কখন
৪৭৫ দক্ষিণ গোরান, ঢাকা - ১৩১৯.
লোকে বলে বিপদ আসলে সাথে দলবল নিয়ে আসে। আজ সে-ই রকম দিন।
বিকেলে আসরের নামাজের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফোন এল,জহিরের বড় মামা আব্দুল আউয়াল আর নেই।
কিছুক্ষন পুর্বে হার্ট অ্যাটাক হ'য়ে মারা গেছে!
দ্রুত সবাই কে ফোন করে একত্রিত করতে বেশি সময় না লাগলেও, মাইক্রো ভাড়া করে রওনা হতে হতে প্রায় ছয়টা বেজে যায়।
মাইক্রোতে যাত্রী বলতে - রফিয়া আর তার ছোট বোন অনু ও জহির, তার বউ পারভিন, সুরাইয়া, দিলু..…
আশুগঞ্জ ফেরিঘাটে পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়নি। লম্বা সিরিয়াল, ফেরি পার হতে সময় লাগবে।
কিন্তু নতুন বিপদ আসল অন্যদিক থেকে।
নুরুল ইসলাম এখন প্রবীন, শারীরিক ভাবে সম্পুর্ণ সুস্থ হলেও প্রস্রাব পেলে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেন না।
"জহির,বাবা আমার একটু টয়লেটে যাইতে হবে, এদিকে কোন ব্যবস্থা আছে কি? "
"ফেরিঘাটে আর কেমন ব্যবস্থা থাকবো, চলেন দেখি, আমি আপনের সাথে যাই।"
বাবা ও ছেলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাংগে প্রথমে। ডানে বায়ে তাকিয়ে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করে সামনে খাবার হোটেল গুলোর পেছনে যায়।
সামনে নালা। ছালার বেড়া দিয়ে কয়েকটা টয়লেট তৈরি করা আছে!
নুরুল ইসলাম এগিয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার, ভালো দেখা যায় না।
জহির আউয়াজ দেয় - আব্বা কোন সমস্যা নাই ত!"
" না, তুমি গাড়িত যাও। আমি আইতাছি।"
জহিরের উচিত ছিল, অপেক্ষা করা, কিন্তু তার ও সিগারেট খাওয়ার প্রয়োজন, তাই আর দিমত না করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একটা বেনসন ধরিয়ে দ্রুত কয়েকটা টান দেয়। বড়মামা আউয়াল এর সুন্দর চেহারাটা মনে পরে জহিরের । তিন মামা, সবাই দেখতে সুন্দর, কিন্তু বড় মামার চেহারা ইরানিদের মত!
এইত মাত্র কয়দিন আগে জহির বন্ধু বান্ধব নিয়ে নানা বেড়িয়ে গেল, তখন তো মামা পুরা সুস্থ। মামার অবশ্য হার্টের সমস্যা ছিল।
আসলে মানুষের কখন কি হয়ে যায় বলা মুসকিল!
বিশেষ করে মৃত্যু! জহির দার্শনিকের মত ভাবে।
সিগারেট ফেলে জহির গিয়ে মাইক্রোতে বসে।
রফিয়া আর অনু দুজনের চোখেই অশ্রু। ভাইকে নিয়ে কত সৃতি, কত কথা যে মনে পরছে! মুক্তি যুদ্ধের সময় ভাইটা কত কষ্ট করে রফিয়ার শশুর বাড়ি গিয়েছিল, শুধু বোনটা এই গন্ডগোলের সময় কেমন আছে জানার জন্য! চানপুর থেকে গুরিগাও যেতে আসতে লেগেছিল সাত দিন! পথে শুধু চিড়া আর সাতু খাওয়া! এমন কি একদিন নাকি ক্ষেতের কাচা সব্জি ডাল ও খেয়েছে ভাইটা!
আউয়াল মুক্তি যুদ্ধের সময় অনেক করেছে! একবার তো মিলিটারিরা ধইরাও নিয়া গেছিল! আব্বা কত দৌড়াদৌড়ি কইরা ছুটাইয়া আনছিল!
সেই ভাইটা আর নাই।
"তোর আব্বারে সাথে নিয়া আসলি না?"
জহিরকে দেখে রফিয়া জিগ্যেস করেন।
"আব্বাই আমারে গাড়িতে বসতে বলছে।"
এখান থেকে শুরু হয় নতুন বিপদ!
দশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও নুরুল ইসলাম এর খবর নাই, কি হইল!
"দেখত তোর আব্বা এত দেরি করতাছে কেন?"
জহির আবার গাড়ি থেকে বেরয়।মনে মনে বিরক্ত, আব্বা যে কি করে মাঝে মাঝে!
টয়লেট গুলোর কাছে গিয়ে আওয়াজ দেয়- আব্বা, কি হইল,এত দেরি কেন?"
কোন উত্তর নাই!
কয়েক বার ডেকেও কোন সারা না পেয়ে জহির আসে পাশে কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে। লোকজন মন্তব্য করে - মুরুব্বি মানুষ, একা রাইখা কেউ যায়!
দেখেন, হয়ত নামাজ পড়তে মসজিদে গেছে!
ফেরির এপারের সকল মসজিদে খোঁজ নিয়েও আব্বাকে খুঁজে পায়না জহির!
এদিকে ফেরির সিরিয়াল এসে গেছে!
জহিরের ভয় হয়- আব্বা নালায় পরে যায় নাই তো!
আসে পাশের দোকান থেকে চারজ লাইট নিয়ে টয়লেট গুলোর চারিদিকে ভালো ভাবে দেখা হয়, কোথাও নুরুল ইসলাম নেই।
দুশ্চিন্তায় জহিরের মাথা খারাপ হওয়ার দশা।
পর পর দুইটা ফেরি মিস করার পর, ড্রাইভার বলল- ভাই, খালুজান অই পাড়ে চইলা যায় নাই ত!"
গাড়ির সবাই বিরক্ত, বার বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফোন আসতেছে, আপনারা কতদুর?
সিদ্ধান্ত হল,ফেরিতে উঠা যাক, অই পাড়ে গিয়ে তারপর কি করা যায় পরামর্শ হবে।
পারভিন জহির কে প্রশ্ন করে- তুমি আব্বারে একা রাইখা আসলা কেমনে? "
জহির বিরক্ত হয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। এমনি মাথার ঘায়ে কুত্তা সামলা অবস্থা, তার উপর আবার বউয়ের খোচা!
কিছু না বলে জহির দীর্ঘ শাস ফেলে।
ফেরিতে ওঠার পরে জহির গাড়ি থেকে নেমে যায়!
নিজের উপর ই বিরক্ত, কেন আব্বাকে একা রেখে আসলাম!
আকাশে পুর্নিমার চাঁদ। রাতের আঁধারে নদীর পানিতে চাঁদের আলোর ঝিলিক! সময় ভালো থাকলে উপভোগ করা যেত, জহির আবার একটা দীর্ঘ শাস ছারে।
গম্ভির মুখে ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে ফেরী এগিয়ে যায়, জহিরের মনে হয় ফেরী এত আস্তে চলে কেন?
জহির আল্লাহকে ডাকে, ইয়া আল্লাহ আব্বার কি হইল! তুমি তারে নিরাপদ রাইখ।
নদীর ওপার নজরে আসছে।
হঠাৎ জহির, হার্টবিট মিস করে!
আরি! আব্বা না! অই দেখা যায় ফেরীর দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক হয়ে!
খুশিতে জহিরের চোখে পানি এসে যায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
দৌড়ে গাড়ির কাছে যায়,আব্বা ঠিক আছে, ঐপাড়ে দাড়াইয়া আছে! "
ফেরী থামার আগেই জহির চিৎকার করে নুরুল ইসলাম এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
নুরুল ইসলাম চরম বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠে!
" দুই ঘন্টা ধইরা দাড়াইয়া রইছি এই পাড়ে, তরা এত দেরি করলি!"
গাড়ির যাত্রী সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকায়।
উল্টা চোর কতোয়াল কো ডাটে!
[7/15, 3:18 PM] Md.
Zohirul Islam: কখন... রফিয়া চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করেন - তুমি কুন আক্কেলে এই পাড়ে আসছ? "
নুরুল ইসলাম এর বিরক্তি আরও বাড়ে। রাগে মুখ থমথমে। নাক দিয়ে গরম সাস ফেলেন। ফুসস....
"আমরা দুই ঘন্টা ধইরা তুমারে খুজতে খুজতে হয়রান, ঐ দিকে বিবাড়িয়া থেইকা একটার পর ফোন আইতাছে, কতগুলা লোক অপেক্ষা করতাছে, আর তুমি এই পাড়ে আইসা বইসা রইস!"
রফিয়া র আক্ষেপ কমে না।
পারভিন পাশ থেকে বলে - আম্মা বাদ দেন, আব্বারে যে খুইজা পাইছি এইটাই একটা বিরাট শুকরিয়া। ড্রাইভার ভাই, গাড়ি ছারেন, অনেক দেরি হইয়া গেছে। "
পারভিনের কথা শুনে নুরুল ইসলাম একটু লজ্জিত হয়।
" হে হে, আসলে হইছে কি, পেশাপ কইরা আমি ভাবলাম, এশার অক্ত হইছে, নমাজ টা পইরা লাই। এই চিন্তা কইরা মসিদো ঢুইকা অজু কইরা নমাজ পরছি, তারপর একটা ফেরীতে উইঠ্যা এ-ই পাড়ে চইলা আসছি, ভাবলাম, তুমরা ত আসবাই।হে হে। "
"তুমারে কত বার বলছি, সাথে মোবাইল রাখ, মোবাইল থাকলে আজকের দিনে কতটা সময় বাচত? " রফিয়া অনুযোগ করেন।
" আরে মোবাইল আমার উসফুস লাগে, ছাতাডা চালাইতাম পারিনা, রাইক্ষা লাভ কি! "
নুরুল ইসলাম এর সহজ উত্তর। কথা সত্য। মোবাইল ছেলে মেয়েরা কয়েক বার কিনে দিয়েছে, কিন্তু মোবাইল চালাতে উনার ভেজাল লাগে, উল্টা পাল্টা হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে মোবাইল ব্যবহার করাই বাদ দিয়েছেন!
মাইক্র দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়, যাত্রীদের মনে হয় তবুও যেন গতি কম!
রফিয়ার মোবাইল আবার বেজে ওঠে, অদুদ ফোন করছে-আফা আপনারা এখন কোথায়!
রফিয়া ফোন জহিরের দিকে এগিয়ে দেয়।
"মামা, আমরা আশুগঞ্জ পার হইতাছি, একটা সমস্যা হইছিল, আইসা বলতাছি।আপনাদের ঐদিকে কি অবস্থা।"
" বাবা, আমরা ত তোমাদের অপেক্ষায় পৌরসভা অফিসে দাড়াইয়া রইছি। ইহানদা জানাজা ফানাজা সব শেষ, তুমরা আসলেই আমরা কবরস্তান যামু।"
জহির বলে - মামা আর একটু অপেক্ষা করেন, আমরা সরাসরি পৌরসভায় আসতেছি। "
প্রায় ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাই ড্রাইভার ভাই, খালুর লেইগ্যা অনেক দেরি হইয়া গেল, তার আবার ঢাকা ফিরে এয়ারপোর্টে খেপ ধরতে হবে।
পোনে এক ঘন্টা পর গাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা অফিসের সামনে থামে। জহির তারাতাড়ি আম্মার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায়।
জেলা অফিসে র সামনে দুনিয়ার মানুষ!
এই পরিবার টি ধনী হয়ত না, কিন্ত বিবাড়িয়া শহরের সবচে চেনাজানা পরিবারের একটা!
নানা তন্দুল হুজুর বেচে থাকলে আজ এই পরিবার কি হত!
রফিয়া দৌড়ে ভাই এর কাছে ছুটে যেতে চায়। জহির সক্ত করে মা'কে এক হাতে ধরে রাখে।অন্য হাত দিয়ে কাধ জড়িয়ে ধরে।
সবাই সরে গিয়ে পথ করে দেয়। কেউ কেউ কৌতুহল নিয়ে তাকায়।
ঢাকা থেকে আউয়ালের বড় বইন আসছে!
আহারে, ভাইরে শেষ সময় এট্টু দেখতে ও পারলোনা ভইনাটা!
ছোট বোন অনু কে পাশে নিয়ে রফিয়া তার পিঠাপিঠি ছোট ভাইকে শেষ বারের মত দেখতে এগিয়ে যায়....
যখন
সাল ১৯৮২.
জহির দৌড়ে সাইফুর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না!
আদর্শ স্কুল এর সামনে থেকে শুরু হয়েছে দৌড়।
জহির এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। ওদের বাসার উল্টো দিকের আজিজ সাহেবের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। দুই ছেলে সাইফু আর পাপ্পু। বাবা হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স এর কর্মকর্তা। সাইফু আর পাপ্পু আসার পর জহির এর সারাদিন এর কর্ম সূচিতে এখন বিরাট উত্তেজনা! সাইফুরা আগে কলোনিতে ছিল। কলোনির সমবয়সীদের জীবন বড়ই আনন্দম্য! সাইফু ওদের কত কিছু শিখিয়েছে! বাঁশ দিয়ে চরকি বানানো (ইয়োইয়ো), রিং চালানো, টিলো এক্সপ্রেস খেলা! আরো কত কি। ওরা আসার আগে জহিরের দিন কাটত মেয়েদের সাথে কুতকুত আর পুতুল খেলে!আজিজ সাহেবের ছোট ছেলে
ফটিক সোহেল, সাইফু এর থেকে কত বিচিত্র খেলা শেখা যায়!
যেমন এখন এই রিং চালিয়ে মতির মাঠে যাওয়া! একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগিতা! কে কার আগে যেতে পারে! মতির মাঠ একটা আজব জায়গা! শুকনার সময় মতির মাঠ, বন্যার সময় মতির ঝিল!
রিং চালাতে ছেলেরা দৌড়াতে থাকে। আদর্শ স্কুল এর পেছনের রাস্তা দিয়ে নামা গোরান হয়ে মেরাদিয়া।কিছক্ষন আগে সাইফু হঠাৎ এসে বলে - ঐ চল মেরাদিয়া যাই, ঐখানে হেলিকপ্টার আইতাছে!
আল্লাহই জানে সাইফু ভাই এই সব খবর কইত্তে পায়- জহির ভাবে আর রিং চালাতে চালাতে দৌড়ায়। নতুন রিং চালানো শিখেছে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মজার ঠেলায় কষ্ট করা কোন ব্যাপার না। এই রিং বানাইতে ও কত উত্তেজনা! ঘরের পুরোন রড যোগাড় করা, আম্মার কাছ থেকে টাকা নেয়া! রিং ঝালাই করতে আট আনা লাগবে শুনে আম্মার ত মাথাই খারাপ হওয়ার দশা! তারপর ফটিক সাইফু সবাই মিলে বাসাবো বাজারে গিয়া রিং ঝালাই করা! দশ পয়সা দিয়া আইস্ক্রিম কিনে খাওয়া!
বিশ পয়সা দিয়া বাক্সের মধ্যে সিনামা দেখা, কত মজা!
সাইফু ভাই এক হাত তুলে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে- ঐ দেখ হেলিকপ্টার নামতাছে!"
ফটিক, জহির, বিদ্যুত, রাসেল আখের পাভেল নিটুল ভাই, মুকুল ভাই সবাই তাকিয়ে দেখে সত্যি হেলিকপ্টার নামছে! মেরাদিয়া হাটের একটু আগে খোলা ময়দানে তিনটা হেলিকপ্টার! হেলিকপ্টার এর পাখার বাতাসে আসে পাশে ধুলো উড়ছে!
সবাই রিং চালানো থামিয়ে অবাক হ'য়ে দুর থেকে হেলিকপ্টার দেখতে থাকে! যদিও পায় আধ মাইল দুর, তবু এত কাছ থেকে ওরা কেউ হেলিকপ্টার দেখেনি আগে!
সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে! ছেলেরা কেউ জানেনা আজ এই হেলিকপ্টার এখানে এসে অবতারণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা!
ইস্টার্ন হাউজিং এর মালিক মোঃ জহুরুল ইসলাম আজ কিছু সরকারি কর্মকর্তার সাথে এসেছে মতির মাঠ ও তার আসে পাশের এলাকা পরিদর্শনে!
ওরা কেউ জানেনা এরপর থেকে এই গোরান এলাকার চেহারা ই পাল্টে যাবে।
একদিন এখানে বনশ্রী আবাসিক এলাকা হবে!
যখন
জহির এখন ২য় শ্রেণির ছাত্র।
জানুয়ারী মাসের সকাল।
বাড়ির পেছনে হারুন ভাইদের আলগা জমিতে পাটি বিছিয়ে বাচ্চারা বসেছে। আল্গা জমি বলা হোলো এজন্য যে এই জমিটুকু আর হারুনদের মূল জমির মাঝ দিয়ে একটি সরু রাস্তা গিয়েছে!
নিলি আপা হাতে চিকন কাঠি নিয়ে একটা জলচৌকিতে বসেছে। সামনে পাটির মধ্য জহির, সুরাইয়া, নিলু আপার ছোট বোন শিল্পী, শিউলি, পাশের বাড়ির সোহেল আর তার ছোট বোন সপ্না বসা।
স্কুল শুরুর আগে স্কুল স্কুল খেলা! স্কুল নিয়ে এই এক মজার ব্যাপার - স্কুল স্কুল খেলতে ভালো লাগে, কিন্তু আসল স্কুল শুরু হলে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করেনা।
পেছনে শিউলি ফুলের গাছ, তা থে মাঝে মাঝে ফুল ঝরে পরছে!
নিলু আপা ধমক দেয় এই পড় সবাই - সাত একে সাত, সাত দুগনে চৌদ্দ। "
বাচ্চারা সবাই সমস্বরে উঠে - সাত একে সাত...
পড়তে পড়তে জহির আর সোহেল চোখের ইশারায় কথা বলে,আহারে নিলু আপা যদি জানতো!
আজই ভোর বেলা নিলু আপাদের বাগান থেকে ফুল চুরি করেছে দুইজন! শীতের ভোরে শিউলি গাছের তলায় সারা রাতের ঝরা ফুল জমে সাদা আর কমলা রং এর কার্পেটের মতো হয়ে থাকে!
যদিও নিলু আপার কড়া নিষেধ বাগান থেকে ফুল নেয়া যাবেনা!
কে শুনে কার কথা!
প্রায় আধ ঘন্টা পড়া লেখার পর জহির সুরাইয়া ঘর থেকে আনা মেরাপিঠা বের করে সবাইকে দেয়, সকলে মিলে খাওয়া ও খেলায় কাটে শীতের আয়েসি সকাল!
যখন
সন্ধ্যায় আম্মার সামনে বসে পড়াশোনা করছে জহির আর সুরাইয়া, পাশে দিলু বর্ণ পরিচয় শিখছে।
হঠাৎ শুরু হল ঝুম বৃষ্টি!
টিনের চালে বৃষ্টির ঝনঝন আওয়াজ হয়।
হাওয়ায় তেজ বাড়তে থাকে।
সুরাইয়া ভাইয়ের দিকে তাকায়।
জহির বই বন্ধ করে আম্মার দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেস্টা করে। রফিয়া একমনে কুশি কাটার কাজ করছে, মনে ভাবছে বৃষ্টি বাড়লে নুরুল ইসলাম এর বাসায় ফিরতে কষ্ট হবে!
বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে।
বৈশাখ মাস, কাল বৈশাখী ঝড়!
জহির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে - আম্মা পলিদের ঐ আম পরতাছে, কূড়াইতে যাই,ঝড়ের মইদ্যে আম পরতাছে!"
"মাইর খাবি, চুপচাপ পড়!"
রফিয়া ধমক দেয়।
"আম্মা, এট্টু যাই, দুইটা আম লইয়া চইলা আসুম - জহির অনুনয় করে।
" শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজলে সইল খারাপ হইব, দরকার নাই।"
"আম্মা! এট্টু যামু আর আসুম।"
"না, জর আসলে তোর আব্বা বকা দিব।"
এবার সুরাইয়া বলে - "আম্মা দেখ সব আম পলিরা লইয়া যাইবগা, আমরা খালি যামু আর আসমু, দেরি করমু না, আম্মা, যাই!"
ছোট্ট সোনা দিলুও নেরে চেরে বসে- আমিও যামু!"
হ,তুই ত যাবিই, আমরাই যাইতে পারতাছি না- জহির জবাব দেয়।
মুখ গোমড়া করে জহির আর সুরাইয়া বসে থাকে।
বাচ্চাদের মন খারাপ দেখে রফিয়ার ছোট বেলার স্মৃতি মনে পরে! তিনি ও তো ঝড়ের মধ্যে কত আম কুড়িয়েছেন, আলিম আওয়াল,আব্বাস ভাইকে নিয়ে!
"যা,কিন্তু দেরি করবি না,যাবি আর আসবি, ঠিক আছে!"
জহির আর সুরাইয়া লাফ দিয়ে উঠে বিছানা থেকে। দৌড়ে বেরিয়ে যায় দুই বাড়ি পর পলিদের আম বাগানে। ভাইবোন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পলিদের আম বাগানে ঢুকে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে!
আয় হায়, ওদের আগেই জায়গা দখল হয়ে গেছে! শিল্পী, শিউলি এসে হাজির!
বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আম কুড়াতে থাকে।
জহির চিৎকার করে বলে - তোরা আইসছ কেমনে? "
শিল্পী বাকা উত্তর দেয়- ক্যান, খালি তোরাই আসতে পারছ, আমরা পারি না।"
বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে, আর বাচ্চারাও আম কুড়াতে থাকে। সময় বয়ে যায়, জহির সুরাইয়া ভুলে যায়, আম্মাকে বলে এসেছে, এই যাবে আর আসবে.....
এখন
২০০৩ সাল।
এপ্রিল মাসের রাত,জহির আজ সিএনজি নিয়ে বাড়ি ফিরছে!
সাধারণত রাত হলেও বাসে করেই বাসায় যায়। আজ মনের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না!
বস এসেছে দিল্লি থেকে কয়েক দিন আগে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছিল, আজ কনফার্ম হলো জহির। বস বলবন্ত সিং বলেছেন - জহিরকে অফিসের কাজে পাকিস্তান যেতে হবে!
যদিও পাশের দেশ, কিন্তু জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা!
উড়োজাহাজ ভ্রমণ! এয়ারপোর্টে যাওয়া!
সব মিলিয়ে জহিরের মনে এখন ভীষণ উত্তেজনা! কখন বাসায় পৌছাবে, কখন আব্বা আম্মাকে বলবে,কখন পারভিন কে বলবে!
জহির চেস্টা করে সব কিছু প্রথম বাবা মাকে বলতে,বিশেষ করে মা'কে। ছোট বেলা থেকেই মা'ই সব কিছুতে জহির কে প্রস্রয় দিয়েছেন, কত আবদার মা, বাবাকে না জানিয়ে পুরো করেছেন গুনে শেষ করা যাবে না!
ফেরার পথে খিলগাঁও রেলগেইট থেকে এক প্যাকেট মিস্টি কিনে নিল জহির।
ঘরে ঢুকে প্রথম পারভিনকে জিজ্ঞেস করল, আম্মা আব্বা ঘরে আছে?
পারভিন মাথা নেরে বলে, আছে, মনে মনে অবাক হয়, কি হলো আবার!
জহির ইশারায় পারভিন কে সাথে আসতে বলে বাবা মার ঘরে ঢুকে।
"আম্মা, আব্বা, একটা সুখবর আছে!" জহির নিজের খুশি ধরে রাখতে পারে না!
নুরুল ইসলাম রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে ছিলেন। ছেলের ডাক শুনে বিছানা থেকে উঠলেন।
কি হইছে বাবা, কি হইছে! "
"কিছু হয় নাই আব্বা, একটা সুখবর! আমারে অফিস থেকে বিদেশে পাঠাইতাছে!"
আনন্দে জহিরের চোখ মুখ উত্তেজিত!
রফিয়া, নুরুল ইসলাম ও পারভিন সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
বাঃ এইটাত খুবই ভালো খবর!" রফিয়া বলে।
"আলহামদুলিল্লাহ, বাবা, কোথায় পাঠাইতাছে, ইন্ডিয়া? " নুরুল ইসলাম জানতে চায়।
"নাহ, ইন্ডিয়া না, পাকিস্তান! একটা কম্পানিতে আমাদের সফটওয়্যার সেল হইব,সেটার ট্রেনিং দিতে আমারে যাইতে হবে!"
জহির নিচু হয়ে বাবা মাকে পা ছুয়ে ছালাম করে।
"বাবা,খুবই খুশির খবর, খুব খুশি হইলাম, আল্লাহ তুমারে সফল করুন, যাও ঘর গিয়ে হাত মুখ ধুইয়া খাওয়া দাওয়া করগা,যাও।"
নুরুল ইসলাম মন ভরে সন্তানকে দোয়া করেন, মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন।তার চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরে পড়ে!
নুরুল ইসলাম এর মনে সপ্ন ছিল - তার ছেলে জহির ডাক্তার হবে! কিন্তু ডাক্তার না হোক, ছেলে বড় মানুষ হয়েছ,জীবনে সফল হয়েছে, আল্লাহ করুন, ছেলে যেন দেশ বিদেশ করতে পারে তিনি আল্লাহর কাছে সে-ই দোয়া করেন!
সন্তানের জন্য বাবা মার দোয়া আল্লাহ তায়া’লা সব সময় ই কবুল করেন!
আমরা তা পরবর্তীতে জানতে পারব......
যখন
১৯৮৭ সাল।
মার্চ মাসের সকাল।
জহির বারান্দায় ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে।
আয়োজন সামান্য, সিদ্ধ রুটি আর ডিমের অমলেট। সবে নাস্তা মুখে তুলেছে এই সময় গেইটে নক করার শব্দ!
কে?
আমি সুভ্র"
সুভ্র জহিরের ক্লাস ফ্রেন্ড, ক্লাস সেভেন থেকে দুজন এক সাথে।
গেইট খুলে সুভ্রকে নিয়ে ডাইনিং এ বসল জহির।
" নাস্তা খাও।"
" না, আমি খাইয়া আসছি, তুমি খাও।"
আঃ সুভ্রূ রে খাবার সাধলে খায় না!
ঘটনা কি! জহির অবাক হয়।
বন্ধুদের মধ্যে সবচে রুচি বেশি সুভ্রর!
আরে খাও, ডিম ভাজতে বলতাছি আরেকটা, তুমি শুরু কর" জহির আবার সাধে।
না, আমি খামু না, তুমি নাস্তা কর" সুভ্রর জবাব।
নিশ্চয়ই কিছু হইছে!
রুটি মুখে দিয়ে জহির জিজ্ঞেস করে - কি হইছে কও ত?"
"শুনলাম, রেজাল্ট দিছে " সুভ্রর তড়িৎ জবাব।
আঃ
জহিরের গলায় রুটি আটকে যায়।
কো কি! সত্যি! "
হ, ভাইয়া বলল।"
মাথা চুলকাতে-চুলকাতে জহির একটা দীর্ঘশাস ফেলে।
গত তিন টা মাস কত আনন্দে কাটছে!
নানার বাড়ি,দাদার বাড়ি কত জায়গায় বেরানো!
রেজাল্ট এতো তারাতাড়ি দিয়া দিল!
আল্লাহই জানে কপালে কি আছে!
জহিরের গলা দিয়ে আর নাস্তা যায় না।
তাইলে এখন কি করতে হইব?
"চল দেখি, হেডুর বাসায় যাই।স্যার কি কয়" সুভ্র তার সাভাবিক শান্ত স্বরে বলে।
কোন মতে একটা রুটি শেষ করে, আম্মার কাছে যায় জহির।
"আম্মা, দোয়া কইরো, আজকে নাকি আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দিছে। "
রফিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলের মুখে দুশ্চিন্তা! বলেন- বাবা দরুদ শরিফ পড়তে পড়তে যা।তোর রেজাল্ট ভালো হইব, চিন্তা করিছ না।"
ঘর থেকে বেরিয়েই তিতু আর রাসেলের সাথে দেখা।
ওরাও রেজাল্ট এর খবর পেয়ে গেছে!
সবাই মিলে হেড স্যার এর বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল।
এখন বাজে মাত্র দশটা, স্যার এখন বাসায় থাকবেন।
হেড স্যারের বাসা কাছেই, জহিরদের কয়েক বাড়ি পর।
দরজায় নক করতে স্যার ই দরজা খুললেন।
আসসালামু আলাইকুম স্যার।
"ওয়ালাইকুম আসসালাম, তোমরা!এই সময়! "
ছেলেরা মনে মনে বলে - স্যারের দেখি খবর ই নাই!
"স্যার, শুনছি আমাদের রেজাল্ট দিছে! "
"তাই নাকি! ভালো ই ত।"
হেড স্যার এর ভাব সাব হাস্পাতালের কর্মচারিদের মত, যেন রেজাল্ট দেয়া কোন ব্যাপার ই না।
ডাল ভাত!
এদিকে টেনশনে ছেলেদের অবস্থা খারাপ!
শুভ্র জিজ্ঞেস করে - স্যার, আমরা এখন কি করব,রেজাল্ট কখন আসবে স্কুলে? "
"আরে আমাদের মতো ছোটো স্কুলে কি আর সাথে সাথে রেজাল্ট আসে, তোমরা এক কাজ কর, সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলে চলে যাও, ঐখানে গেজেট বই আসে " স্যারের নির্লিপ্ত জবাব।
রাসেল আস্তে করে - স্যার যদি একটু ফোন কইরা দিতেন!"
হুম, তোমরা প্রথমে যাও, সমস্যা হইলে আমি ফোন দিবনে।"
ছেলেরা নিরবে প্রস্থান করে!
একটু দুরে এসে তিতু বলে - হেডুর ভাবটা দেখলি!"
আমগো রেজাল্ট নিয়া কোন আগ্রহ ই দেখাইল না!"
রাসেল অনুযোগ করে।
"স্যার এর মন পইড়া রইছে টিউশনির দিকে, আমাদের রেজাল্ট নিয়া তার কোন টেনশন নাই "- শুভ্র বলে।
চারজনে একটা রিকশা নিয়ে সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
চারজন এক রিকশায় বসার মজাই আলাদা!
দুইজন সামনে, বিচিত্র পদ্ধতিতে দুইজন পেছনে!
এক সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যায়।
যদিও রেজাল্ট এর চিন্তায় কারোও মুখে আজ কোন কথা নেই!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট এ পৌঁছে দেখা গেল এলাহি কারবার!
হাজার হাজার ছেলেদের ভীড়!
আসে পাশের সব স্কুল থেকে ছেলেরা এস হাজির!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলের স্যাররা এত ছাত্র সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন!
" আপনারা শুনেন মন দিয়া, আমাদের এখানে এখনো রেজাল্ট আসে নাই, আপনারা শান্ত ভাবে অপেক্ষা করেন, রেজাল্ট আসলে জানানো হবে! "
জহির শুভ্র তিতু রাসেল স্কুলের মাঠের এক কোনে গিয়ে দাড়ায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
"হেডুর উপরে রাগ উঠতাছে আমার- রাসেল আবার বলে।
আমার ও" তিতুর উত্তর "গতমাসে আমরা যখন খাতা দেইখা দিলাম, কত খাতির, আর এখন যেন চিনেই না!"
"বাদ দে ত, এখন কি করা যায় সেটা বল" জহির তারা দেয়। ওর অস্থির লাগছে রেজাল্ট এর চিন্তায়।
ওদের স্কুলের আরও কিছু ছাত্র এসেছে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল - ইত্তেফাক অপিসে যাওয়া যাক।
রেজাল্ট এর খবর নিশ্চয়ই পত্রিকা অপিসে আগে আসবে!
সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুল থেকে ইত্তেফাক অফিস বেশি দুর না, সবাই হেটেই রওনা হলো।
পরীক্ষার রেজাল্ট জানার এই সব পদ্ধতি ছেলেদের কাছে নতুন, কিন্তু মুখে মুখে খবর ছড়াচ্ছে, আর ছেলেরাও সেটা সাবলীলভাবে করে যাচ্ছে, ওরা জানেনা এই সব অভিজ্ঞতাই ওদেরকে পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এক কদম এগিয়ে রাখে!
কপাল মন্দ, ইত্তেফাক অফিসে গিয়েও জানা গেল, রেজাল্ট আসেনি!
তবে একটা খবর পাওয়া গেল- আজ রেজাল্ট হবে!
বেলা দুইটার পর রেজাল্ট আসবে!
ইত্তেফাক অফিস এর সামনে আজ মনে হয় ঢাকার সব এসএসসির ছাত্র এসেছে, রাস্তার দুই পাশেই ছাত্রদের ভীড়।
শুভ্র হঠাৎ বলে- খিদা লাগছে, কিছু খাওয়া দরকার। "
এটা একটা সমস্যা। কারো কাছে ই তেমন বেশি টাকা নেই, দুপুর হয়ে গেছে, বাইরে খেতে হবে এমন প্রস্তুতি কারোই ছিলো না!
কিন্তু ছেলেরা এটা কে সমস্যা মনে করছে না।
পকেটের সামান্য যা আছে তা দিয়ে ই কলা পাওরুটি চা সিংগাড়া খেয়ে নিল।
এরপর অপেক্ষা!
কখন আসবে রেজাল্ট!
কিভাবে আসবে!
কৌতূহল আবার দুশ্চিন্তা!
অস্থির অপেক্ষা, সময় কাটে না।
বেলা তিনটার কে এসে বলল- রেজাল্ট এসেছে!
ছেলেরা ডানে বামে তাকায়, কই রেজাল্ট কোথায়? ক্লাস ফ্রেন্ড ইকবাল বলে - রেজাল্ট এর জন্য ভিতরে যাইতে হইব, চল দেখি ইত্তেফাক অফিস এ ঢুকি।"
কিন্তু ইত্তেফাক অফিস এর দরজা বন্ধ!
কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
ভেতরে ঢুকতে দিলে এত ছাত্র নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।
কি করা যায়!
কেউ এসে বলল- মতিঝিল থানায় যাই, থানায় গেজেট বই আসে!
এক দল রওনা হলো থানার দিকে।
ইকবাল জহিরদের বলল- যাইছ না, দাড়া একটু, আমার এক আত্তিয় আছে ইনকিলাব অফিসে, দেখি ঢুকতে পারি কিনা।"
বেলা সারে চারটার পরে সুযোগ হলো ইনকিলাব অফিসের ভেতরে ঢুকার, এখানে ও ভীড়, সবাই পরীক্ষার রেজাল্ট এর অপেক্ষায়!
ইকবাল জহিরদের নিয়ে ওর আত্তিয়র অফিস রুমে ঢুকে।
ইকবাল বলে - সবার রোল নাম্বার লেইখা দে।"
ওরা চারজন যার যার রোল লেখা কাগজ এগিয়ে দেয়।
ইকবালের ভাই নাম্বার নিয়ে গেজেট বই এর সাথে মিলাতে থাকে।
" হুম,..... কার নাম্বার? "
শুভ্র বলে, আমার!"
হুম, সেকেন্ড ডিভিশন। "
আঃ শুভ্রর বিসশাস হয় না, সেকেন্ড ডিভিশন কিভাবে হয়!
ফাস্ট ডিভিশন হওয়ার কথা!
একে একে জানা গেল - তিতু রাসেলের রেজাল্ট ও সেকেন্ড ডিভিশন!
জহিরের রোল নাম্বার কোথাও নেই!
আয় হায় কয় কি! জহির মাথায় হাত দিয়ে বসে!
তাইলে কি ফেল?
আব্বা আম্মারে মুখ দেখামু কেমনে!
ক্লান্ত হতাশ ও মনমরা হয়ে জহির তিতু শুভ্র রাসেল আর ইকবাল বেরিয়ে আসে ইনকিলাব অফিস থেকে।
সবার মনেই আশা ছিল - ফাস্ট ডিভিশন পাবে।
এটা কি হলো!
সবচে বেশি মন খারাপ জহিরের। বার বার খুঁজেও ওর নাম্বার গেজেট বই এ পাওয়া যায়নি!
ক্লান্ত শরীরে ছেলেরা এবার রিকশা নিল। কারোই এখন হাটার শক্তি নেই।
চারজনেরই মন খুবই খারাপ।
বাসায় গিয়ে কি বলবে, কিভাবে মুখ দেখাবে!
বাসায় সবাই কত আশা নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে।
কস্টে জহিরের চোখ দিয়ে পানি পরছে, বার বার আব্বার কথা মনে হচ্ছে।
বাবা কত পরিস্রম করে ওদের চার ভাই বোনের পড়াশোনার জন্য! সেই সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, রাত হলে বাড়ি ফেরে! কত কষ্ট করে ওদেরকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য। কষ্টে জহিরের বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
"আমি বিসশাস করি না,আমার রেজাল্ট এমন হইতে ই পারে না! "
তিতুর চোখেও পানি ঝরছে, কোন ভাবে ই ওর রেজাল্ট মানতে পারছে না!
রিকশা যখন ফকিরাপুলের সামনে দিয়ে পার হচ্ছে, তিতু বলল- আমি মতিঝিল থানায় আবার রেজাল্ট দেখুম, রিকশা থামা!"
জহির ও বলে - চল আমিও যাই তোর সাথে। "
শুভ্র আর রাসেল বাসায় চলে যাবে, তিতু আর জহির মতিঝিল থানার দিকে ক্লান্ত পায়ে হেটে যায়।
যথা রীতি এখানে ও ভীড়।
তবে থানার ভিতর বলে ছাত্ররা সবাই লাইন ধরে ভদ্র ভাবে অপেক্ষা করছে। ওরা দুজন লাইনে দাড়ায়।
প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর ওদের সিরিয়াল আসে। সামনে তিতু পেছনে জহির।
"রোল কত - কাউন্টার থেকে জানতে চায়।
তিতু রোল নাম্বার বলার পর লোকটা গেজেট বই চেক করে বলেন - সেকেন্ড ডিভিশন। আগে?"
জহির মনে আশা নিয়ে রোল নাম্বার বলে।
লোকটা যথাযথ ভাবে চোখ বুলিয়ে বলে - হুম,সেকেন্ড ডিভিশন এ নাই!"
কাঁদতে কাঁদতে জহির বলে - আংকেল একটু থার্ড ডিভিশনে দেখবেন? "
লোকটা প্রায় ধমক দিয়ে বলে - থার্ড ডিভিশনে কেন ফাস্ট ডিভিশন এ দেখতাছি, হুম...."
জহির ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে।
"নাম্বার কত?" লোকটা আবার জানতে চায়।
"......৮৩" জহির জবাব দেয়।
"ফাস্ট ডিভিশন! আগে " লোক টা অবলীলায় বলে তারা দেয়।
জহিরের বুক ধক করে উঠে!
"আংকেল, আবার দেখেন, প্লিজ! "
"আবার দেখার কিছ নাই, আমি চেক কইরা ই বলছি,আগে!"
জহির খুশিতে চিৎকার করে উঠে!
দুই হাত উচু করে লাফিয়ে লাইন থেকে বের হয়।মনে মনে কাউন্টার এর অপরিচিত লোকটার জন্য দোয়া করে, সেই ইনকিলাব অফিস থেকে অন্যদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর কারো ফাস্ট ডিভিশন এ চেক করার কথা মনেই আসেনি!
পাশে তিতুর মন খারাপ, তবুও জহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
"যাক, তোর রেজাল্ট ত ভালো হইছে,চল বাসায় যাই।"
এক রিকশায় দুজনে বসা। রিকশা চলছে রাজার বাগ মোড় পেরিয়ে শাজাহান পুরের দিকে। তিতু আর জহির দুজনেই কাঁদছে!
একজনের মন খারাপ, আরেক জনের মনে আনন্দ!
মানুষ যে আনন্দে ও কাঁদে জহির তা জীবনে প্রথম উপলব্ধি করে!
বিঃদ্রঃ এই ঘটনার বর্ননার কিছুই বানানো নাই, সকল ঘটনা ই হুবহু লেখা হয়েছে! বরং হেড স্যারের ব্যাপার এ আমাদের মন্তব্য এর ক্ষেত্রে কিছুটা ভদ্র ভাষায় লিখেছি, বাস্তবে আমরা যেসব গালি দিয়ে ছিলাম তা উল্লেখ করা হয় নাই।
মাশাল্লাহ, এখন ছেলে মেয়েরা কত সহজে মোবাইলে রেজাল্ট পেয়ে যায়! আমাদের সময়ের চিত্রটা ধরে রাখার জন্যই এই প্রয়াস।
যখন
ছেলেটা দেখতে রাজপুত্রের মত! চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের হবে।
মাথায় টুপি, সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা গায়ে।
মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল পেরিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। হাটার মধ্যে ইতস্তত ভাব! এদিক ওদিক তাকায়, সামনে একটা কাচা বাজার দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে দোকান পাঠ কম।
মাদারটেক বাজারের সামনে এসে দাড়ায়।
একটা পান দোকানের এসে ঢোক গিলে।
এর নাম ঢাহা, কুন কিছু চিনন যায় না! মনে মনে বলে।
তার ভাব সাব দেখে দোকানদার জিজ্ঞেস করে - এই ছেলে কিছু খুজতাছ নাকি!"
লোকটার প্রস্ন শুনে চমকে উঠে ছেলেটা!
আবার ঢোক গিলে বলে - বড় বইনের বাসা খুজতাছি, নামা গোরান, দুলা ভাইয়ের নাম নুরুল ইসলাম! "
"এহ, নামা গোরান! নামা গোরান এর রাস্তা ত পিছনে ফালাইয়া আসছ! বাসার নাম্বার কত?"
বাসার নাম্বার ত জানি না!"
কউ কি! বাসার নাম্বার ছারা ঢাকা শহর এ ঠিকানা খুইজা পাওয়া যায়? "
বেলা প্রায় তিনটা বাজে।
রফিয়া মাত্র বাচ্চাদের নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে শোয়ার ঘরে রেডিও নিয়ে বসেছে, কোলকাতা আকাশ বাণী ধরার চেষ্টা করছেন, আজ সাপ্তাহিক নাটক হওয়ার কথা।
হঠাৎ জানালার পাশ থেকে আওয়াজ শুমা যায় - আফা, জহির! "
রফিয়া চমকে উঠেন।
জহির বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে।
দুজনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
"আরে! ওদুদ তুই! "
তুই কইত থেইকা আইলি!"
জহির দৌড়ে গিয়ে গেইট খোলে।
অবাক হয়ে ছোট মামার দিকে তাকায়।
ওদুদ মামাকে একদম চেনা যাচ্ছে না!
মাথায় টুপি! গায়ে পাঞ্জাবি পায়জামা!
"কিরে তুই কেমনে? আব্বা মায়র শইল ভাল নি, আব্বারে বইলা আসছস নাকি না"
রফিয়া জিগ্যেস করেন।
"হ, সবাই ভাল" সেই রাজপুত্রের মত ছেলেটা মুচকি হেসে বলে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে বোনের বাসা খুঁজে পাওয়া গেছে! ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ঠিকানা ছাড়া বুঝি বোনের বাসা খুঁজে পাবে না!
রফিয়া চোখ বড় করে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
মুখ ভরা হাসি দিয়ে ওদুদ জিজ্ঞেস করে - আফা তুমরা কেমন আছ? দুলাভাই কই?"
"তর দুলাভাই ত এই সময় অফিসে থাকে, তুই কেমনে আইলি সেইটা ক?"
রফিয়ার কন্ঠে সন্দেহ!
ওদুদ আবার মুচকি হেসে বলে - আফা ভুক লাকছে, ভাত দেও।"
ওহ হো,হ হ, তুই হাত মুখ ধুইয়া ল, জহির তোর মামারে গোসল খানা দেখাইয়া দে।"
জহির ওদুদ কে নিয়ে গোসল খানা দেখিয়ে দেয়।
পেছনে রফিয়া বির বির করেন- নিশ্চয়ই মাদ্রাসা থেইকা আবার ভাগছে!
ছোট ভাইয়ের স্বভাব রফিয়ার জানা। এই ভাইটার লেখা পড়ায় মন নেই, আব্বা অনেক চেস্টা করে শেষে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছে,যদি হাফেজি লাইনে কিছু হয়!
কিন্তু এই ছেলের ঘর পালানো স্বভাব!
শিতল পাটি বিছিয়ে ভাইকে খাবার বেরে দেয় রফিয়া।
আয়োজন আজকে তেমন ভালো না। লাল শাক ডাইল আর আতপ চালের ভাত!
রেশন কার্ডে আতপ চাল দেয়। জহিরের খুব প্রিয় আতপ চালের ভাত!
" আমরা ত আতপ চাইল খাই, রেশনে দেয়, তর খাইতে কস্ট হইব!"
"আফা যে কি কউ, মাদ্রাসার খাওনের লগে এই ভাত ত অম্রিত!"
অদুদ লাল শাক দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলে। সাদা আতপ চালে লাল শাক এর রং টুক টুক করে!
"আফা, আমরার জহির ত দেখি এই এলাকায় খুবই জনপ্রিয়! বাসার নাম্বার ছারা আমি ত তুমরার বাসা খুইজাই পাইতাছিলাম না! শেষে জহিরের বয়সি একটা ছেলে আমারে কইল, আপনে জহির গো বাসা খুজেন, আমার সাথে আসেন, ছেলেটার নাম কচি না টুটুল জানি কইল!"
ওদুদ হাসতে হাসতে ডাল আর ভাত মজা করে খায়।
এদিকে রফিয়া মনে মনে টেনশন করে, আব্বা রে কেমনে খবর পাঠাইব, মায়ো না জানি কত দুশ্চিন্তা করতাছে!
Monir:
মামাদের কথা বলতেছিলাম, আম্মার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ওয়াদুদ মামা, আমার সবচেয়ে পছন্দের মামা, উনাকে আমার খুব পছন্দ, ছোট মামা মানেই আমার কাছে ছিলো আনন্দের খোড়াক, মামাকে আমি মোটামুটি আমার জীবনের আদর্শ হিসাবেই নিয়া নিতাম যদি দেখতাম উনি ইকটু অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ মানে যাকে আমরা আক্ষরিক ভাবে স্যাটেল্ড বুঝি। ছোটমামার জীবন টা কোন অংশে কম এ্যাডভেঞ্চারাছ ছিলো না, উনার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাতো সবাই কম বেশি শুনছো, আমার কাছে ছোটমামা মানেই এক মজার মানুষ, কথা নাই বার্তা নাই হুট করে এক প্যাকেট মিস্টি নিয়া হাজির, আরে বেপার কি!!! মিস্টি?? কোন কারন নাই, ঐ সময় কারন ছাড়া মিস্টি ভাবা যায়না, আম্মা জিজ্ঞেস করে সত্যি কইরা কো তোরকি বেতন বাড়ছে? মামার নির্বিকার উত্তর ধুরো দিদি, বেতন বাড়লে তুমরারে কইতে আমার আমার অসুবিধা আছে, আম্মার মনে সন্দেহ থাকলেও আমার বেজায় আনন্দ, দারুন মিস্টি বংশালের নামকড়া মিস্টি, আলাউদ্দিনের মিস্টির চেয়ে দামি, সেইরকম টেস্ট, মামা তখন আমাদের বাসায় থাকে বংশালে চাকরি করে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে হুট করে বলে চলো ভাইগনা আজকা মজা দেখতাম যামু আমি উঠে ঝটপট রেডি। মামাকে জিজ্ঞেস করি কি মজা মামা?? মামা বলে খাইয়া নাচুনি আমার মজা লাগে কিন্তু খাইয়া নাচুনিটা কি সেইটা বুঝি না, ২৬শে মার্চ বেশ সকাল সকাল আমাকে নিয়া মামা বেড় হলেন, নিয়া গেলে ঢাকা স্টেডিয়াম যেটা এখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামে ঢুইকাতো আমি টাস্কি, আয় হায় এইটা কই আইলাম!!! এতো এতো মেয়ে ছেলে এতো এতো কালারের ড্রেস পরে আছে কেন? এরমধ্যে আবার ইয়া বড় বড় ঘোড়া বেশ দারুন খেলা দেখাইলো একদিকে কুচকাওয়াজ অন্যদিকে ভারতশ্বরী হোমস এর মেয়েদের এক্সেলেন্ট এক্রোবেট কিছু এতিমখানার ছেলেরাও দুর্দান্ত পারফর্ম করলো, রাস্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আসলেন মিশুক(হরিণ) এর লোগো যেটা পরবর্তী তে সার্কের বাংলাদেশের লোগো উন্মোচন করলো হাজার হাজার বেলুন উড়ানো হলো প্রচুর কবুতর ছারা হইলো আমার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে রইলো, আবার সামনে হয়তো কোন একটা ছুটির দিন আসতাছে মামা আগেভাগে এসে আম্মা বলবে দিদি পুরশুদিন সকাল সকাল সব রান্না শেষ কইরা লাইবা, একদম রাইতেরটা শুদ্দা কাহিনি কি? কাহিনি আছে ব্যস নির্ধারিত দিনে দেখা গেলো মামা কইত্থিকা জানি ভিসিপি ভাড়া কইরা নিয়া আসতো সাথে ৫-৬টা সিনেমার ক্যাসেট, ১৫-২০ঘন্টা একটানা মুভি চলবে, ঐদিন লোন লেখাপড়া নাই আহা কি আনন্দ!!! শুক্রবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রেডিওতে নাটক শুনতাম মামা আমাদেরকে লাগায় দিতো পাকা চুল বাছতে প্রতিচুলে পয়সা পাবো মোটামুটি মামার সবকিছুই আমাদের ভাল লাগে যা করে তাই আনন্দ। ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফুটবল, ঐ সময় চির প্রতিদন্ধি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার খেলা, তখন সাপোর্টাররা এখনকার মত এতো ম্যাচিওর ছিলোনা, তখন সাপোর্টার মানে সাপোর্টার বিপক্ষের কোনো প্লেয়ার ভাল খেললেও প্রশংসা করা যাবেনা কেউ যদি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হয়ে ব্রাজিল এর কারো খেলার সুনাম করে তাইলে ও দালাল, ঐ বেটা শেষ ওর জীবন তেজপাতা, সো যে ব্রাজিল ব্রাজিলই যে আর্জেন্টিনা সে আর্জেন্টিনা ই। নো ধুন ফুন। খেলা শুরু হইছে আর্জেন্টিনা ব্রাজিল। ব্রাজিলের খেলা কি সুন্দর নান্দনিক, কিন্তু আমাদের সবার পছন্দ ম্যারাডোনার জন্য আর্জেন্টিনা, মামা কোন পক্ষে বুঝা যাচ্ছে না। ম্যারাডোনা বল নিয়া আগাইতে পারেনা তার আগেই ফাউল করে ফেলে দেয় আমরা হতাশ হই রাগ হই ব্রাজিলের প্লেয়ারদের বদদোয়া দেই। পুরা খেলা ব্রাজিল ভালো খেলেও আর্জেন্টিনা গেলো জিত্তা, ওহঃ সেকি আমগো খুশি হঠাৎ চাইয়া দেহি ছোটমামা কলপাড়ে আমাদের টিউবওয়েল এর নিচে মাথা দিয়া বইয়া আছে পানি ঢালতাছে, এতক্ষণে বুঝাগেলো মামা কোন দলের, আব্বা কয় হেরে জিগাও বাজিটাজি ধরছেনি কারো লগে🤪🤪🤪
Suraiya:
মনির মাহাবুব এর চাচা শশুর আর কেন নানা বাড়ি আইব না কিন্তু ক্লিয়ার ভাবে বুঝতে পারলাম না। নানি বাড়ি তে চা বানানো নিয়া ঠেলাঠেলি বিশেষ করে মেজমামির সাথে অত্তন্ত কমন একটা ব্যাপার আমরা এই ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর মামার এই বাজিতে হারার গল্পটা আমি বহুবার তোর দুলাভাই এর সাথে সেয়ার করেছি আর হেসেছি। তবে আব্বা ও মে আমাদের সাথে বিশ্ব কাপ ফুটবল দেখত ভুলে গিয়েছিলাম। দৃশ্য টা এখন ও চোখে ভাসছে । খেলা দেখতে দেখতে যে দিন ঘুম পেয়ে যেত তখন বলতে খেলোয়াড় রা খেলতে কি কম খেলতে কি কম খেলব ওরা খেলুক আমি ঘুমাই।অথচ আব্বার ঘরে ই টিভি থাকার জন্য আমরা ও ঘরে বসে ই খেলা দেখতাম কিন্তু একটু ও বিরক্ত হতো না যেটা আব্বার পরিচিত কেরেকটারের সাথে যায় না। কি বলিস? আমি কিন্তু আব্বাকে বাংলা ছবির গানের সাথে নাচতে ও দেখেছি। কি রকম এক অদ্ভুত মুরগি করে আব্বা নাচত।
Suraiya:
মনির তোর সাথে কথা টা সেয়ার করেই ফেলি ছোট মামা তার উল্লেখযোগ্য অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সব সময়ই ভাগছি দেন ঠিক ই আসল সময় টা তেই ভাঙ্গতে পালন নাই। কি বলিস?
যখন
সাল ১৯৭৫
১৫ আগস্ট।
জহির ওর আব্বার হাত ধরে হেটে যাচ্ছে, যাবে বাসাবো বাজার। ছোট মানুষ! সাত বছর বাচ্চা! বাবার সাথে হেটে কুলাতে পারছে না। তবুও কোন অভিযোগ নেই। বাবার সাথে বাজারে আসার সুযোগ কমই হয়। যদিও বাজারের ভিতরে যাওয়া হয়না জহিরের।
বাসাবো বাজারে আগে মোড়ে নুরুল ইসলাম এর বন্ধু আজিজ সাহেব এর ওষুধের দোকান আছে। সেখানে জহির কে বসিয়ে নুরুল ইসলাম বাজার করেন, যাওয়ার সময় জহিরকে নিয়ে যান।
আজ রাস্তা ঘাট ফাঁকা! এমনিতেই হালকা বসতি, তার উপর আজ যেন রাস্তায় কোন লোকই নাই!
পাটোয়ারী বিল্ডিংয়ের মোড়ে এসে নুরুল ইসলাম ডানে বায়ে তাকায়, ব্যাপার কি, সব দোকান পাট বন্ধ! দূরে দুরে একটা দুটি লোক নজরে আসে। কাল রাতে কোন একটা সমস্যা হইছে মনে হয়! নুরুল ইসলাম বির বির করেন।
হঠাৎ বাম দিকের রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়- মিলিটারি আইতাছে, মিলিটারি আইতাছে!
"কয় কি! মিলিটারি কইত্তে আইলো" নুরুল ইসলাম জহিরের হাত ধরে শক্ত করে।
রাস্তায় কিনারায় দুই কদম পিছিয়ে দাড়ায়!
দুর থেকে দেখা যায় মিলিটারি ট্রাক আসছে! পর পর তিনটা মিলিটারি ট্রাক ওদের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে পার হয়ে গেল,ট্রাকের ভিতর কালো পোশাকের সৈনিক! হাতে মেশিন গান!
জহির অবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে!
পেছন থেকে কে যেন বলে - এক্কেরে মিলিশিয়া বাহিনীর মত!"
শিশু জহিরের শরীর কাপতে থাকে ভয়ে! বাবা জহিরকে কোলে তুলে নেয়!
"কি হইছে রে ভাই, কি হইছে! "
কেউ কোন কথা বলে না! সবাই ভীত!
এলাকায় সবার ঘরে রেডিও নেই, তাই ওরা জানে না, কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে!
১৪৪ ধারা!
আজ এই দেশের সবচেয়ে বড় কলংকের দিন!
গত রাতে সপরিবারে শেখ মজিবুর রহমান কে হত্যা করা হয়েছে!
যখন
আজ আবাহনী মোহামেডান খেলা!
হারুন ভাইয়ের সাথে জহির আর সোহেল যাচ্ছে খেলা দেখতে। জহির সোহেল এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। হারুন ভাই এখন কলেজে পড়েন। খিলগাও মডেল কলেজ। তিন জন এক রিকশায় বসা।
জহির খুব উত্তেজিত, আজ ওর জীবনের প্রথম স্টেডিয়ামে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখা হবে! সোহেল অবশ্য এর আগে কয়েক বার ওর মামাদের সাথে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখেছে।জহিরের দিকে তাকিয়ে হারুন ভাই জিগ্যেস করে - তাইলে কি বলছি মনে আছে তো? আমরা কোন দলের সাপোর্টার? "
সোহেল জহির দুইজন ই এক সাথে বলে - আবাহনী! "
যদিও জহির সোহেল এত সিরিয়াস না, সাপোর্ট এর ব্যাপার নিয়ে কিন্তু হারুন ভাই আবার বলে - মনে থাকে যেন, জীবনে ও মোহামেডান এর নাম লবি না, কিরা খাইয়া ক।"
দুইজনই অবলিলায় মাথা কিরা খায়।
রিকশা এসে বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে এসে থামে।
জহির সোহেল রিকশা থেকে নেমে হারুন ভাই এর পাশে দাড়ায়।
হারুন ভাই বলেন - সব সময় আমার হাত ধইরা থাকবি,নাইলে কিন্তু হারাইয়া যাবি!"
সোহেল ও জহির শক্ত করে হারুন ভাইয়ের হাত ধরে।
স্টেডিয়াম লোকে লোকারণ্য, তীল ধারনের জায়গা নাই, আবাহনী মোহামেডান খেলায় এটা সাভাবিক!
কোন মতে টিকেট কেটে ওরা গিয়ে ভেতরে ঢুকে গ্যালারিতে বসে। খেলা শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই।
জহির অবাক হয়ে স্টেডিয়ামের চারিদিকে তাকিয়ে দেখে।
হারুন ভাই আংগুল দিয়ে ইশারা করে দেখায় - ওইদিকে মোহামেডান এর সাপোর্টার বসে,জীবনে ভুলে ও ঐদিকে গিয়া ববিনা! মাইর খাইয়া ভুত হইয়া যাবি।"
জহির মনে মনে আরো অবাক হয়! ঐদিকে বসলেই মাইর খিতে হবে।
আবাহনী মোহামেডান এর সাপোর্টার এর পাগলামির কোন শেষ নাই।
আসে পাশে কিছু ফেরিওয়ালা হাটে আর ডাক দেয়- ঝালমুড়ি! বাদাম বুট! সিগারেট!
হারুন ওদের বুট কিনে দেয়, আর নিজের জন্য এক্টা সিগারেট কিনে ধরায়।
সোহেল চোখ বড় করে বলে - আপনে সিগারেট খান!"
"অই চুপ, খবরদার কইতাছি, বাসায় কাউরে কবিনা! কইলে ঠুয়া খাবি!"
জহির ও সোহেল বুট যেতে খেতে মাথা নারে।
কিছক্ষন পর খেলা শুরু হয়। দুই পাশের সাপোর্টারদের মধ্যেই চরম উত্তেজনা!
হারুন ভাই তার বাবরি চুল ঝাকিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। আবাহনীর দলের কেপ্টেন সালাউদ্দিন এর মত লম্বা চুল এখন ফ্যাশন!
তাকে চিন্তিত দেখায়। মাঠের ভাব ভালো না।যে কোন সময় মারামারি লাইগ্যা যাইতে পারে!
পনের মিনিটের মাথায় টুটুল একটা গোল করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় মারা মারি!
আয় হায় কি হইতাছে এইসব! খেলা তো মনে হয় বানচাল হইয়া যাইবো!
হারুন আক্ষেপ করে, তার দুশ্চিন্তা আরও বারে।
সাথে দুইটা বাচ্চা ছেলে! ওদের আম্মা বার বার করে বইলা দিছে - বাবা, আবাহনী মোহামেডান খেলা! তুই কিন্তু অগরে দেইখা রাখিস!
শালা , পরবি পর মালির ঘারে! আইজই মারামারি লাগার দরকার ছিলো!
হারুন জহির ও সোহেল কে দুই হাতে ধরে - উঠরে, মারামারি লাগছে, খেলা বাতিল হইব, চল তাড়াতাড়ি, না-ই লে পরে বাইর হইতে পারুম না!"
জহির ও সোহেল ভয় পেয়ে যায়। হারুন ভাই ওদের নিয়ে লোকের ভীর সামলে এগুতে থাকে। ও লোকই খেলা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে!
হারুন জহির আর সোহেলকে দুই হাতে জড়িয়ে মাথা নিচু করে দৌড়াচ্ছে! সবাই যেন একসাথে বের হতে চায়! কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতা! এদিকে স্টেডিয়ামের ভিতর তোলপাড় অবস্থা! উগ্র জনতা ভি আই পি গেলারির সিট ভাংচুর করছে, লোহার গ্রিল ভাঙচুর করছে, হুলুস্থুল অবস্থা! আবাহনী মোহামেডান খেলায় যদি মারামারি লাগে পুলিশ বা কারোও পক্ষে ই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়না!
এনিয়ে বার বার দৈনিক পত্রিকা, টিভি তে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কে শুনে কার কথা!
শত হলেও হুজুগে বাংগালী বলে কথা!
হারুনভাই ওদের দুজনকে শক্ত করে ধরে বলে - মাথার উপরে হাত রাখ, বদমায়েশের বাচ্চারা ঢিল মারবো কইলাম, সাবধান! "
জহির এবং সোহেল দুজনেই ভয়ে আধমরা অবস্থা! বাইতুল মোকাররম মসজিদের পাশের গেইট দিয়ে হারুন ওদের দুজনকে নিয়ে কোন মতে বেরিয়ে আসে! ওদের মাথার উপর পানির ফোটা পড়ে!
খবরদার উপরে তাকাইছ না,শালার পুতেরা উপরের থেইক্কা মুত্তাছে!"
চোখ বন্ধ করে ওরা দোউড়ে জায়গাটা পেরিয়ে আসে। ভাগ্য ভালো, তিন জনের শরীরেই অল্প পানির ছিটা লেগেছে!
এক দৌড়ে হারুন ওদের নিয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে এসে দাড়ান। এদিক ওদিক তাকায়, যদি রিকশা পাওয়া যায়। রিকশা দুরে থাক, একটা যানবাহনও নজরে পরে না! মারামারির খবর ছড়িয়ে পড়েছে! এদিকে আজ আর কোন পরিবহন আসবে না।
"কপাল খারাপ, তোগরে লইয়া আইজ খেলা দেখাইতে আনলাম" হারুন আক্ষেপ করে বলে - আইজ মারামারি লাগলো!"
জহির সোহেল কোন উত্তর দেয় না, ওরা খুবই ভয় পাচ্ছে!
হারুন ভাই আবার বলেন- ভয় পাইছ না, আমরা এক সাথে থাকলে কোন ভয় নাই!"
একটু দম নিয়ে বলেন - হাইট্টা যাইতে হইব, পারবিনা?"
দুজনেই মাথা নারে,মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না!
চল আগাই" বলে হারুন ভাই ওদের নিয়ে ফকিরাপুল এর দিকে হাটতে থাকে।
দুইহাতে দুজনকে শক্ত ভাবে ধরে রেখেছেন!
রাস্তার দুই পাশে ই লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে। জহির আর সোহেলও ভয়ে দৌড়াতে চায়! হারুন ভাই বাধা দেন।
"দৌড়াইছ না, তোগ কস্ট হইব, ছোট মানুষ, হাপাইয়া যাবি!"
তিন জনই দ্রুত গতিতে হাটছে! হঠাৎ পিছনে চিৎকার শুনা যায়,কিছু লোককে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখা যায়! মনে হয় মোহামেডান এর সাপোর্টার!
জহির ও সোহেল ভয়ে কাঁপতে থাকে!
হারুন ভাই ঘাবড়ে গেলেও ওদের দুজনকে শক্ত করে ধরে রাখেন।
"ভয় পাইছ না, তোরা ছোট মানুষ, তোগরে কিচ্ছু করব না, আর আমারে যদি কিছু করেও তোরা একদম চুপ থাকবি, খবরদার ভয় পাইছনা!"
ভেতরে ভেতরে নিজেই ভয়ে কাপছে! লোকগুলো একদম কাছে এসে গেছে! প্রায় বিশ তিরিশ জন! আল্লাহ ই জানেন কোন দলের সাপোর্টার! এমন সময় নয়া পল্টনের গলি থেকে লাঠি সোটা হাতে কিছু ছেলে দৌড়ে আসে! মুহুর্তে দুই দলের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়!
হারুন ভাই তারাতাড়ি ওদের দুজনকে নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে দৌড়াতে থাকে।
জহির আর সোহেল কষ্ট হলেও দৌড়াতে থাকে। এক দৌড়ে রাজার বাগ পুলিশ লাইন!
তিন জনের দলটা এখানে কিছক্ষন দাড়ায়, মনে আশা পুলিশ লাইন এর কাছে কোন সমস্যা হবে না।
একটু পর আবার হাটতে থাকে, রাজার বাগ মোর এসে ভাগ্য ক্রমে একটা রিকশা পায়!
তিন জন ই লাফিয়ে উঠে রিকশায়।রিকশা ওয়ালা তারা দেয়, রাস্তার অবস্থা ভালো না।
কিছক্ষন চুপচাপ চলার পর হারুন ভাই বলেন - বাসায় গিয়া কিন্তু ভুলেও মাঠের মারামারির কথা কবিনা, নাইলে আর জীবনে ও স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দিব না কইলাম! "
জহির আর সোহেল একজন আরেকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়, হারুন ভাই কয় কি! স্টেডিয়ামে আরও খেলা দেখতে আসব!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন