান্না শুরু করে।
এই বাচ্চা চুপ করা! নাইলে জব কইরা ফালামু। "
রফিয়া দিলুর মুখ চেপে ধরে বলেন - বাবারা, আপনেরা যা চান, তা নিয়া জান! আল্লাহর দোহাই লাগে গায়ে হাত তুইলেন না!
"টাকা কই রাখছস ক তারাতাড়ি! "
লোকটা আবার ধমকে উঠে।
সবার মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা।
প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র!
কারো হাতে রামদা, কারো হাতে চাকু, একজন এর হাতে বন্দুক!
খাটের ওপর বাচ্চা আর মহিলা থাকার পরও ডাকাত গুলো একটানে বিছানার তোশক চাদর সরিয়ে ফেলে!
সুরাইয়া ঘুম থেকে চমকে উঠে । রফিয়া সুরাইয়া কে বুকে টেনে নেন।
এদিকে ডাকাতেরা সিন্দুক, কাঠের আলমারি সব কিছু খুলে একাকার করে ফেলে।
ব্যাংক থেকে তোলা টাকা, রফিয়ার বিয়ের গহনা, বিয়ের কাতান, কিছু দামি শাড়ি সব একত্র করে বেধে ফেলে!
রফিয়া খালি বার বার বলতে থাকে - বাবা, আপনারা সব নিয়া জান, আমাদের গায়ে হাত দিয়েন না! "
ডাকাত সরদার বলে - কিচ্ছু করুম না, মা বইন আমগোও আছে, তুই খালি ক টাকা পয়সা আর কোই রাখছস, গয়না পাতি কই? "
দুই মেয়েকে বুকে জরিয়ে রফিয়া বলেন - বাবা, আর কিছু নাই, বাবা..."
" চুপ, আস্তে কথা ক, হাতের আর কানে গয়না খুইলা দে। "
" নেন, বাবারা সব নিয়া জান! "
"নাকের টা খুইলা দে। "
" বাবা, মাইয়া মানুষ! স্বামীর চিন্হ! এইটা নিয়েন না, বাবা। "
"আইচ্ছা, থাক।"
নুরুল ইসলাম জান প্রাণ দিয়ে লড়ার চেষ্টা করে, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাকাতদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দুইজন লোক সারাক্ষণ তার বুকের উপর বসে চেপে ধরে রাখে মুখ। নুরুল ইসলাম কোন মতে একহাত দিয়ে ছেলে জহিরকে ধরে রেখে আরেক হাত দিয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন লাভ হয় না!
ডাকাতদের কয়েক জন আবার বাইরে উঠানে দাড়িয়ে সারাক্ষণ পাহারা দিতে থাকে।
তাদের হঠাৎ মনে হয় আশেপাশের বাড়ির মানুষ জেগে উঠছে!
ওরা ভেতরে ঢুকে তারা দেয়!
নুরুল ইসলাম এর বুকের উপর চরে বসা লোকটা রামদা দেখিয়ে বলে - একদম চিল্লাবিনা কইলাম, চিল্লান দিলে জানে মাইরা ফালামু, বউ, বাচ্চা একটারে ও ছারুম না। মনে রাখিস। "
নুরুল ইসলাম দীর্ঘ শাস ফেলেন আর মাথা নারেন।
লোকটা একলাফে বিছানা থেকে নেমে যায়।
দ্রুত সবাই মালসামান সব নিয়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে দেয়াল টপকে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
কয়েক মুহুর্ত নুরুল ইসলাম জহিরের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে!
এইটা কি হইল!
জহির লাফ দিয়ে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
বাবা আর ছেলে অন্ধকারে হাতরে হাতরে পাশের ঘরে আসে।
রফিয়া স্বামী আর সন্তানকে দেখে চিৎকার করে উঠে - আল্লাগো, আমার কি সর্বনাস হইয়া গেল গো! "
নুরুল ইসলাম জহির কে নিয়ে দৌড়ে উঠানে যায়, চিৎকার করে ডাকে - কে কোথায় আছ, ডাকাত, ডাকাত!!" আহারে আইজ যদি আমার ভাইটা থাকত!
নুরুল ইসলাম আফশোস করেন!
ছোট ভাই রফিক থাকতে এলাকায় কোন ডাকাতি হইলে দৌড়ে যেত। রফিক আজ কয়েক মাস হল পুলিশের চাকরি নিয়ে সারদা ট্রেনিং এ আছে!
এদিকে তার ভাইয়ের বাসায় আজ ডাকাতি হল!
ভাগ্যের কি পরিহাস!
চিৎকার শুনে ধীরে ধীরে প্রতিবেশীদের ঘুম ভাংগে!
আশেপাশের বাড়ির মানুষ ছুটে আসেন।
ও নুরিসলাম সাব, কি হইছে, কি হইছে!"
আমার সর্বনাস হইয়া গেছে ভাই রে আমার সর্বনাস হইয়া গেছে!
সুরাইয়া
তোর তো দেখছি আমার থেকেও তেজ স্মরন শক্তি কেননা দোকান দারের নাম ও তোর মনে আছে। সেই দিন ও মোহন আংকেল এর কথা বললি।যাক চারটা দোকান ছিল আমার ও মনে আছে কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে জাগছে তা হলো ভাইয়ার কাহিনী অনুসারে আব্বার সপ্ন ছিল একটা দোকানে আব্বা বসবে দোকানে র নেমপ্লেট ও মনে মনে ঠিক করা ছিল ।ডাকাতির পর পর হয়তো আর্থিক অবস্থার কারনে সম্ভব হয় নাই পরে যখন দোকান হলো তখন আব্বা তার সপ্নটা পুরা করল না কেন? আমার মনে হয় ভাইয়া বলতে পারবে।
ঐসময় কার আর একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল সন্ধার সময় আমরা যখন পড়তে বসতাম তখনই হট পেটিস বলে একটা লোক হাঁক ছেড়ে ডাকত কখন একটা হটপেটিস দুই টাকায় বিক্রি করতো আমি প্রতিদিন কোননা কোন ভাবে হোক দুই টাকা জমিয়ে রাখতাম ঐ হট পেটিস খাওয়ার জন্য।আহা কি যে মজা পেতাম ঐ হট পেটিস খেতে।
দিলু
আব্বা শুধু দোকানের নাম না ঔষধের দোকানের জন্য ২টা আলমারিও বানিয়ে রেখেছিলেন।যার একটার নিচের অংশটা এখনো আম্মার রুমে আছে। আহারে মানুষের স্বপ্ন! সময়ে সময়ে আর বিভিন্ন পরিস্থিতির কারনে আব্বা সেই স্বপ্ন পরিবর্তন করেন।
# সুপার বিস্কুটে কোন ক্রিম ছিলনা সিসটার।
#চিকনচাকন বয়সকো একটা লোক টিনের তৈরি একটা লাইট ওয়ালা একটা বাক্সে করে হট পেটিস বিক্রি করত।লাইটের তাপে সেগুলো গরম থাকতো। কিযে মজা লাগতো। এখন আর পেটিসে সেই মজা পাওয়া যায়না। দামও বেশি।
আব্বার মুখের ভিতরে ডাকাতেরা মশারি ঢুকিয়ে দিয়ে ছিল। আব্বা গো গো শব্দ করছিল। আর আমার কান্না থামছিলনা বলে মাথায় বারি দিয়ে ছিল। এই তথ্যগুলো বাদ গিয়েছে ভাইয়া।
সুরাইয়া
ঘটনা টা ভাবতেই গা শিরশির করে উঠছে । ভাবতেই পারছি না বাস্তবে হলে অর্থাৎ আমার সাথে ঘটলে কি করতাম। আমার মনে হয় আমি ফিটই হয়ে যেতাম। আল্লাহ মাফ করুক এমন ঘটনা যেন কারো সাথেই না ঘটে। ভাইয়া গতকাল থেকে ই একটা কথা বা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে তা হলো আমাদের বাড়ির দলিল কি ঐ সময় ই খোয়া যায় নাকি সেটা অন্য ঘটনা তোর জানা জানাইস।
জহির
"জহির মেডিকেল স্টোর" হয়েছিল, আব্বা একটা সাইনবোর্ড বানিয়েছিল! দোকান চালু হয়ে ছিল কিনা, বা চালু হয়ে বন্ধ হয়েছিল কিনা আমার এখন মনে নাই! কিন্তু মনে আছে - আমাদের টিনের ঘরের পিছনে বড় গেইটের পাশে দরজার উপর বহুদিন সাইনবোর্ড টা বাধা ছিল।
তোদের প্রস্ন শুনে আমার বড় আফসোস হয় - এই লেখা কেন আব্বা আম্মা থাকতে শুরু করলাম না!
সমরেশ মজুমদারের কালবেলা সিরিজ পড়ার পর থেকেই আমার একটা সপ্ন ছিলো, এরকম একটা উপন্যাস লেখার! কালবেলা র ছেলেটার নানার সাথে একটা খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল। আমি মনে করি আমারো নানার সাথে তেমন গভীর একটা সম্পর্ক ছিলো! সেই ভাবনা আর আগরতলা থেকে একটা দম্পত্তির ঢাকা পর্যন্ত সময় জীবন যাত্রা সুখ দুঃখের গল্প বলার চেষ্টা!
বুকের মধ্যে অনেক ভার, লিখতে পারবো কিনা আল্লাহ পাকই জানেন! দোয়া করিছ।
পারভিন
মা হওয়ার অনুভূতি একটু লিখতে বসলাম জানি না কতটা লিখতে পারি। রাফা যেই দিন হবে সেই দিন ঘুম থেকে উঠেছি সকাল সাতটা। ঘুম থেকে উঠেই খারাপ লাগতেছিল দেখে সাথে সাথে আমি মাকে গিয়ে বলি, মা বলল, "বাচ্চা হওয়ার ব্যাথাই।"এরপর আমি মা দিলু তোমার ভাই বিকাল চারটার দিকে চলে যাই হাসপাতালে। একটু পরে ডাক্তার আপা আসল,এসে দেখে বলল আরো সময় লাগবে। এইভাবে দেখতে দেখতে দুই থেকে তিন ঘন্টা চলে গেল । বড়আপা আম্মা এসে দেখা আমি কান্না করতেছি। মা আর আম্মা তোমার ভাই কে বলে," জহির, পারভীন কে আর কষ্ট দিছ না নরমাল হবে না।"এরপর ডাক্তার আপা এসে দেখে বলে তাড়াতাড়ি সিজার করতে হবে। মা বলল,"সিজার করে ফেলেন।" ডাক্তার আপা অটিরুমে গিয়ে দেখে মেজর অপারেশন চলতেছে।ডাক্তার আপা বলে এখানে অপারেশন হবে না। তোমার ভাই বলে, "কেন আপা?" বলে," বাচ্চা সিজার করতে গিয়ে বাচ্চার হাত কেটে গেছে।" এইটা শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেল। ডাক্তার আপা তোমার ভাইকে বলে তাড়াতাড়ি এমবুলেন্স ঠিক করেন। আমরা টি,এন,টি,জেনারেল হাসপাতালে যাব।ডাক্তার আপা তার বান্ধবীকে বলে তাড়াতাড়ি অটিরুম ঠিক করো।আমি রোগী নিয়ে আসতেছি। ঐ হাসপাতালে যাইতে দেরি হইছে তবে আল্লাহর রহমতে সিজার করতে দেরি হয়নাই। যখন সিজার করতে নিয়ে যায় তখন তোমার ভাই মা দিলু বলে ভাবী ভয় পেওনা আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই আছি। ভয়ে তো ভিতর কাঁপতেছিল। যখন সিজার করতেছে তখন আমি ডাক্তার আপার কথা শুনতেছি। এরপর বাচ্চার চিতকার শোনার সাথে সাথে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি যখন রাফাকে দেখি তখন আমার সব দুঃখ কষ্ট শেষ হয়ে যায়। রাফা ধবধবে সাদা ছিল, ঠোঁট দুটো টকটকে লাল ছিলো। মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখেছে ঠিকই,যখন দুটি চোখের দিকে তাকালাম,তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এটাই আমার প্রথম মা হবার অনুভূতির কথা।
সুরাইয়া
আজ অনেক দিন পর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। তাই বসে গেলাম মোবাইল নিয়ে।প্রসঙ্গ নিজের লুকায়িত ইচ্ছা তা পুরন হয়ে উঠলো না এখন পর্যন্ত। আমার কলেজ জীবন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হবে আমার মনে হয়েছে আমাকে পুকুর থেকে তুলে একটি সাগরে ফেলে দেওয়া হলো। কেননা স্কুলে আমার গন্ডি ছিল বাসা টু স্কুল তার দুরত্ত চিন্তা করলে কয়েক কদম মাত্র।এর বাইরের জীবনটা আমার জন্য সম্পুর্ন অচেনা অজানা। আমার প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসার সময় কেন জানিনা খুব ভয়ে ভয়ে কাটত ।যাক সে কথা তবে আমার ডিগ্ৰি কলেজ লাইফ টা আমি পুরো পুরি ইনজয় করেছি যা স্মৃতি চারন করে আমার খুব ভালো লাগে।তখন কলেজে থাকতাম সেই সময় টা তো ভালো কাটতোই বাসায় এসে ও সময়টা ভালো কাটত ঐসময়টাতে আমার সময় কাটত বেশির ভাগ ই একাএকা ঘরে থেকে তখন কিছু কাজ থাকলে করার পর আমি টেপ রেকর্ডার এ গান শুনতে শুনতে জানলা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখতাম আর ভাবতাম আকাশের কত রূপ । আকাশ দেখতে দেখতে আমি হারিয়ে যেতাম মনের অচেনা অজানা রাজ্যে। যেখানে আমি খুঁজে বেড়াতাম এক একটা নতুন পথ অথবা নতুন কোন জায়গা ভাবতে ভালো লাগতো আমি আমার গাড়ি নিয়ে প্রিয় মানুষ টিকে সঙ্গে নিয়ে হারিয়ে যাব কখনো কখনো আর পথে চলতে চলতে কোন দৃশ্য বা জায়গা ভালো লেগে গেলে ঐ খানেই নেমে পড়ব একান্ত ভাবে সময় কাটাবো প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে। কিন্তু এই ইচ্ছে ইচ্ছে ই রয়ে গেছে আজও বিয়ের পর দেখলাম খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের গাড়ি ও কেনা হয়ে গেল । আমার মনে হলো এবার নিশ্চয়ই আমার সেই ইচ্ছেও পুরোন করাসম্ভব হবে কিন্তু হলোনা। আমার জনাব এবং আমার পারি পার্সিক অবস্থার জন্য। তবে আমি কখনো ই নিরাশ হইনা।
আল্লাহ তাআলা আমাকে তেরি ই করিই করেছেন এভাবে।তাই আজ ও আশা মরেনি। অপেক্ষায় রইলাম।
তখন
১৯৬৯ সাল।
"অই রকিব্বা, তগ ঘরে বলে নতুন বাচ্চা অইছে? "
রকিব অবাক হয়ে খোকার দিকে তাকায়! আর মাথা নারে।
খোকা আবার জিজ্ঞেস করে - অই পোলা, মাথা নারছ কেলা, কথা কইতে পারছ না? "
কুন ক্লাসে পরছ? "
২২/২ আড়াই লেন, গুপিবাগ।
নুরুল ইসলাম এর চাচাতো ভাই আউয়াল এর সুটকেস ফেক্টরি।
চামড়ার ব্যাগ তৈরী হয় এখানে, মুলতঃ সুটকেস। বিয়ে সাদি আর পরিবারের জন্য অপরিহার্য!
ব্যাবসা ভালো। আউয়াল মিয়ার ফেক্টরিতে চার পাচজন কর্মচারি সারাদিন কাজ করে। বাসা কাছেই।
ফোর লেন, গুপিবাগ।
কয়েকমাস হল নুরুল ইসলাম বউ নিয়ে আউয়াল এর বাসায়ই সাবলেট উঠেছে।
ঢাকা শহর!
চারিদিকে খালি আলো আর আলো! সন্ধ্যায় কত বাতি জলে রাস্তায়। রফিয়ার মফস্বলি জড়তা কাটার আগেই সংসারে প্রথম সন্তান এল! ঢাকায় আসার পর থেকেই ভাবি (আউয়াল ভাইয়ের বউ) কত যত্ন নিচ্ছেন!
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ভাবিই সব সামলাচ্ছেন। ঘরের রান্না, বাচ্চা বাচ্চার মায়ের যত্ন সব। বার বার রফিয়ার গুরিগ্রামের কথা মনে পরে! বড় ভাবির কথা মনে পরে!
নুরুল ইসলাম এর ছেলে হয়েছে! নাম রেখেছেন - মোঃ জহিরুল ইসলাম। ঘরে নতুন বাচ্চা পেয়ে সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত! এই সুযোগে আউয়াল এর ছেলে রকিব ফেক্টরিতে চলে এসেছে। ফেক্টরিতে আসলে চা বিস্কুট খাওয়া যায়!
কিন্তু আজ ফেক্টরিতে এসেও শান্তি নাই! রফিক কাকা আর তার বন্ধু খোকার পাল্লায় পরে গেছে!
রফিক নুরুল ইসলাম এর ছোট ভাই, ভাইয়ের সাথেই থাকে। তেজগাঁও কলেজ এ পড়ে। লম্বা, সাস্থবান যুবক! ঢাকায় এসেই ভালো ফুটবল খেলার কারণে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে জয়েন্ট করার সুজোগ পেয়েছে। সেই সুবাদে এলাকার ছেলে খোকার সাথে রফিকের বন্ধুত্ব। নামটাই এমন যে সাথে ভাই ছাড়া কিছু মিলেও না! খোকা কাকা, খোকা মামা - উহু মিলেনা! তাই সবাই তাকে খোকাভাই ডাকে!
পুরা নাম - সাদেক হোসেন খোকা!
খোকা আর রফিক প্রায়ই ফেক্টরিতে চা খেতে আসে।
"কিরে, কতা কছ না ক্যা? " খোকা আবার জিজ্ঞেস করে।
রকির মাথা চুলকাতে থাকে। খোকাকে রকিব ভয় পায় না, কিন্তু রফিকের সামনে ওর কথা সরে না, রফিক ঢাকায় আসার পর থেকে রকিব কে পড়ায়, তাই রকিব খুব ভয় পায়!
"হুনলাম তগ ঘরে রফিকের ভাতিজা হইছে? কি নাম রাখছস? "
"জহির " রকিব বির বির করে বলে।
খোকা রকিবকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়!
রকিবের লজ্জা লাগে, সে আর ছোট নাই! গুপিবাগ সরকারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে!
খোকা হাতের চায়ের কাপ থেকে চা রকিবের ঠোঁটে তুলে দেয়।
" ল, চা খা, নুরু ভাইরে কবি মিস্টি খাওয়াইতে!"
মিস্টির কথা শুনে খোকার কোলে নড়ে চড়ে বসে।
রকিব জানেনা সে ঢাকা শহরের কোলে বসে আছে,
সে খোকাভাইয়ের কোলে বসে আছে, সাদেক হোসেন খোকা! যে একদিন ঢাকা শহর এর মেয়র হবেন!
তখন
১৬ আগস্ট।
১৯৪৬.
দমদম, কোলকাতা।
রফিয়াকে বুকে জরিয়ে জোহরা বার বার রাস্তার দিকে চায়। আজ প্রায় দশ দিন জোহরার মনে শান্তি নাই! যেদিন বাড়িওয়ালি চাচি বলল - জোহরা, দেশের অবস্থা ভালো না, মুসলিম লীগের সভা হবে, সবাই বলছে মারামারি লাগতে পারে। ওহাব মিয়ারে বলবা সাবধানে থাকতে! "
রাতে স্বামী আব্দুল ওহাব কে বলার পর তিনি আরও গম্ভীর হয়ে যান।
"হুম, অবস্থা আসলে একটু খারাপ ই, মুসলিম লীগ ডাইরেক্ট একশন দিবস ডাকসে! সবাই বলতাসে গন্ডোগোল হইতে পারে! সাবধানে থাকতে হইব!"
জুরু মিয়া এমনিতেই রাস ভারি মানুষ, সবাই তাকে ভয় করে! সে গম্ভীর হলে ভয় আরও বাড়ে।
জোহরার ভয়ে অন্তর শুকিয়ে আসে! বিদেশ বিভুই! আপন বলতে বাড়িওয়ালি চাচি! মায়ের মতো আদর করেন মহিলা, সারাক্ষণ খোঁজ খবর নেন।
নিজ গ্রাম সতরা চানপুর ছেড়ে এই ভীনদেশে খালা আছেন বলেই থাকা যাচ্ছে।
জুরু মিয়ার ব্যবসা এখানে দমদমে ! কলিকাতা! বড় শহর, দালান কোঢা!
জোহরা আকাশের দিকে চায়, যেন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, হায় আল্লাহ আপনি সবাইরে হেফাজত করেন!
জুরুমিয়ারে হেফাজত করেন।
হঠাৎ বাড়িওয়ালি চাচির ডাক শুনা যায় - "জোহরা, জোহরা! "
জোহরা চমকে উঠে! দরজায় আউয়াজ শুনে রফিয়া কেঁদে উঠে।
দরজা খুলতেই খালা বলেন- মা, খবর তো ভালো নয়! শুনছি, মুসলিম লীগের সভায় হামলা হইছে...
খালা আর জোহরা পাশাপাশি খাচার কবুতরের মত বসে ধরফর করছেন।
এক বছরের শিশু রফিয়া বার বার কেঁদে উঠছে।জোহরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
রফিয়ার আব্বার কি অবস্থা আল্লাহ জানে!
হঠাৎ দেখা যায় দূর থেকে আব্দুল ওহাব সাইকেল চালিয়ে আসছে। বাঘে তাড়া খাওয়া চেহারা! জোহরার গলা শুকিয়ে যায়! আল্লাহই জানেন কি হইতেছে!
খালার সাথে বসে আটা গুলতে ছিল জোহরা। কোলে রফিয়া! দূর থেকেই জুরু মিয়াকে আসতে দেখে জোহরা। যেন জান হাতে নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে! দেখে দুজনেই উঠে দাঁড়ায়, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
জুরু মিয়া সাইকেল রাস্তায় ফেলেই এক দৌড়ে ঘরে ঢুকেন। তার চেহারা দেখে জোহরার কলিজা চমকে উঠে!
কি হইছে, বাবা, কি হইছে?
খালা জিজ্ঞেস করল।
" দাংগা শুরু হইছে খালা! এক্ষুনি ঘর থেইক্কা বাইর হইতে হইব! মানুষ মানুষের ঘরে আগুন লাগাইতেছে, মানুষ মারতাছে! "
জুরু মিয়া হাপাতে হাপাতে বলেন।
তইলে কি লইতাম লগে.. " জোহরা জানতে চায়।
"কিচ্ছু নিতে হইব না , তারাতাড়ি বাইর হই চল! খালা ছেলেদের নিয়া আপ্নেও বাইর হন! " বলেই জুরু মিয়া জোহরার হাত ধরে টান দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
জোহরা দৌড়াতে দৌড়াতে পিছু ফিরে চায়, খালা অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকেন, তার সাত ছেলের সংসার! বেরুতে একটু তো দেরি হবেই। চারদিক থেকে চিৎকার হইচই এর আউয়াজ শুনা যায়।
জোহরার হাত ধরে জুরু মিয়া দৌড়াতে থাকে। বার বার নিজের বাড়ির দিকে পিছন ফিরে চায়! আল্লাহই জানেন এই বাড়িতে আর আসা হবে কিনা!
হঠাৎ পিছনে একটা বাড়িতে আগুন জ্বলে উঠে! অনেক মানুষের চিৎকার শুনা যায়, হায় আল্লাহ এইটা কি হইতাছে!
রফিয়াকে বুকে জড়িয়ে জোহরা চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করে। শাড়ি পরে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে, তবু জুরু মিয়ার হাত ধরে দৌড়ে চলে জোহরা! সামনে পিছনে আরও কত মানুষ! সবাই জান নিয়ে ভাগছে! আয় আল্লাহ আপনি বাচান!
সামনে একটা চিপা গলিতে ছয় তালা বিল্ডিং এর গেইট খোলা দেখে জুরু মিয়া জোহরাকে নিয়ে ঢুকে পরেন, ওদের সাথে আরও কিছু লোকজন দৌড়ে ভেতরে ঢুকে। জুরু মিয়া সিড়ি দিয়ে এক দৌড়ে ছয় তালায় উঠে যান। হাপাতে হাপাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন কোন হামলা কারি এল কিনা!
নাহ, কাউকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে না, আল্লাহর রহমত!
ছয়তালায় দুইটা ফ্ল্যাট এরই দরজা খোলা! মাল সামান সবই আছে, মানুষ নাই!
রফিয়াকে বুকে জড়িয়ে জোহরা চোখ বন্ধ করে বসে আল্লাহ কে ডাকে, আয় আল্লাহ আপনি সবাইরে হেফাজত করেন! আয় আল্লাহ!
জুরু মিয়া ও জোহরার পাশে বসেন। জুরু মিয়ার গায়ের সার্ট ঘামে ভিজে একসার, পরিশ্রমে এখনো হাপাচ্ছেন,গড়ের মাঠে দাংগা হচ্ছে শুনেই, কারখানা বন্ধ করে সাইকেল চালিয়ে এতদুর আসতে আসতে খালি রফিয়া আর জোহরার অবস্থার কথা ভাবছিল। যেই রাস্তায় যায় সেখানেই আগুন, মারামারি কাটাকাটি আর দাংগা!
কি হইতাছে এইসব!
স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি বসে খাচার পাখির মত কাঁপতে থাকে।
আস পাশ থেকে মাঝে মাঝে চিৎকার শুনা যায়! জোহরা চোখ বন্ধ করে মাথায় ঘোমটা টেনে নেন। আল্লাহ আপনি বাচান!
কিভাবে যে সময় বয়ে যায়, প্রায় আধ ঘন্টা পর জুরু উঠে দাঁড়ায়, জোহরা স্বামীর হাত টেনে ধরে। জুরু মিয়া তাকে ইশারায় সান্ত্বনা দেয়।
প্রায় নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলেন - তুমি ভয় পাইও না, আমি দেখতাছি পরিস্থিতি কি!"
প্রতি তালায়ই কিছু লোক আস্রয় নিয়েছে, সবাই মুসলমান! আসলে এই এলাকাটাই মুসলমান বেশি।
জুরু মিয়া কিছু লোক সাথে নিয়ে আস পাশ দেখে আসেন, মেইন রোডের পাশের প্রায় সব বাড়ি ঘরেই আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে! এই বাড়িটা গলির ভেতর বলে এখনো কারো নজরে পরেনি!
আপাতত নিরাপদ মনে হচ্ছে।
আজ রাতটা এখানেই কাটানো যাক...
কালরাত্রি যত লম্বাই হোক, একসময় ফুরায়! সুর্য উঠে, ভোর হয়!
###
তখন
১৭ আগস্ট।
১৯৪৬.
সূর্যের কিরণ লেগে জোহরার ঘুম ভাংগে!
ছয় তালার জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে জোহরার চোখে লাগে, সে চমকে উঠে হাত বাড়িয়ে কোলের শিশু রফিয়াকে খোজে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে জোহরা ডানে বামে চায়- জুরু মিয়া গেল কোথায়!
ধরফর করে উঠে দাঁড়ায় জোহরা। ওরা আছে ছয় তালার সিড়ি কোঠায়, দরজা দিয়ে বেড়িয়ে জোহরা সিড়ির নিচে উঁকি দিয়ে দেখে- জুরু মিয়া কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলছে। একজন জোহরা কে উঁকি দিতে দেখে জুরু মিয়াকে ইশারা দেয়।
জুরু মিয়া উঠে এসে বলে- তুমি একটু বস, আমি রাস্তায় গিয়ে দেখি গাড়ি টারি পাওয়া যায় কিনা।"
আধ ঘন্টা পর জুরু মিয়া একটা গাড়ি নিয়ে আসলে ওরা দুজন কোলের শিশু রফিয়াকে নিয়ে রওনা হয়।
জোহরা বার বার পিছন ফিরে চায়, আল্লাহই জানে আর জীবনে কখনো এখানে ফিরে আসা হবে কিনা!
গাড়ি প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর একটা স্কুলের গেইটে এসে দাঁড়ায়। জুরু মিয়া নেমে জোহরাকে নামতে সাহায্য করেন।
স্কুলের ভেতরে আরো অনেক লোক জড়ো হয়েছে, প্রায় শ'দুয়েক নারী পুরুষ! সবাই ভীত, জড়সড় হয়ে বসা।
জুরু মিয়া জোহরাকে দলটার কাছে গিয়ে বসে। কেউ কাওকে চেনে না, কিন্তু বিপদে মানুষ অচেনাকেই আপন করে পায়। বিধাতার এ এক আশ্চর্য লীলা!
"জোহরা, অবস্থা ভালো না, এখন ধৈর্য ধরতে হইব, ভাইংগা পইরো না, সামনে কি আছে আল্লাহ পাক জানেন! "
জোহরা নির্বাক তাকিয়ে থাকে, চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে।
"তুমি রফিয়ারে নিয়া এইখানে বইসা থাকো, আমি দেখি, কিভাবে আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।"
জোহরা ভয়ে জুরু মিয়ার হাত চেপে ধরে - আপনে আমরারে একা রাইখা যাইয়েন না, আমি একলা রফিয়ারে লইয়া থাকতে পারতাম না!"
" শুন, বিপদে ধৈর্য ধরতে হইব, তুমি এইখানে বইসা থাকো, কোথাও যাইবানা, আমার আসতে দেরি হইলেও এইখানে অপেক্ষা করবা।"
খাচার হরিণের মত জোহরা জুরু মিয়ার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রয়, জুরু মিয়া ত্রস্ত পায়ে গেইট পেড়িয়ে রাস্তা দিয়ে ডানে চলে যায়।
রফিয়ার ঘুম ভেঙে, মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে শিশু কেদে উঠে। জোহরা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শান্তনা দেয়।
আকাশের দিকে চেয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে - আয় আল্লাহ আমাদের এই বিপদ থেইকা উদ্ধার করেন!
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেল প্রায় তবু্ও জুরু মিয়ার খবর নাই! জোহরা বার বার গেইটের দিকে চায়
, এই বুঝি জুরু মিয়া আসলো!
এর মধ্যে এক ভাই এসে এক বাটি দুধ আর কলা পাতায় মোড়া একটু খিচুড়ি দিয়ে গেছেন।
মাজি, বেটি কে লিয়ে ইতনা হি দুধ মিলা, তুম খিচড়ি খালো, বেটি কো দুধ পিলাদো, বিটিয়া সুবাছে রো রাহি..."
জোহরা অবাক হয়ে ভাবে, আল্লাহর আজব এই দুনিয়া, একদিকে একজন আরেকজনের গলা কাটে, আরেক দিকে অচেনা অজানা মানুষ অপরের জন্য খাবার নিয়ে আসে!
চারটা দিকে জুরু মিয়া দৌড়ে আসে- চল জোহরা, গাড়ি পাইছি!
স্বামীর হাত ধরে জোহরা কাঁপতে থাকে।
আপনে কোথায় ছিলেন, আমি এইখানে ভয়ে মরতাছি।"
"আহারে,কত কষ্ট করছ! কি করুম বল, কিচ্ছু পাই না, রাস্তার অবস্থা ভালো না, যাক, এখন আর ভয় নাই, একটা গাড়ি পাইছি, চল। "
জোহরা উঠে দাঁড়ায়।
"আর চোখ মুখ কাপড় দিয়া বাইন্ধা লও, রাস্তায় ধুলা বালি!"
জোহরা শাড়ীর আঁচল দিয়ে নাক মুখ বাধেন।
জুরু মিয়া এক নজর দেখে বলে- উহু, কাপড় দিয়া সারা মুখ পেচাইয়া লও।"
নিজে আঁচল দিয়ে ভালো ভাবে জোহরার মুখ বেধে দেন, " হুম, এইবার ঠিক আছে।"
হাত ধরে জোহরাকে নিয়ে গাড়িতে বসায় জুরু মিয়া, মেয়ে বাবার কোলে।গাড়িতে উঠেও জোহরা স্বামীর হাত ছাড়েনা, শক্ত করে ধরে রাখেন।
গাড়ি চলতে চলতে বার বার ঝাকি খায়!
" কি হইছে, অত ঝাকি হইতাসে কেন?"
জোহরা জানতে চায়। মুখে কাপড় ঢাকা অবস্থায় কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
জুরু মিয়া জোহরার হাত চেপে শান্তনা দেয়- কিছু না, রাস্তা খারাপ, একটু ধৈর্য ধর।"
বলে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়েন জুরু মিয়া!
জোহরা জানেনা, রাস্তা ভরা লাস আর লাস, গাড়ি সাইড কেটে চালানোর জায়গাও নাই! মানুষের লাসের উপর দিয়েই গাড়ি চালাতে হচ্ছে!
জোহরা সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারবেনা বলে আগেই সারা মুখ ঢেকে দিয়েছেন!
জুরু মিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। মানুষকে কিভাবে হত্যা করে? ধর্ম নিয়ে এ কেমন রাজনীতি? কত মানুষ, কত মা, বাবা, ভাই বোন, শিশু, কত নিস্পাপ অজানা মানুষ হারিয়ে গেল, কি কারণে, কার জন্য? কে বলবে, কে জবাব দিবে?
গাড়ি থেকে জানালা দিয়ে জুরু মিয়া আকাশের দিকে চায় - আকাশে শকুনি উড়ে, মাটিতে মানুষের লাস!
গতকাল যারা জীবিত ছিল তারা এখন বেওয়ারিশ লাস হয়ে রাস্তায় পরে আছে।
সারাদিন অনাহারী জুরু মিয়া নির্বোধ শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকে।
কোলে এক বছরের শিশু রফিয়া বার বার কেঁদে উঠে।
আধ ঘন্টার রাস্তা যেতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে।
অবশেষে দমদম এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছে গাড়ি।
হাতে কোন মাল সামান নেই, গাড়ি থেকে নেমে জুরু মিয়া জোহরার মুখের বাধন খুলে দেন।
বহুক্ষণ পর জোহরা আরাম করে শ্বাস নেয়।
" চল, বাথরুমে গিয়া ভালো মত হাত মুখ ধুইয়া লই।একটু পরেই বিমান ছাড়বো। "
যাত্রীদের বেশিরভাগই সামান পত্র ছাড়া। ইমিগ্রেশন ও ফর্মালিটি শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না।
রাত ৮ঃ২০ এ বিমান আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।
রাত এগারোটায় আগরতলা এয়ারপোর্টের পাশেই জুরু মিয়ার এক বন্ধু ও গ্রামের প্রতিবেশীর বাসায় এসে উঠলো পরিবারটি।
আদিফ মিয়া ওদের এত রাতে আসতে দেখে মোটেও অবাক হয়নি, বরং বন্ধুর জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছিলেন।
যদিও আগরতলায় রায়টের কোন সমস্যা এখনো হয়নি,কিন্তু কোলকাতার বিভিন্ন খবর রেডিও আর পত্রিকা মারফত পাওয়া যাচ্ছিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন