ভন্ডূল
মোঃ
জহিরুল
ইসলাম।
ভন্ডুলের এই ডাক নামটা
রেখে ছিল ওর ছোট
মামা।
খুব ছোট থাকতেই
ভন্ডুলের মা মারা যায়।
বাবা ইসমাইল সাহেব তাই ওকে খুব
একটা কড়া শাসন করতে
পারতেন না। ভন্ডুলের আসল
নাম মইনুল হোসেন। ডাকা নাম রাখা
হয়েছিল টুটুল। কিš‘ খুব ছোট
থেকেই ও এত দুষ্টু
ছিল যে ওর ছোট
মামা নাম দিয়েছেন ভন্ডুল।
সারা বাড়ীময় দুষ্টুমি করে সব কিছু
ভন্ডুল করাই ওর কাজ।
আস্তে আস্তে সবাই ওকে ভন্ডুল
নামেই ডাকতে লাগলো।
ক্লাস টুতে যখন ভন্ডুলের
মা জন্ডিস জনিত রোগে হঠাৎ
মারা যায়, তখন কিছু
দিন ইসলামইল সাহেব ওকে নিয়ে নানার
বাড়ীতে যেতে বাধ্য হন।
স্ত্রীর মৃত্যুতে ইসমাইল সাহেব এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে বছর দুয়েক
তিনি নিজস্ব ব্যবসা, ভন্ডুল, কারো দিকেই কোনও
মনোযোগ দিতে পারেননি। তারপর
হঠাৎ তিনি ভন্ডুলের ক্লাস
ফোরের রেজাল্ট শিট হাতে পেয়ে
হতভম্ব হয়ে যান, তিন
সাবজেক্টে ফেল!
নানার বাড়ীর সবার আদরে আদরে
মানুষ হ”েছ ভন্ডুল।
নানারা জমিদার বংস । লেখাপড়ার
প্রতি উদাসিন।
তাই,একরাতের মধ্যে
ইসমাইল সাহেব সিদ্ধান্ত নেন এবং পরদিন
শশুরসাহেবকে বলেন যে, তিনি
সমস্ত ব্যবসা ও সম্পত্তি বিক্রি
করে অন্য কোন জেলায়
চলে যাবেন, যেখানে তিনি সন্তানকে নিজের
মনের মত করে মানুষ
করতে পারবেন।
শশুর সাহেব আপত্তি
করেন নি; তিনি অনুরোধ
করেছিলেন ‘‘শশুর বাড়ীর সাথে
সম্পর্ক বি”িছন্ন করোনা,
শত হলেও এটা ভন্ডুলের
নানা বাড়ী ।’’
বিনীত ভাবে ইসমাইল সাহেব
উত্তর দেন- জ্বী আ”ছা। এরপর ভন্ডুল
ও তার বাবা শেরপরে
ওর এক বন্ধুর মাধ্যমে
একটা বাড়ী কিনে ¯’ায়ীভাবে
চলে আসে।
এমনিতে ভন্ডুল নতুন জায়গা ও
নতুন মানুষ দেখার জন্য খুবই উদগ্রিব
ছিল, তাই ওর বাবার
সাথে একা আসতেও কোন
আপত্তি ছিল না। নানা
বাড়ী থেকে যাত্রা শুর“
করার পর থেকেই ইসমাইল
সাহেব ভন্ডুলের নতুন জীবন শুর“র প্র¯‘তি
নেন। ট্রেনে পাশাপাশি বসে জানালা দিয়ে
বাইরে তাকিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন
‘‘কি মন খারাপ লাগছে?’’
‘‘নাহ্, একটু কষ্ট হ”েছ ছোট মামার
জন্য।’’
‘‘তা তো হবেই
তোমার সব দুষ্টামী তো
ওর সাথেই।’’
‘‘মামা আমাদের বাসায়
আসবে না ?’’
‘অবশ্যই আসবে। তুমিও চিঠি দেবে। তবে
আমি এখন থেকে তোমার
পড়াশোনার ব্যাপারটা দেখাশুনা করবো। প্রতিদিন ভোরে ওঠে তোমার
পড়া শুর“ হবে আমার
র“টিন অনুযায়ী।’’
‘‘আঃ’’ ভন্ডুল ভয়
পেয়ে যায়।
‘‘আঃ করলে হবে
না, বাবা, তোমাকে অবশ্যই সব বিষয়ে পাস
করতে হবে। সবাই ক্লাশে
ফাস্ট হতে পারে না,
কিš‘ সবাই ক্লাসে পাস
করতে পারে।”
‘‘এ্যা!’’ ভন্ডুল অবাক, সবাই আবার পাস
করে কিভাবে ?
‘‘থাক। লেখাপড়ার কথা
আমরা বাসায় যাওয়ার পর বলবো। ঘড়ি
ষবঃং বহলড়ু ঃযব লড়ঁৎহবু এবং
তোমার যখন যা খেতে
ই”েছ হবে বলবে!
কিনে দেবো।’’
‘‘কিš‘ নানা যে
বলছে বাইরের জিনিস না খেতে!’’
‘‘হ্যা, নানা নোংরা বাজে
জিনিস খেতে নিষেদ করেছেন,
কিš‘ তুমি খাবে ডিম,
কলা, আপেল, আঙ্গুর এইসব, ঠিক আছে?’’
ভন্ডুল মনে মনে খুব
অবাক হয়ে যায় ওর
বাবার ভাবভঙ্গি দেখে। গত দুবছরে ও
ভাবতো বাবা খুব গম্ভীর
ও মনমরা লোক। তাই ওর
সাথে পারত পক্ষে কথা
বলত না। কিš‘ এখন
দেখা যা”েছ ওর
বাবা খুব মিশুক!
নতুন বাসায় এসে
যেন ভন্ডুল ওর আব্বুকে একদম
বন্ধু হিসেবে পেল। সারাদিন দুজনে
এক সাথে বেড়ানো। পুরো
শহরটা আব্বুর সাথে চক্কর দেয়া।
যেখানে যখন খুশি যা
ই”েছ খাওয়া, ওর
কোনও আবদারেই আব্বুর না নেই। প্রথম
দুই সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেল। এরপর
ওকে স্কুলে ভর্তি করা হল। এর
মধ্যে প্রতিদিন ভোরে উঠে আব্বুর
সাথে পড়তে বসা তো
চলছেই। আব্বু যখন অংক ইংরেজী
বাংলা বুঝিয়ে দেয় তখন মনে
হয় কত সহজ। স্কুলের
টিচারগুলো এত সহজে পড়াতে
পারে না। সবাই খুব
গম্ভির। কোন প্রশ্ন করলে
বিরক্ত হয়। আব্বু একটুও
বিরক্ত হয় না, সহজ
করে গল্প দিয়ে বুঝিয়ে
বলে। প্রত্যেকটা বিষয়ই আব্বু গল্প বলে বলে
পড়ান। আব্বুর ভান্ডারে যে কত গল্প
! এভাবে দিন দিন ভন্ডুলের
স্কুল ও পড়ালেখার উন্নতি
হতে বেশী সময় লাগল
না। দুই বৎসর পর
ও যখন ক্লাস সেভেনে
উঠল দেখা গেল ওর
রোল নাম্বার চার। আব্বু ওকে
যত গল্প বলেছে-তার
মধ্যে ওর এবং আব্বুর
সবচে প্রিয় গল্প হ”েছ-
পিনোকিও। আব্বু প্রায়ই বলে তুমি হ”ছ বাংলাদেশের পিনোকিও।
অনেক আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে
একটা ছোটদের সিরিয়াল দেখাতো যার নাম ছিল
‘‘ভন্ডুল’’। ওটা ছিল
পিনোকিওর বাংলা অনুবাদ।
আব্বু বলেন- ‘‘আমি চাই তুমি
পিনোকিওর মত হবে।’’
‘‘তা, কিভাবে সম্ভব
আব্বু ? পিনোকিও তো একটা গল্প,
মিথ্যে বললে পিনোকিও নাক
লম্বা হয়ে যায়। আমার
তো তা হয় না।’’
‘‘কেন, তুমি মিথ্যে
কথা বল নাকি?’’
‘‘না, তা বলি
না, তবে মাঝে মাঝে
ক্লাসে বন্ধুদের সাথে ... ’’
‘‘না, বাবা, তুমি
আমার সাথে প্রতিজ্ঞা কর,
জীবনে কখনও মিথ্যে কথা
বলবে না, বললেই কিš‘
তোমার নাক বড় হয়ে
যাবে।’’
‘‘যাঃ আব্বু তুমি
যে কি বল? মানুষের
আবার নাক বড় হয়
নাকি? এবস তো হয়
গল্পে’’
‘‘হাঃ হাঃ তুমি
ঠিকই বলেছো, স্মার্ট বয়। কিš‘ মানুষের
মিথ্যা কথা বললে একটা
সমস্যা হয়, বল দেখি
সমস্যাটা কি?’’ ইসমাইল সাহেব হাসি মুখে ভন্ডুলের
দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
‘‘বলতে পারবো না,
আব্বু, তুমি বলে দাও’’
ভন্ডুলের উত্তর।
‘‘ঠিক আছে বলছি,
পিনোকিওর গল্পে মিথ্যা কথা বললে ওর
নাক বড় হয়ে যেত।
কিš‘ বাস্তবে মানুষের ক্ষেত্রে হয় উল্টো। মানুষ
যখন মিথ্যা কথা বলে, তার
মনটা ছোট হয়ে যায়।
বিবেক বুদ্ধি কমে যায়’’ ইসমাইল
সাহেব ভন্ডুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন-
‘‘বাবা ভন্ডুল, তোমার
মা, এবং আমি কখনও
মিথ্যা কথা বলিনি, বলবও
না। তুমি প্রতিজ্ঞা কর
জীবনেও মিথ্যা কথা বলবে না।’’
ভন্ডুল যেন ফিস ফিস
করে বলে-‘‘বলব না, আব্বু।’’
ভন্ডুলের মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ইসমাইল সাহেব বলেন-
‘‘তুমি যদি কখনও
মিথ্যা কথা বল, সাথে
সাথে তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’’
‘‘প্রায়শ্চিত কি আব্বু?’’
‘‘বলছি, প্রায়শ্চিত্ত হ”েছ খারাপ
কাজের জন্য অনুশোচনা ও
শাস্তি ভোগ করা।’’
‘‘তো, আমার কি
শাস্তি হবে?’’ ভন্ডূ ভয় পায়।
‘‘তোমার শাস্তি হবে, মিথ্যা বলার
সাথে সাথেই তোমাকে কোন ভালো কাজ
করতে হবে।’’
‘‘কি রকম ভালো
কাজ বাবা?’’
‘‘যে কোনও ভালো
কাজ, যাতে কারো উপকার
হয়। এমনকি একটা গাছ লাগানও
মানুষের উপকার করা হয়।’’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন