সুন্দরবন
ভ্রমন
ছেলেরা যেটাকে লঞ্চ বলছে তা আসলে আরেফিন
সাহেবের সখের একটা বিলাশতরী, কাঠের তৈরী খুবই মজবুত নৌযান। সারাবছর ছোট খালা ও খালুর
বাড়ীর পাশের নদীর ঘাটে বাঁধা থাকে। রহমান ভাই ও নিজাম ভাই দেখা শুনা করে। বছরে একবার
দুবার আরেফিন সাহেব এলে ব্যবহার করা হয় অথবা উনার কোনও বন্ধু নইলে খালা খালুরা পারিবারিক
নৌভ্রমনে ব্যবহার করেন। দোতালা এই বোটটির নীচ তলায় চারটি রুম আছে যার ভেতরের সাজসজ্জা
খুবই আধুনিক ও আরামদায়ক। উপর তলায় প্রায় তিরিশ জনের বসার ব্যবস্থা। আরোও আছে রান্নার
ঘর ও ডাইনিং।
পরদিন
সবাই যখন আবার মাঠে বসেছে আলোচনা করতে, দেখা গেলো রাসেল, নিপু ও টুটুলের ভয়টাই সত্যি।
ওরা যেতে পারবে না সুন্দর বন। রাসেল ও নিপুন বাবা মার সাথে দাদার বাড়ী বেড়াতে যাবে।
টুটুলের মা টুটুলকে একা এত দুর যেতে দেবে না। অন্যদের বাবা মার কোনও আপত্তি নেই। সবাই
ধরে নিয়েছে বিদ্যুতের আব্বু আম্মু যাবে ওদের সাথে।
এখানেই দেখা দিল সমস্যা !
গত রাতে বিদ্যুত যখন বলল ওরা বোট নিয়ে
আব্বু আম্মুর সাথে সুন্দরবন যেতে চায় তখন আরেফিন সাহেব নিরবে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
বিদ্যুতের আম্মু ওকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘‘বিদ্যুত, তোমরা কবে যেতে চাও?’’
‘‘এ মাসের মধ্যেই, সামনের মাসে নতুন ক্লাস
শুরু হয়ে যাবে।’’
‘‘হুম,’’ বিদ্যুতের আম্মু খুব চিন্তিত।
তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন ‘‘একটা সমস্যা হয়েছে কি বিদ্যুত, এ মাসে আমাদের দুজনেরই
ঢাকায় কিছু জরুরী অফিসিয়াল কাজ আছে যা না করলেই নয়। ’’
বিদ্যুত মন খারাপ করে বলল ‘‘তাহলে? আমার
বন্ধুদের সামনে সেদিন তো খুব বলছিলে যা চাইবো তাই দেবে, এখন? আমাদের সুন্দরবন যাওয়া
হবে না?’’
বিদ্যুতের চোখে পানি এসে গেলো অভিমানে।
ওর অবস্থা দেখে দাদিমা বললেন ‘‘তোদের জরুরী
কাজ নিয়ে তোরা থাক। রহমান আর নিজামকে দিয়ে ওদের সুন্দরবন বেড়ানোর ব্যবস্থা কর।’’
‘‘তা হয় না, মা’’
আরেফিন সাহেব বলল ‘‘এতগুলো ছেলে একা একা...... ’’
ওকে থামিয়ে দিয়ে দাদিমা বললেন ‘‘কিচ্ছু
হবে না, তুই ব্যবস্থা কর।’’
আরেফিন
সাহেব আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সানজীদার চোখে বিদ্রুপের
ঝিলিক। এখন বোঝো ঠেলা! খুব
তো পুরস্কার ঘোষণা করেছিলে! আরেফিন সাহেব আবার বললেন- ‘‘মা, সুন্দর বন সবাই যেতে পারে
না, যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হয়। সিকিউরিটির ব্যাপার আছে দাদিমা আবার ওকে থামিয়ে বললেন
‘‘তুই কামালকে ফোন করে কথা বল। এসব কোন সমস্যাই হবে না। যেভাবেই হোক ছেলেদের যাওয়ার
ব্যবস্থা কর। ’’
বলে দাদিমা উঠে বিদ্যুতকে নিয়ে চলে গেলেন।
বিদ্যুতের আম্মু নিরবে আরেফিন সাহেবের
জব্দ হওয়া উপভোগ করছেন।
বিদ্যুতের
আব্বু আম্মু যেতে পারবেন না শুনে ছেলেরা সবাই খুব হতাশ হয়ে গেলো। সেদিন আর কোনও খেলাই
জমল না। একটু পর ওরা মন খারাপ করে যার যার বাড়ী চলে গেলো।
রাতে খেতে বসে ইসমাইল সাহেব দেখলেন আজও
ভন্ডুলের মন খারাপ।
‘‘কি ব্যাপার ভন্ডূল, আজও মার জন্য মন
খারাপ?’’
‘‘না, আব্বু, কাল আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম
সুন্দরবন বেড়াতে যাবো বিদ্যুতের আব্বু আম্মুর সাথে ওদের বোট নিয়ে। কিন্তু ওর আব্বু
আম্মু যেতে পারবে না। তারমানে আমাদেরও যাওয়া বন্ধ’’ ভন্ডুলের কণ্ঠে শুধুই হতাশা!
ইসমাইল সাহেব বললেন ‘‘হতাশ হওয়ার কিছু
নেই,ভন্ডূল। সবাই মিলে চাইলে একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।’’
ব্যবস্থা সত্যিই হয়ে গেলো। পরদিন বিদ্যুত
খেলার মাঠে এসে বলল-“ বড় মামা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমরা সুন্দরবন যাওয়ার অনুমতি
পেয়ে গেছি ! ’’
ভন্ডূলরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল-‘‘
থি টিয়ার্স ফর বড় মামা। হিপ হিপ হুররে! হিপ হিপ হুররে। ’’
এরপর শুরু হল সুন্দরবন যাওয়ার প্রস্তুতি।
বিদ্যুত, ভন্ডূল ও সাজু তিনজনই খুব গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ।
ওরা গল্পের বইতে যেমন পড়েছে, সবাইকে সে রকম প্রস্তুতি নিতে বলল। সুন্দরবন যাওয়া আসা
ও খাওয়া দাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করছেন বিদ্যুতের আব্বু। কিন্তু ছেলেদের ইচ্ছে সুন্দরবন
পৌছে জঙ্গলের ভেতর ক্যাম্পিং করার এবং সেখানেই রাতে থাকার। সেজন্য যা যা প্রস্তুতি
দরকার তার লিষ্ট তৈরী করা হল।
দলে ওরা সাতজন। ভন্ডূল, বিদ্যুত, সাজু,
বাবলু, তিতু, শুভ্র ও মিন্টু। সাথে রহমান ভাই ও নিজাম ভাই। সাজু ও ভন্ডূল গিয়ে স্কুলের
স্কাউট টিচার এর কাছ থেকে তাবু নিয়ে এল। স্কাউট টিচার ওদের বার বার করে শিখিয়ে দিলেন
কিভাবে তাবু খাটাতে হয়।
সবাই যার যার সাথে নেয়ার জন্য লিষ্টে আছে
টর্চলাইট, সুইসনাইফ, দড়ি, বেডিং, বালিশ ও বিছানার চাদর। এগুলো প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা
নিতে হবে। মোট চার অথবা পাচ দিনের পরিকল্পনা। সেজন্য পোষাক আষাক তো নিতে হবেই।
ইসমাইল সাহেব ভন্ডূলদের সুন্দরবন ভ্রমণের
ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিলেন।
তিনি যাবার আগে সবাইকে একদিন্ সন্ধ্যায়
বাসায় দাওয়াত করলেন।
সবাই টিভি রুমে গোল হয়ে বসার পর তিনি বললেন
‘‘আমি তোমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনায় খুবই অবাক হয়েছি। এত ছোট বয়সে তোমরা এরকম
একটা আশ্চর্য সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস করেছো, তা দেখে অবাক হচ্ছি এবং তোমাদের সুন্দর বন
ভ্রমণের সাফল্য কামনা করছি।’’
ছেলেরা সবাই হাত তালি দিয়ে উঠল। ফুটবল
টুর্নামেন্টের পর থেকে ভন্ডুলের সব বন্ধুরাই ওর আব্বুকে খুব পছন্দ করে। সবাই ইসমাইল
সাহেবের সামনে খুব সহজ বোধ করেন। ভন্ডুলের আব্বু অন্যদের মত এত গম্ভির নয়, সবার সাথে
বন্ধুর মত মেলামেশা করেন।
ইসমাইল সাহেব হাত তুলে ওদের থামালেন -
“এখনি হাত তালি নয়, আমার আরও কথা আছে। তোমরা সবাই মন দিয়ে শুনবে এবং অবশ্যই মেনে চলবে।’’
ছেলেরা সবাই চুপচাপ হয়ে গেলো। তিনি ওদের
দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
‘‘তোমরা খুব ছোট বয়সে একটা বড় এডভেঞ্চারের
সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমার একটা কথা সবাইকে মেনে চলতে হবে - অবশ্যই, আমি আবার বলছি অবশ্যই
সবাই মিলে মিশে চলতে হবে। কয়েকজন মানুষ একসাথে কিছু সময় থাকলে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু
যখন লাগাতার কয়েকদিন রাত একসাথে থাকে তখন অনেক রকম সমস্যা তৈরী হয়। ঝগড়া, দলাদলি এমনকি
মারামারিও হতে পারে। এসব সমস্যা যাতে না হয় তার জন্য দলের মধ্যে একজন দলনেতা থাকতে
হয়। এবং সবাই তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হয়। আমি বলব, তোমরা রওনা হওয়ার আগে নিজেদের
মধ্যে ভোটাভুটি করে একজন নেতা ঠিক করে নেবে।’’
‘‘নেতা কিভাবে ঠিক করব আংকেল’’
সাজু জানতে চাইলো।
‘‘যে সবচে বুদ্ধিমান, চৌকষ, তড়িৎ সিদ্ধান্ত
নিতে পারে তাকে নেতা নির্বাচন করবে তোমরা।’’
বিদ্যুত
বলল ‘‘চাচ্চু, আপনি আমাদের নেতা ঠিক করে দিন
না, প্লিজ।’’
ইসমাইল সাহেব হেসে উঠলেন। বললেন ‘‘তা হয়
না। তোমাদের নেতা তোমরাই ঠিক করবে। তবে আমি একটা বুদ্ধি দিতে পারি কিভাবে তা করবে।’’
উনার
কথা শুনে সবাই খুশী হয়ে উঠল।
‘‘তাই
করুন চাচ্চু’’ বিদ্যুত বলল।
ইসমাইল সাহেব বললেন ‘‘আজ রাতে তোমরা সবাই
মনে মনে ভেবে একজন নেতা ঠিক করবে এবং তার নাম কাল একটা কাগজে লিখে আনবে। সবার কাগজ
খুলে যার নাম সবচে বেশী বার পাওয়া যাবে তাকেই নেতা বানাবে। ঠিক আছে?’’
ভন্ডূলরা সবাই একত্রে উপর নিচে মাথা নাড়লো।
‘‘ঠিক আছে, এবার তাহলে যার যার বাসায় গিয়ে
ভাবো, এবং কাল লিখে নিয়ে আসো। এ ব্যাপারে তোমরা নিজেরাই ঠিক করবে। আমাকে জানানোর প্রয়োজন
নেই। তোমাদের সবার প্রতি আবারও শুভ কামনা রইল।’’
পরদিন সবাই যার যার পছন্দের নেতার নাম
লিখে নিয়ে আসলো। মাঠে সবাই গোল হয়ে বসে একটা একটা করে কাগজ সাজুর কাছে দিল। সাজু সবার
পছন্দের নামগুলো দেখে হেসে উঠল।
ভন্ডূল ছাড়া সবাই লিখেছে- ‘‘ভন্ডূল’’।
আর ভন্ডূল তার পছন্দের নামে লিখেছে-‘‘সাজু’’। একটু পর সাজু হাসি মুখে বলল ‘‘আমি এখন
সবার পছন্দের নাম ঘোষণা করছি’’, একটুক্ষণ চুপ থেকে ও বলল ‘‘এক ভোট পেয়েছে সাজু, আর
বাকী ছয়টা ভোটই পেয়েছে ভন্ডূল! সবার পছন্দের নাম, ভন্ডূল!!’’
সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল।
‘‘ভন্ডূল
তুমি এগিয়ে চল। আমরা আছি তোমার সাথে।’’
ভন্ডূল
সবার দিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসছে। একটু পর মিন্টু ভন্ডুলের সামনে এসে মাথা ঝুকিয়ে
বলল ‘‘বলুন, সর্দার কি হুকুম আছে।’’
মিন্টুর ভঙ্গি দেখে আবার সবাই হাসিতে ফেটে
পড়ল।
ভন্ডূল হাত তুলে সবাইকে হাসিঠাট্টা থামাতে
ইশারা করল।
সবার দিকে তাকিয়ে ও বলল ‘‘ আমরা যা যা
লিষ্ট করেছিলাম তা কি সবার যোগার হয়েছে?’’
এরপরের
দুদিন গেলো ওদের প্রস্তুতি পর্বে।
সুন্দরবন
রওনা হওয়ার আগের দিন রাতে সবাই মিলিত হল বিদ্যুতের বাসায়। দাদিমা ওদের সবাইকে রাতে
খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেছে। ভুনা খিচুরী হাসের মাংস রান্না হয়েছে। শীতের সময় হাসের মাংসের
চেয়ে উপাদেয় কিছু নেই।
আরেফিন
সাহেব ওদের সাথে নিজাম ও রহমানকে ডেকেছেন খাওয়ার জন্য। সবার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-
‘‘তোমরা, ইনশাল্লাহ্ কাল বিকালে রওনা হচ্ছ। পরদিন বেলা এগারটার দিকে তোমরা গিয়ে পৌছবে
খুলনা লঞ্চ ঘাটে। সেখানে বিদ্যুতের বড় মামা থাকবে। তিনি তোমাদের সুন্দর বনে যাওয়ার
পারমিশন ও অন্যান্য ব্যবস্থা করবেন। রহমানের কাছে মোবাইল আছে। যে কোনও প্রয়োজনে আমাকে
অথবা বিদ্যুতের বড় মামাকে ফোন করবে। তোমরা সুন্দর বনে থাকবে তিন রাত। সম্ভবত কামাল
ভাই তোমাদের বলতে পারবেন সেখানে তোমরা কোথায় যেতে পারবে কোথায় যেতে পারবে না। প্লিজ,
সবাই উনার কথা মন দিয়ে শুনবে এবং অবশ্যই সবাই মিলেমিশে থাকবে। ঠিক আছে?’’
বিদ্যুত বলল ‘‘ঠিক আছে আব্বু।’’
‘‘আর একটা ব্যাপার’’
আরেফিন সাহেব আবার বললেন, ‘‘তোমরা বোটের ভেতরে রাত কাটানোই নিরাপদ হবে। কারন, সুন্দরবন
পৃথিবীর ভয়ংকর জঙ্গলের মধ্যে একটা। বোটে থাকলে রহমান ও নিজাম তোমাদের দেখাশুনা করতে
পারবে।’’
‘‘কিন্তু আব্বু, আমরা তো জঙ্গলের ভেতরে
ক্যাম্পিং করে থাকতে চাইছি অন্তত এক রাত অথবা দুই রাত’’
বিদ্যুত মন খারাপ করে বলল।
‘‘উহু,
সেটা মোটেই নিরাপদ হবে না’’ বললেন আরেফিন সাহেব।
ভন্ডূলদের
সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেদের মন খরাপ দেখে বিদ্যুতের আম্মু বলল ‘‘আগেই মন খারাপ
করার দরকার নেই। আমি ভাইয়ার সাথে (ডিসি কামাল) কথা বলে দেখি, তিনি হয়ত সুন্দরবনের নিরাপদ
কোনও জায়গায় তোমাদের ক্যাম্পিং করার ব্যবস্থা করতে পারেন।’’
ছেলেরা সবাই ‘‘হুররে’
বলে চিৎকার করে উঠল।
উত্তেজনা থামার পর মিন্টু বলল- আংকেল,
আন্টি কথা শেষ হইছে? তাইলে চলেন খাওয়া দাওয়া শুরু করি। খিদা লাগছে।’’
খাওয়া
ফেলে রেখে আলোচনা মিন্টুর মোটেই পছন্দ হচ্ছেনা। ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। দাদিমা
বললেন, ‘‘হ্যা, হ্যা চল, অনেক আলোচনা হয়েছে, ডাইনিং রুমে খাবার রেডী, সবাই খাবে চল।’’
যদিও
মিন্টু ক্ষিদার কথা আগে বলেছে, কিন্তু শীতের রাতে ভুনা খিচুরী ও হাসের কষা মাংস কেউ
কম খেলো না।
সে
রাতের রান্নার স্বাদ ওদের অনেক
দিন মনে থাকবে।
পরদিন
বিকালে সবাই যার যার বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে ভন্ডূলদের বাসায় একত্র হল। ইসমাইল
সাহেব ওদের জন্য গাড়ী ভাড়া করেছেন লঞ্চ ঘাটে যেতে। সবার হাতে একটা করে কাধ ব্যাগ ও
একটা বেডিং। সবাই খুব উত্তেজিত! এই প্রথম ওরা আব্বু আম্মু ছাড়া দুর কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে
এবং রাতেও থাকবে। আল্লাহই জানে কি হয়!
ইসমাইল সাহেব ওদের নিয়ে বিদ্যুতের খালার
বাড়ী রওনা হলেন। আধ ঘন্টা পর ওরা খালার বাসায় পৌছল। সেখানে গেটে বিদ্যুত ওর আব্বু,
আম্মু খালু ইমরান সাহেবকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আরেফিন সাহেব ভন্ডুলের আব্বাকে দেখে
এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।
‘‘আসসালামু আলাইকুম, আরেফিন সাহেব।’’
‘‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাইজান, আপনি এসেছেন,
আমি খুবই খুশী হয়েছি।’’
ইসমাইল
সাহেব বললেন ‘‘ভাই, আমি তারচেয়ে বহুগুণ বেশী খুশী হয়েছি, এজন্য যে, আপনী ছেলেদের মনে
রাখার মত একটা নৌ ভ্রমণ ও জঙ্গলে বেড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। আমি সত্যিই আনন্দিত যে,
ছেলেরা সুন্দরবন বেড়াতে যাচ্ছে।’’
আরেফিন সাহেব লাজুক হেসে বললেন ‘‘আরে এটা
আর এমন কি, দোয়া করবেন, ছেলেরা সবাই যাতে নিরাপদে ফিরে আসে, আমার তো এখন টেনশনই হচ্ছে।’’
বিদ্যুতের খালু ইসমাইল সাহেবের সাথে করমর্দন
করে বললেন ‘‘চিন্তা করবেন না, ভাই সাহেব, আমাদের এই ছেলো সবাই খুব স্মার্ট। ওদের কিচ্ছু
হবে না।’’
তিনি ওদের সাবইকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন।
সেখানে নাস্তার বিশাল আয়োজন।
ভন্ডূলরা
সবাই উসখুশ করছিল। মিন্টু ছাড়া আর কারও এখন চা নাস্তা করার দিকে মন নেই। খালি মনে হচ্ছে
কখন রওনা হব।
বিদ্যুত বলল ‘‘আব্বু আমরা কখন রওনা হব?’’
আরেফিন সাহেব হাসি মুখে বলল “একটু পরই
রওনা হবে, বাবা। রহমান আর নিজাম তোমাদের ব্যাগ ও বেডিং বোটে তুলছে। এখন আরামে চা নাস্তা
কর।’’
মিন্টু বলল ‘‘গুড আইডিয়া!’’ ও একটার পর
একটা বিস্কুট, মিষ্টি ও ফলমূল খেয়ে যাচ্ছে। আর বিদ্যুতের খালা ওকে বেশী বেশী করে খাওয়াচ্ছে।
বিদ্যুত ও ভন্ডুলের চোখে চোখে কিছু ইশারা
হল। বিদ্যুত বলল ‘‘আব্বু, আমরা গিয়ে রহমান ভাইকে মালপত্র তুলতে সাহায্য করি?’’
আরেফিন সাহেব বুঝতে পারলেন ছেলেদের অস্থিরতা।
‘‘ঠিক আছে যাও।’’
ওর
কথা শুনে মিন্টুর মুখ বেজার হয়ে গেলো।
বিদ্যুত
মিন্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘তোর যেতে হবে না, তুই আরামে বসে চা নাস্তা করে তার পর আয়।’’
সবাই
দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ীর পেছন দিকে উঠান পেরিয়ে নদীর ঘাটে। সেখানে বার্নিস করা মেহগনি
রংয়ের একটা বোট বিকেলের আলোয় ঝকঝক করছে। নদীর ঘাটে তখন রহমান ভাই গাড়ী থেকে ওদের ব্যাগ
ও রেডিং পত্র বোটে তুলছে।
ছেলেরা সবাই যার যার ব্যাগ কাধে নিয়ে নিল।
এক হাতে বেডিং নিয়ে রহমান ভাইয়ের পিছন পিছন বোটে উঠল।
নদীর ঘাটটায় কাঠের তৈরী একটা চওড়া সেতু
অনেক দুর পর্যন্ত গিয়েছে। সেতুর শেষ মাথায় দশ বারোজন দাড়ানোর মত একটা প্লাটফর্ম আছে।
তার সামনে বোটটা বাঁধা।
ভন্ডূলরা দৌড়ে গিয়ে বোটে উঠল। নিজাম ও
রহমান ভাই ওদের হাত থেকে মালপত্র নিয়ে নিল।
সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে বোটের দোতালায় গিয়ে
উঠল। রেলিংয়ের পাশে সবাই ঝুঁকে দাড়াল।
উত্তাল
বাতাস, সামনে বহতা নদীর উপর দিয়ে একটা মালবাহী নৌকা যাচ্ছে। একটু দুরে কচুরীপানার একটা
দ্বীপ। সেখানে দাড়িয়ে আছে একটা সাদা বক্। নদীর ওপার প্রায় আধ মাইল দূরে।
ভন্ডূলরা
সবাই চারপাশে মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে। তখন বিকাল পাঁচটা বাজে। একটু পর মিন্টু হেলতে দুলতে
আরামে হেটে এসে বোটে উঠল।
‘‘তোদের
জন্য ঠিক মত নাস্তাও করতে পারলাম না, সব কিছুতেই তারাহুরা’’
বলল মিন্টু।
ওর
হাতে দুইটা বিস্কুটের প্যাকেট।
বিদ্যুত
বলল ‘‘কেন, আমরা তো তোরে নাস্তা করার জন্য রাইখাই আসলাম।’’
বিস্কুটের
প্যাকেট খুলে সবাইকে দিতে দিতে মিন্টু বলল‘‘ তবু একা একা কি বড়দের সামনে খাওয়া যায়।
আমি মাত্র দশটা মিষ্টি আর চাইরটা বিস্কুট আর তিনটা আপেল খাইছি।’’
ওর
কথা শুনে সবাই এক সাথে হেসে উঠল। মিন্টু অবাক হয়ে সবার দিকে তাকালো। এত অল্প খাওয়ার
মধ্যে হাসির কি আছে?
বিদ্যুত' রেলিং থেকে ঝুকে ডেকে বলল ‘‘রহমান
ভাই, আমরা কখন রওনা হব?’’
নীচ
থেকে রহমান ভাই জবাব দিলেন, ‘‘তোমার আব্বা বললেই রওনা হইতে পারি।’’
বিদ্যুত অস্থির হয়ে উঠল, ‘‘ইস্ আব্বু এত
দেরী করছে কেন?’’
সাজু বলল ‘‘ঐ দেখ আংকেল আসতাছে।’’
ছেলেরা সবাই দেখলো আরেফিন সাহেব খালু ও
বিদ্যুতের আম্মু ও ইসমাইল সাহেব কাঠের সেতুর উপর দিয়ে হেটে আসছেন।
বোটে উঠে আরেফিন সাহেব বললেন ‘‘কি ছেলেরা,
সবাই নিশ্চয়ই খুব এক্সাইটেড। কি বলেছি সব মনে আছে তো?’’
সবাই
এক সাথে মাথা নাড়লো ‘‘হ্যা আংকেল।’’
‘‘ঠিক আছে তোমাদের আর দেরী করাবো না। রহমান,
নিজাম ছেলেদের দিকে লক্ষ্য রাখবে। দেখবে পানির মধ্যে যেন কোনও বিপদ আপদ না হয়। আর তোমরা
সবাই রহমান ও নিজামের কথা শুনবে, মনে থাকবে তো?’’
‘‘হ্যা
আংকেল’’ সবার জবাব।
বিদ্যুতের আম্মু ওদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে
আদর করলেন, বিদ্যুতকে জড়িয়ে ধরে বললেন ‘‘সাবধানে থেকো বাবা’’
বিদ্যুত মাথা নাড়লো। এখন ওর একটু মন খারাপ লাগছে আব্বু আম্মুকে ছাড়া যেতে।
ইসমাইল সাহেব ভন্ডূলকে এক পাশে ডেকে নিয়ে
গিয়ে বললেন, ‘‘বাবা ভন্ডূল, তুমি একটা বড় দায়ীত্ব নিয়ে যাচ্ছ। তুমি হচ্ছ দলের নেতা।
সবার দিকে খেয়াল রাখবে। কারও সাথে ঝগড়া করবে না, সবাই এক সাথে থাকার চেষ্টা করবে। কাউকে
একা কোথাও যেতে দিবে না।’’
‘‘ঠিক আছে, আব্বা’’
বলল ভন্ডূল।
আরেফিন সাহেব বিদ্যুতের আম্মুকে নিয়ে নেমে
গেলেন বোট থেকে। পেছন পেছন খালু ও ইসমাইল সাহেবও নামলেন।
প্লাটফর্মে দাড়িয়ে ওরা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে
রইল হাসি মুখে।
রহমান
ইঞ্জিন ষ্টার্ট দিল। ধীরে ধীরে বোটটা ঘাট থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ভন্ডূলরা সবাই
দৌড়ে রেলিং এর এপাড়ে এসে দাড়ালো যাতে আংকেলদের দেখা যায়।
প্লাটফর্ম
থেকে ওরা তখন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।
ছেলেরাও
সবাই হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
ভন্ডূলরা রেলিং ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল,
যতক্ষণ আংকেলদের দেখা যায়। শেষ বিকেলের আলোয় সানজীদা আন্টির শাড়ীর আচল হাওয়ায় পতাকার
মত উড়ছে।
********
আংকেলরা দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর
কিছুক্ষণ ভন্ডূলরা সবাই আনমনা হয়ে রইল। সবাই রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে নদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্য
উপভোগ করছিল।
হঠাৎ সাজু সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা
আবৃত্তি করতে শুরু করল-
“চুপচুপ দেয় ডুব, দেয় পানকৌড়ি...”
সাজু প্রতিবার স্কুলের সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে
কবিতা আবৃত্তি করে। ওর আবৃত্তি শুনে সবার মনটা সতেজ হয়ে উঠল। বিদ্যুত গান ধরল-
‘‘মাঝি বাইয়া যাও রে........’’
কবিতা আর গানে ছেলেদের মনমরা ভাব উধাও
হয়ে গেলো।
একটু পর সবাই মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত দেখলো।
টকটকে কমলা বড় ডিমের কুসুমের মত সূর্যটা দিগন্তে মিলিয়ে গেলো।
ওদের পেছনে নিজাম ভাই এসে বলল ‘‘বিদ্যুত
ভাই, আপনেরা চা খাইবেন?’’
‘‘ওহ্,
থ্যাংক ইউ নিজাম ভাই, এখন এক কাপ চা হলে যা জমবে না!’’ বিদ্যুত উৎফুল্ল হয়ে বলল।
একটু
পর সবাইকে একটা ফ্লাক্স থেকে কাগজের কাপে চা পরিবেশন করা হল।
চা
খেতে খেতে ভন্ডূল বলল, ‘‘সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছি।’’ ইঞ্জিনের আওয়াজের জন্য ওকে চিৎকার করে
কথা বলতে হচ্ছে।
সাজু বলল ‘‘চল্ সবাই ডাইনিং হলে গিয়ে বসি,
বাইরে ইঞ্জিনের আওয়াজ, কথা বলতে অসুবিধা
হচ্ছে।’’
সবাই
উপর তলার ডাইনিং রুমে গিয়ে বসল। দরজা বন্ধ করার পর ইঞ্জিনের আওয়াজ অনেক কম হয়ে গেলো।
সবার দিকে তাকিয়ে ভন্ডূল বলল, ‘‘আমি মোটামুটি একটা সিডিওল তৈরী করেছি আমাদের এই সুন্দরবন
ভ্রমণের। যাতে আমরা বোর ফিল না
করি। অবশ্য সিডিওল ফাইনাল করব কালকে বিদ্যুতের বড় মামার সাথে দেখা হওয়ার পর। ’’
ও
পকেট থেকে একটা ছোট নোট বুক বের করল। ‘‘তো প্রোগ্রামে আজ
রাতের জন্য আছে ডিনারের পর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেজন্য আমি কিছু কাগজে বিভিন্ন
কর্মসূচী লিখে রেখেছি। সবাই লটারির মাধ্যমে কাগজ নেবে। যার ভাগ্যে যা পরবে তা অবশ্যই
করতে হবে। নইলে জরিমানা দিতে হবে।’’
রাতে
খাওয়া দাওয়ার পর ওরা কিছুক্ষণ ডেকে হাটাহাটি করল। শীতের রাত, কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ে
যেন কাটা লাগছে, তবু একা একা বেড়ানোর উত্তেজনায় ছেলেদের তাও ভালো লাগছে। ভন্ডূল যদিও
বার বার তাগাদা দিচ্ছিল ভেতরে গিয়ে ডাইনিং এ অথবা বসার ঘরে রাতের অনুষ্ঠানটা শুরু করতে।
কিন্তু, জোস্নার আলোয় নদীর ঢেউয়ের রূপালী ঝিলিক
যেন ওদের সম্মোহিত করে রাখলো।
আসছে..... সুন্দরবনে প্রথম দিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন