শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

এখন তখন কখন


এখন তখন কখন
মোঃ জহিরুল ইসলাম














কখন

বৃহস্পতিবার, বাদ মাগরিবফেব্রুয়ারী মাস, ১৯৮৩.
ক্রোধে অন্ধ আবদুল ওহাব জোর কদমে হেটে যাচ্ছে তার পরিনতির দিকেসে জানে না। ব্রাম্মনবাড়িয়া রেলস্টেশন  থেকে কখন লোকাল ট্রেনে উঠেছেনকখন তালশহর নেমেছেন হুশ নেই।
হাটছেন আর বিরবিরিয়ে নিজেই বলছেনকত বড় সাহস আমার নাতিরে রাখে
সেই দুপুর থেইকা আমি নাতির জন্য বইসা রইসি! আমার পেটপুড়ার কোন দাম নাই
তালশহুর রেলস্টেশনে নেমে তিনি পাগলের মত হেটে চলেছেন পশ্চিমেসামনে একটা কালভার্টতিনি মনোযোগ না দিয়ে হেটেই চল্লেন, চোখে চশমা নাইএদিকে আধার ঘন হয়ে এসেছে। 
রাগে তার সারা শরীর কাপছে। সন্তান বাতসল্যে তিনি ভুলে গেছেন রাগ করা হারাম।
আজ দুপুর থেকে অপেক্ষা করছেনবড় ছেলে বউ নাতিকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে ফিরবে, প্রাণ প্রিয় নাতির জন্যে অপেক্ষা!  
কথায় আছে_ রাজার বাড়ির হাতি, গরিবের ঘরের নাতি
দুইটাই বড় প্রিয়
অবশ্য নাতির শখ আবদুল ওহাব এর পুরো হয়েছে আরো বহু বছর আগেইতার কলিজার টুকরো বড় মেয়ে রফিয়ার ছেলে জহিরের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের দেড় বছর আগে। প্রথম নাতিকে নিয়ে কত আনন্দ! কিন্তু মেয়ে থাকে ঢাকায়, চাইলে নাতির মুখ দেখা যায় না। তাই বড় 
ছেলে আউয়ালের সন্তান হওয়ায় পর যেন তিনি হাতে চাদ পেলেন। আপন খেলার সাথী!
নাতিকে নিয়ে যা- করেন মন ভরে না। গত সাপ্তাহে তাই ছেলে যখন শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা বলল, ওহাব সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়।  কিন্তু কি করা যাবেছেলের বউও খুব ভালো মেয়েতাকেও কষ্ট দেয়া যায় নাযাক বাপের বেরিয়ে আসুক, উনার আপত্তি নেই। 
বার বার করে বলে দিলেন _বউআমার ছেলে তো তোমাদের বাড়ি গেলে আর আসতে চায় না। কিন্তু আমার দিকে চাইয়া মাহবুব রে নিয়া সামনের  বৃহস্পতিবার চইলা আইসো। 
সারা সপ্তাহ তার নাতিকে ছাড়া কিভাবে কেটেছে তিনি জানেন। আজ বিসুদ বার, সকাল থেকে অপেক্ষায়আউয়াল নাতিকে নিয়ে ফিরবে! নাতির হাসিতে ঘর উজ্জ্বল হবে। 
কিন্তু সারাদিন পর ছেলে ফিরলো একা

ছেলের সাথে নাতিকে না দেখে ওহাব সাহেবের মাথা খাবার হয়ে গেলো।  
তিনি তখনি রউনা হলেন তালশহর, ছেলের বউকে জিজ্ঞেস করবেন _ বাপের বাড়ি এসে আমাকে ভুলে গেলাআমার নাতিকে না দেখলে মন কেমন করে ভুলে গেলা

রাগে আবদুল ওহাব হাটছেন, জোড় কদম হাটা! সামনে কালভার্ট তিনি খেয়াল করলেন না। 
অন্ধকারে পা দিয়ে তিনি নিচে পড়ে গেলেন। 
.......
পাশের গ্রাম থেকে দুজন লোক আসছিলো রেলস্টেশন এর দিকে, কালভার্টের কাছে আসতেই ধপ্  করে কিছু পরার আওয়াজ পেল!
এই কি হইলো রেকালভার্টের উপর থেইক্কা কিছু পরছে মনে হয়
দুজনে দোউরে এসে দেখলেনআবদুল ওহাব পড়ে আছেন! অবস্থা খুবই খাবার। দুজনেই ডাকাডাকি করে লোক জরো করে দ্রুত উনাকে রেলস্টেশনে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে বহু লোক জরো হয়ে গেলোভাগ্য ভালো তখনই একটা ট্রেন ঢাকা থেকে আসছিল, সবাই মিলে  উনাকে ট্রেনে তুললেন। 
.….
রাত প্রায় আটটার দিকে এলাকার ছেলেরা এসে খবর দিল, আউয়াল ভাই, জলদি জেলা হাসপাতালে যান। তুন্দুল হুজুরের অবস্থা খারাপ!

********
                                         
                                        তখন

নুরুল ইসলাম পাগলের মত দোউরাচ্ছেআর বার বার পিছনে ফিরে দেখছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে শুনেই তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, " আমি জহিররে নিয়া গেলামতোমরা সবাই একসাথে থাইকো। "
রফিয়া বলল  -  তুমি শুধু ছেলেরে নিয়া গেলে হবেআম্মাআমি আর অন্যদের কথা চিন্তা করতে হইব না? "
নুরুল ইসলামের জবাব  - তোমরারে দেখার জন্য বড় ভাই আছেন, সেই দেখবো, আমি আমার ছেলেরে নিয়া মসজিদে যাইতাছি। আল্লাহ বাচাইয়া রাখলে আবার দেখা হইব। "
বলে তিনি ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে দোউরে বেরিয়ে গেলেন। 
পেছন থেকে রফিয়া হতবাক হয়ে সন্তান বাতসল্লে অন্ধ পিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন
পিতা তার ছেলেকে বুকে জরিয়ে পরিবারের আর সকলকে ভুলে শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কথাই ভাবছেন
আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটারে বাচাও

এখন

জহিরের অফিস যেতে আজ দেরি হবে। খুব সকালে স্বামি স্ত্রী তাদের মেয়ে রাফাকে নিয়ে 
পদ্মা ডায়াগনোসিস এসেছেমেয়ের রক্ত পরিক্ষা করতে হবে।  কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর এল তাদের সিরিয়াল। জহির মেয়ে রাফাকে কোলে নিয়ে নার্সের  সামনে দাড়ালো। মেয়ের বয়স  মাত্র দুই। ছোট্ট টুনটুনিনার্স সাভাবিক ভাবে বাচ্চার হাতে টিপে টিপে দেখছেন, কোন হাত থেকে রক্ত নিবেন। 
মেয়ে কান্না শুরু করে দিল! নার্সের এদিকে কোন খেয়াল নেই! ইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দিলেন অবলিলায় ছোট্ট শিশুর হাতে। মেয়ে চিৎকার করে উঠলো। জহির শক্ত করে মেয়েকে জরিয়ে ধরলো। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তার বুকের ধন সোনার ময়না ব্যথায় কাদে! পারভীন পাশ থেকে জহিরের কাধে হাত রাখে। বাবা আরোও শক্ত ভাবে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে। 
হে আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে সুস্থতা দাও

*******

জহির অনেক দিন পর জাপান থেকে ট্রেনিং শেষে ফিরছেন আজ। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আসতে রাস্তা যেন ফুরায় না। 
ঘরের দরজায় সবাই অপেক্ষায়। জহিরের সাথে ব্যাগ ভরতি গিফট। হৈচৈ আনন্দের মধ্যে ঘরে ঢুকল। 
সবাইকে বুকে জরিয়ে কত কথা আর চোখ খুজছে মেয়েদের। রাফা ইফা কোথায়
ছোট মেয়ে ইফাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। 
মেয়ে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে!
"আয় হায়, ইফার কি হইছে। "
ইফার মারাত্মক অসুখ হইছিল, তুমি বিদেশে কস্ট পাইবা সে জন্য তোমারে বলি নাই! "
বাবা, ইফার জন্য আনা খেলনা সাইকেল, গাড়ি সবকিছু বের করে মেয়ের হাতে দেয়। ইফা দুর্বল শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে একমনে খেলতে থাকে। শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। 
মেয়েকে আনন্দে হাসতে দেখেও বাবার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ে।



                                        তখন

ভাই, তুমি খাও না যে! " রফিয়ার হাতে আইসক্রিম, মুখে তেতুল! কথা বোঝা যাচ্ছে না।  
আব্বাস জিজ্ঞেস করল -কি কস? বুঝিনা!
ইস! " আইসক্রিমে কামড় দিয়ে বলল, তুমি কুলফি খাইবা না
তুই খাপাগলি কুনখানকারকুলফি আর তেতুল মাইনসে একলগে খায়
আমি খাই, আমার ভালো লাগে, তুমি না খাইলে নাই," রফিয়ার জবাব। 
কি, তোর এত্ত সাহস! দাড়া আইজ ঘরে গিয়া মামুরে কইতাছি, তুই আমার লগে ব্যদ্দবি করছস, দেখিস মামু কি করে! " আব্বাস ভয় দেখায়। 
ভাই, তোমার আল্লাহর দোহাইআব্বারে বিচার দিও না, তুমি যা চাইবা তাই দিমু " রফিয়া এখন আব্বাস কে মানাতে চেস্টা করে। 
আব্বাস রফিয়ার ফুফাতো ভাই, ওদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে। বোনের ছেলে বলে আবদুল ওহাব খুব আদর করেন। ছেলাটা বাবা মা ছাড়া দুরে আছেতার সব কথাই আব্বার সায়। ভাই বোন এক সাথে স্কুলে যায় আসে। 
অন্নদা স্কুলের সামনে আব্বাস চোখ গরম করে রফিয়ার দিকে তাকায়। আর মনে মনে হাসে।  ছোট বোনের ভয় পাওয়া দেখে মায়া লাগছে
ভাই বোনের খুব মিল। সারাদিন দুই জন একসাথে, পড়াস্কুল যাওয়া খেলা সব। 
ভাই, চাইলতার আচার খাইবা? " রফিয়া  আবার জিজ্ঞেস করে। 
"না, কিচ্ছু খামু না, চল বাসায় যাইমামি চিন্তা করবো"
আব্বাস তাড়া দেয়। 
ভাই, তোমারে আল্লার কিরাআব্বার কাছে বিচার দিও না!" 
দিমু নাযা। কিন্তু আর বেদ্দবি করবি না
ঠিক আছে, আর করমু না" রফিয়া কথা দেয়। 
ভাই বোন বই খাতা নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। 

রফিয়া গায়ের উড়না সামলাতে হিমসিম খায়। তার গায়ের তুলনায় উড়না অনেক বড়। টেনেটুনে কাপড় টা কোমড়ে ভালো ভাবে পেচিয়ে নেয়। কালিবাড়ির মোড় এসে রফিয়া আব্বাসের হাত চেপে ধরে। আব্বাস বোনকে মাথা নেরে সান্তনা দেয়। 
এত ভয় পাছ কেন? "
"তুমি জাননা, অই বটগাছে ভুত আছে! " রফিয়া শক্ত করে আব্বাস ভাইয়ের হাত চেপে ধরে.....




                                               তখন

১০৩/ নামা গোরানপোস্ট অফিস - বাসাবোথানা- খিলগাঁও।  রফিয়ার নতুন ঘর। নতুন ঠিকানা। স্বামী স্ত্রীর   আপন সপ্নের বাড়ি। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থাকার পর নামা গোরানে  কাঠা জমি কিনে নিজ বাড়ি তৈরি করেছেন নুরুল ইসলাম, তখন ১৯৬৬ সাল। দোচালা টিনের ঘর। 
তাও প্রায় দশ বছর হলো। 
আজ সোমবার। ঘন্টা দুয়েক আগে নুরুল ইসলাম অফিস গিয়েছে দেবর রফিক গিয়েছে কলেজ। এরপর সন্ধা পর্যন্ত ছেলেকে  নিয়ে একা। সকালে  স্বামি আর দেবরকে বিদায় দিয়ে সময় কাটানো মুসকিল হয়ে যায়। 
দিনের বেলায় পুরো এলাকা জুড়ে কোন পুরুষ মানুষের মুখ দেখা যায় না! নতুন এলাকা, বসতি কম। ভাগ্য ভালো কিছু দিন আগে মীর সাহেবের পরিবার পাশের জমিতে এসে উঠেছে। মীর ভাবির কাছ থেকে আনা মাসিক পত্রিকা "বেগম " পড়ছে রফিয়া বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। পাশে ছেলে জহির মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছে। হঠাৎ গেইট থেকে আওয়াজ এল - দুধ --
দুধ ওয়ালা এসেছে দুধ নিয়ে। 
পুরো এলাকা সুনসান নীরব। কেউ এসে ডাকলে গেইট খোলা যায় না।  মাঝে মাঝে ডাকাতির খবর পাওয়া যায়। 
দুধ ওয়ালার পরিচিত গলা শুনে ছেলে আগেই দৌড়ে গেইটে চলে গেছে। সারাদিন ছেলেটার খালি দুস্টামি
রফিয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেইট খোলে। 
"ভাবি আসসালামু আলাইকুম।  "
রফিয়া ঘোমটার ভেতর মাথা নেরে নিঃশব্দে সালামের উত্তর  দেয়। দুধের পাতিল এগিয়ে  দেয়। দুধ ওয়ালা দুধ মেপে দিতেই রফিয়া পাতিল নিয়ে তারাতাড়ি ঘরে ঢুকে যায়, তার মন পরে আছে "বেগম" পত্রিকার নায়ক নায়িকা  "আজিম-সুজাতার" ছবির দিকে। সিনেমার জুটি বাস্তবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই খবর খুব মন দিয়ে পড়ছিল। অন্যমনস্কতায় রফিয়া খেয়াল করলো না যে ছেলে দুধ ওয়ালার পেছন পেছনে গেইট থেকে বেরিয়ে গেছে!
কিছুক্ষণ পত্রিকা পড়ার পর ঘরে কোন শব্দ নাই দেখে আসে পাশে তাকিয়ে  দেখলেনজহির গেল কোই
ছেলেটারে নিয়া আর পারিনাসারাদিন দুস্টামি!
পাশের  ঘরে উকি দিলেন,"জহির! কই গেলি? "
এই ঘরে নাই!
উঠানে দৌড়ে গেলেন, নাই!
উঠানের শেষ মাথায় বাথরুমে দেখলেন, ছেলে নেই
হঠাৎ কি মনে হতে এক দৌড়ে গেইটের দিকে গেলেন। 
আয় হায়গেইট খোলা!  
ছেলে নিঃসচই বাইরে চলে গেছে
জহির! চিৎকার করতে করতে  গলিতে বেরুলেন রফিয়া। 
ডানে বায়ে তাকালেন ছেলের খোঁজে।  নেই! দৌড়ে হারুনদের বাসায় গেলেন, নিলি হারুন, তোর আম্মারে ডাক,জহিররে খুইজা পাইতাছিনা
হাহাকার করে চিৎকার করছে রফিয়া। 
শুনে নিলু তার মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে
জহিরের মা, কি হইছে
আপা, জহিররে খুইজা পাইতাছি না
হেঃ কন কি? এই নিলু যা তো, সোহেলের মারে ডাক দে। 
নিলু দৌড়ে পাশের বাড়ির মীর সাহেবের স্ত্রীকে ডাকতে যায়। 
এদিকে রাফিয়ার শরীর ভয়ে কাপছে!
আল্লাহ, আমার ছেলের কি হবে!
***
সারা এলাকার মহিলারা জহিরদের বাসায় একত্রিত হয়েছে, কত বড় সর্বনাস,জহির কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
রফিয়ার অবস্থা প্রায় অচেতন। 
পাড়ার সকল মহিলা আসেপাশে খুঁজে দেখেছেন
এলাকার কোথাও জহির নেই। 
"আপা,আমার ছেলের কি হইব? " 
পলাশের আম্মা ধমকে উঠে - চুপ কর, মাগি! ছেলের দিকে খেয়াল রাখতে পারছ না,অখন কান্দে! "
চঞ্চলের আম্মা ভেজা শরীরে ঘরে ঢুকেন, সাথে আরও তিন জন মহিলা, সবার শাড়ি জামা সমস্ত শরীর ভেজা
মুখ থমথমে। 
পাশের ডোবায় নেমে দেখেছেন, যদি বাচ্চা ছেলেটি পানিতে নেমে থাকে
নাহ,গত আধ ঘন্টা তিন জন মিলে সারা ডোবা তন্নতন্ন করেছেন।  
আল্লাহর রহমত জহির পানিতে পরেনি।
পাড়ার সব মহিলা বাচ্চারা জড়ো হয়েছে। উঠানে বাচ্চারা খেলছে। 


টুটুলের মামা কচি আজ কলেজ যায় নিসাইকেল চালিয়ে গোরান বাজারের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখে, জহির একটা সেলুনের চেয়ারে বসে কাঠি লজেন্স খাচ্ছে
সাইকেল থামিয়েসেলুনে ডুকে কচি মামা," কি রে জহিরতুই এইখানে কি করছ? রফিক কই? "

ছয় বছরের বাচ্চা জহির কচি মামাকে দেখে হেসে হাত বারিয়ে দেয়। "মামা!"
সেলুন ওয়ালা জিজ্ঞেস করল - ভাই, আপ্নে এই বাচ্চারে চিনেন! "
,চিনি, কি হইছে! "
বাচ্চা টা একা একা রাস্তা দিয়া কান্তে কান্তে যাইতাছে দেইখা আমরার দোকানে বসাইয়া রাখছি, কারো বাচ্চা হারাইছে মনে কইরা! "
"ভাই, খুব ভাল কাজ করছ।"
জহির কে কোলে নিতে নিতে বলল- কি রে পাকনা, হারাইলি কেমনে
দুধ ওয়ালা... "
চল, আগে বাসায় যাই, তোর আম্মার না জানি কি অবস্থা! "



                                           তখন

রফিয়ার মনটা আজ বেশ খুশি  খুশি, কারন তার আব্বা আসছে দেশ থেকে। আব্বাকে বরাবরই একটু ভয় পেলেও রফিয়া জানেন আব্বা তার এই মেয়ে অত্যাধিক স্নেহ করেন। আব্বা আসার সময় এটা সেটা কতকি যে এনেছেন। নদীর মাছ ভেজে, হাসের মাংসের তরকারি তার মায়ো সিদোল শুটকিও রেধে পাঠিয়েছে। কোনোকিছু রান্নার দরকার ছিলোনা তবুও আব্বা আসছে এতোদিন পর তার পছন্দের সজনে ডাল রান্না চড়ায়ে রফিয়া মাগরিবের আজানের আগে আগে ঘরের দরজা জানালা লাগাচ্ছে এমন সময় আব্দুল ওয়াহাব সাহেব ঘরে ঢুকলেন, রফিয়া তাড়াতাড়ি এসে বলে আব্বা ওজুর পানি দিমু। তিনি অপেক্ষাকৃত গম্ভীরমেয়ের দিকে চেয়ে বললেন না আমি মসজিদে নামাজ পরে আসতেছি। রফিয়ার মনে সংশয় আব্বা হটাৎ এতো গম্ভীর!! আসরের পরপর তার স্বামী কে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাদের একটা জায়গা দেখতে যেটা কিছুদিন আগেই তার স্বামী নূরুল ইসলাম বায়না করছে। দুজন যখন বেড়হয় তখন রফিয়ার বেশ আনন্দই লাগছিলো এক স্থায়িত্বের প্রশান্তি তার চেহারায়, নিজের একটা বসতি একান্তই নিজের। কত শত স্বপ্ন এসে ভিড় করে তার চোখে।  
কিন্তু ফিরে এসে আব্বা ভাব গতিক সুবিধার ঠেকতেছেনা।  কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে ডাল বাগার দিয়ে চায়ের পানি বসায়, তার স্বামীও আব্বার সাথে ফিরে নাই এটাও আশ্চর্য লাগতেছে।  আবার কোনো ঝামেলা হয় নাইতো? মনের মধ্যে এক উৎকন্ঠা, দুইজনের কাউরেই কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না।  দুইজনই বেশ রাগী মানুষ।  রফিয়া উৎকন্ঠিত মনে অপেক্ষা তারা কিছু বলে কিনা। 
নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মেয়েকে চা দিতে বললেন ওয়াহাব সাহেবমেয়ের হাতের চা টা তিনি বেশ উপভোগই করেন, রফিয়া সুন্দর করে চায়ের সাথে তার আনা বিস্কুট থেকে দুইটি টোস্ট  পিরিচের কোনায় দেয় সাথে এক গ্লাস পানি। তিনি হাত বাড়িয়ে আগে পানিটা নেন এক ডোকে শেষ করেন বিস্কুট টা হাতে নিয়ে বলেন এগুলা তুমগো লাইগ্যা আনছি আবার আমারে দিলা কেন? হাইন আফনে আমরারতো আছোই। আগের ফিল্লা যেইডি আনছেন হেইডিত্তো শেষ হইছেনা। জামাই আমারে যাত্রাবাড়ী নামায়া দিয়া কইলো আফনে বাসাত যান আমি ইট্টু মফিজের এহানতে হইয়া আসি। রফিয়া কইলো হো এই একজনইতো, গেলে হের ঐহানেই যায়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের মুখের দিকে চায় কিছু বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ প্রশ্ন করে  জামাইয়ের সবকিছু ঠিকঠাক চলতাছেতো?? রফিয়া অবাকহো আব্বা সবইতো ঠিকঠাক কোনো কিছু হইলেতো কইতো, লোকটা হুটহাট চেইত্যা যায় কিন্তু কিছু হইলে আগে আমারেই কয়। ওয়াহাব সাহেব মেয়ের কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হলোনা। তিনি গায়ের পান্জাবিটা ছেড়ে বিছানায় শরীরটা ইকটু এলিয়ে দিলেন। কখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল করেননি। মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আব্বা আফনের কি শরীরটা খারাপ? ওয়াহাব সাহেব নিজেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন অসময়ে ঘুমিয়ে পরায়। হেসে বললেন নারে বেডি কহন যে চোখডা লাইগ্যা গেলো টের ফাইছিনা। 
উউট্টা এশার নামাজটা পড়েন আমি ভাত বাড়তাছি। জামাই আইছে?? আইয়া পরবো আফনে নামাজ শেষে হাইয়া লোন। রফিয়ার মনে আরো সংশয় নিশ্চয়ই কিছু হইছে নইলে এতোক্ষনেতো লোকটা চইলা আসার কথা। খাবার সময়ই জিগাইতে হইবো আব্বারে কিছু হইছে নি। ওয়াহাব সাহেব নামাজ শেষে দেখেন মেয়ে শীতল পাটিতে খাবার বিছায়া রাখছে অনেক আয়োজন সাথে তার পছন্দের সজনে ডালও আছে। আলহামদুলিল্লাহ এতকিছু? সব তুই করছোস?? মেয়ে হাসে ইকটু সাহস পায় আব্বা স্বাভাবিক হইতাছে।  মেয়ে বাবার পাতে খাবার তুলে দেয় ওয়াহাব সাহেব খেতে খেতে রান্নার প্রসংশা করে রান্না ভাল হইছে, তোর মায়োর মত, রফিয়া মনে মনে হাসে, আব্বা নিজেও জানেনা তার মেয়ের জন্য মায়ো কি কি দিয়া দিছে। এগুলো তার মায়েরই রান্না সে শুধু ডাল পাকাইছে। 
ওয়াহাব সাহেব হঠাৎ জিজ্ঞেস করে জামাই কখন আইবো তোরা খাবিনা? হেয় আইলেই খামু আপনি খানতো, ওয়াহাব সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন, সুযোগ বুঝে রফিয়া প্রশ্ন করে আব্বা জায়গা যে দেখতে গেলেন, কেমুন দেখলেনকিছুই দি কইলেন না
ওয়াহাব সাহেব ইকটু থামলেন আবার ভাত মাখতে মাখতে বললেন জায়গায় তো যাইতারছিনা ঐহানে এহনো রাস্তা হইছেনা। এই ডেমরার এদিকেত্তে ত্রিমহনি একটা জায়গা ঐহানতে নুরুল ইসলাম আমারে আঙুল দা দেহাইলো উইযে দূরে আমগো জায়গাডা আব্বা। আমি ইকটু অবাক হইছি, টেহাদা কেউ বিল কিনেরে। পয়সাডি ফানিত ফালাইয়া আইসে। আমিতো হেরে ভালই জানতাম ফাগল টাগল হইয়া গেলোনি। রফিয়া এতক্ষণে বুঝলো আব্বা কেন এত গম্ভীর ছিলেন। বাবা-মেয়ে কেউ তখনও জানেনা তাদের সেই বিলের আশপাশটা জুড়ে একদিন মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং থেকে শুরু মার্কেট সিনেমা হল সবই গড়ে উঠবে। সেই সাথে নিজেদের একটা চারতলা বাড়ী।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন