সুন্দরবনে
প্রথম দিন
‘‘ও
আল্লাহ্ চার দিকে কত ঘন জঙ্গল!’’
চিৎকার
করে উঠল সাজু। যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।’’
‘‘আমার কিন্তু ভয় লাগতাছে’’
বিদ্যুতের হাত ধরে কাপতে কাপতে বলল মিন্টু, ‘‘ উচায়
উঠতে আমি ভয় পাই।’’
বিদ্যুত ওর কাধে হাত রেখে বলল ‘‘তোর তো
সব কিছুতেই ভয়। এত ভয় পাস কেন? আমরা সবাই আছিনা?’’
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখতে মিন্টুর ভয় আরোও
বেড়ে যায়, তাই ও চোখ বন্ধ করে ফেলল।
ভন্ডূলরা
কিছুক্ষণ হল সুন্দরবনে এসে পৌছেছে।
আজ
সকাল এগারোটার দিকে ওরা খুলনা লঞ্চ ঘাটে পৌছে বিদ্যুতের মামার সাথে দেখা করেছে। কামাল
মামা তখন ওদেরকে সুন্দরবনে থাকার অনুমতি পত্র দিয়েছে এবং ওদের কে নিয়ে খুলনা শহরে উনার
বাসভবনে সাময়িক বিস্রাম ও আহারের বিরতি হল। বিদ্যুতদের জন্য ঘের থেকে আসা বড় বড় চিংড়ি
ছিল। মিন্টু পাঁচটা চিংড়ি সাবাড় করে দিল। অন্যরাও অবশ্য কম পক্ষে দুইটা করে খেয়েছে।
খাওয়ার সময় কামাল মামা বললেন ‘‘বিদ্যুত আমার কিছু অফিসিয়াল কাজ আছে সুন্দরবনে, সেজন্য
একজন লোক তোমাদের সাথে একটু যাবে, যদি তোমাদের কোনও অসুবিধা না থাকে।’’
বিদ্যুত
ও ভন্ডুলের চোখে চোখে কথা হল নিরবে।
বিদ্যুত বলল ‘‘আমাদের কি অসুবিধা মামা,
উনি আপনার কাজে যাবে, কাজ করে চলে আসবে।’’ বড় মামা হেসে বলল ‘‘আসলে আনোয়ারের বাড়ী
সুন্দরবনে। ওর আব্বা বাওয়াল ছিল। ও যদিও ফরেষ্ট এর একটা কাজে যাচ্ছে, সাথে ও ছুটিতেও
যাচ্ছে। ওকে যদি তোমাদের ভালো লাগে ও তোমাদের সাথে দুএকদিন থেকে তারপর ওর বাড়ী চলে
যাবে।’’
বিদ্যুত
ও ভন্ডুলের আবার চোখে চোখে কথা হল। বিদ্যুত বলল ‘‘ঠিক আছে মামা।’’
খাওয়ার
পর কামাল মামা সবাইকে এস.আই. আনোয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
এস
আই আনোয়ার রুমে ঢুকে প্রথমে মামাকে ঠাস করে পায়ের আওয়াজ ও হাত উঠিয়ে সেলুট করল।
‘‘এই হচ্ছে আনোয়ার,’’ কামাল মামা বললেন,
‘‘ও তোমাদের সাথে যাবে। যেতে যেতে তোমরা আলাপ পরিচয় করে নিও। চল এখন রওনা'দেওয়া যাক।’’
কামাল
মামা খুলনা থেকেই ওদের কাছে বিদায় নিয়েছেন।
এস
আই আনোয়ার ওদেরকে নিয়ে জীপ গাড়ীতে লঞ্চ ঘাটে এল। সেখানে থেকে বেলা আড়াইটায় রওনা হয়ে
ওরা প্রথমে এসেছে সুন্দরবন অভয়ারন্য কট্কা।
আসার সময় আনোয়ার অফিসিয়াল ড্রেস খুলে টি
সার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরেছে।
চোখে সানগ্লাস, সুদর্শন, লম্বা, স্বাস্থবান , আনোয়ারকে সিভিল ড্রেসে
দেখে ছেলেরা সবাই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ইংরেজী ছবির ভক্ত সাজু বলল ‘‘আনোয়ার সাহেব,
আপনাকে একদম টমক্রজের মত লাগছে।’’
সানগ্লাস
পড়া এস. আই আনোয়ার গম্ভির মুখে ওদের দিকে তাকালো। সাজু একটু ভয় পেয়ে গেলো। ভদ্রলোক
মাইন্ড করল নাকি!
ভয় পাওয়া সব ছেলেদের দিকে তাকিয়ে এস, আই
আনোয়ার হঠাৎ ফিক্ করে হেসে উঠলেন।
“খবরদার, আনোয়ার সাহেব বলবে না আমাকে,
আনোয়ার ভাই বলবে।”
সেই মুহুর্তেই ভন্ডূলদের সবার আনোয়ার ভাইকে
ভালো লেগে গেলো।
তো আনোয়ার ভাই প্রথমে ওদের নিয়ে এসেছে
কট্কা।
রূপসা নদীর ধারা যেখানে প্রথম সুন্দরবনের
দিকে ডানে এগিয়েছে সেখানে একটু এগুতেই প্রথমে আসে কট্কা।
কট্কা অভয়ারণ্য সর্বসাধারনের জন্য খোলা।
প্রতিদিন বহুলোক এখানে আসে সুন্দরবন দেখতে। কট্কা আসতে কোন অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
খুলনা থেকে ট্রলার, বোট, জাহাজ ভাড়া করে সবাই আসতে পারে।
কট্কা
অভযারণ্য আসার আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা বনের চিত্রল হরিণ দেখলো। আনোয়ার ভাই এর নির্দেশিত
পথে হাটতে হাটতে ওরা জঙ্গলের অনেক ভেতরে চলে এসেছিল। এখানে প্রায় চার ফুট চওড়া কাঠের
ব্রিজ তৈরী করা হয়েছে সবার চলাচলের জন্য। এক জায়গায় এসে আনোয়ার ভাই বলল, ‘‘ চুপ চাপ
থাকো, প্লিজ। আর ক্যামেরা রেডী করে দাড়িয়ে থাকো। ”
একটু পর মিন্টু বলল ‘‘আমার খিদা লাগছে।
”
সবাই
চোখ গরম করে ওর দিকে তাকালো আনোয়ার ভাই ঠোটে আংগুল দিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করলেন।
পাচ
ছয় মিনিট নিরবে দাড়িয়ে থাকার পর ওরা অবাক হয়ে দেখলো একটা বাচ্চা হরিণ কাঠের ব্রিজের
থেকে একটু সামনে একে বারে ওদের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে! একটু পর আরোও দুটো বড় হরিণ বাচ্চাটার
পাশে এসে দাড়িয়ে গাছের পাতা খেতে লাগলো।
বাদামী হরিণ গুলো দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে গেলো।
সাজু গলায় ঝুলানো ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।
ফ্লাশ
লাইটের আলোয় চমকে উঠে হরিণ গুলো দৌড়ে চলে গেল।
মুগ্ধ
ছেলেরা এরপর এসেছে এই ওয়াচ টাওয়ারে।
প্রায়
পঞ্চাশ ফিট উচু এই ওয়াচ টাওয়ারে মিন্টু উঠতে চাইছিল না ভয়ে। উচুতে উঠতে ওর ভয়, আনোয়ার
ভাই ওকে সাহস দিযে উপরে উঠিয়েছে।
ওয়াচ
টাওয়ার থেকে বহুদুর পর্যন্ত দেখা
যায় বনটার। সবুজ জঙ্গল দেখতে দেখতে ছেলেরা সবাই খুব উৎফুল্ল বোধ করছিল। আনোয়ার ভাই
ওদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল সামনে ওরা কোন দিকে যাবে, এখানে উপর থেকে প্রায় কিছুই বোঝা গেল
না। যত দুর চোখ যায় শুধু সবুজ বন আর বন।
প্রায়
আধ ঘণ্টা পর ওরা নিচে নেমে এল।
‘‘ভন্ডূল, শুনলাম তুমি আর বিদ্যুত নাকি
একটা ট্রেন এক্সিঢেন্টে থেকে বাচিয়েছো” আনোয়ার ভাই জিজ্ঞেস করল।
ওরা
সবাই কট্কা থেকে যাত্রা করেছে, গন্তব্য সুন্দরবনের আরও ভেতর দিকে, ট্রলার চলছে ধীর
গতিতে। শেষ বিকেলের আলো হাওয়ায় সবাই বসেছে দোতালার ঢেকে। প্লাষ্টিকের চেয়ার নিয়ে যে
যেখানে খুশী বসেছে।
আনোয়ার ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে ভন্ডূল লাজুক
হাসলো। বহুবার শুনায় পুরো ঘটনাটা সাজুর যেন মুখস্থ হয়ে গেছে, তাই ওই এবার বিস্তারিত বলল আনোয়ার ভাইকে।
এদিকে
মিন্টু আর বাবলু দুজনেই উসখুস করছিল, বিদ্যুত ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘‘ কিরে
কিছু বলবি ?”
মিন্টু এক মুহুর্ত দেরী না করেই বলল,”
সেই কখন দুপুরের ভাত খাইছি, খিদা লাইগা গেছে। কিছু নাস্তা হইলে ভালো হইত।”
‘‘
ও, এই ব্যাপার” বলে বিদ্যুত হেসে উঠল।
‘‘
নিজাম ভাই, নিজাম ভাই” ও চিৎকার করে ডাকলো।
‘‘
আসতেছি বিদ্যুত ভাই” ডাইনিং রুম থেকে নিজাম ভাই উত্তর দিল।
দুমিনিট
পর দেখা গেল নিজাম ভাই নাস্তা সাজিয়ে একটা ট্রে হাতে ওদের দিকে আসছে। যেন নিজাম ভাই
জানতেন কেন ডাকা হয়েছে।
সামনের টেবিলে নাস্তার ট্রে রেখে নিজাম
ভাই বলল ” ডাক শূন্যাই বুঝছি আপনাদের নাস্তা চাই। আমি তাই মুড়ি চানাচুর সাথে সাথে নিয়া
আসলাম। আপনারা খাইতে থাকেন, আমি চা বানাইয়া আনতাছি।”
চা খেতে খেতে ঠিক হল আজ রাতটা ওরা ট্রলারেই
থাকবে। কাল সকালে ক্যাম্প করার মত একটা জায়গা খুজে তাবু টানানো হবে।
***********
‘‘ ঐ দেখ কুমির!”
হঠাৎ সাজু চিৎকার করে উঠল ওর ক্যামেরা
নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।
সবাই ওর নির্দেশিত দিকে তাকিযে দেখলো খালের
পাড় থেকে একটা কুমির পানিতে নামছে। আনোয়ার ভাই
ওটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘সাজু , ওটা আসলে গুই সাপ, কুমির না, দেখ ওটার গায়ের রং হলুদ
আর আকারে বেশ ছোট, মাত্র চার সাড়ে চার ফুট।”
‘‘ গুই সাপ হোক আর কুমিরই হোক কি সুন্দর
লাগছে দেখতে! ”
সাজু ওর ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে সবাইকে
ছবিগুলো দেখালো আর নিজেই আবৃত্তি করতে লাগল-
‘‘ বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে।”
সাজুর আবৃত্তি শুনে এস আই আনোয়ার খুব অবাক
হল।
‘‘ বাহ তুমি তো চমৎকার আবৃত্তি কর, সাজু।”
‘‘ হ্যা আনোার ভাই, ও প্রতিবার স্কুল ফাংশনে
আবৃত্তি করে, গানও খুব চমৎকার গায়” বিদ্যুত বলল।
‘‘ তাহলে, হয়ে যাক একটা গান ” আনোয়ার ভাই
শুনতে চাইলেন।
মন্থর গতিতে ট্রলার চলছে। গভীর খালের উপর দিয়ে পানির বুক
চিড়ে এগিয়ে চলা। অস্তাচলে সূর্য ডুবছে পশ্চিম
দিকে কমলা রংয়ের আভা। মনের সমস্ত গ্লানি দুর করার আলো।
সবাই গোল হয়ে বসল সাজুর গান শুনার জন্য।
সাজু কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে গান মনে করল।
‘‘ আমার সকল দুঃখের প্রদ্বীপ জেলে করব...”
সন্ধ্যার আলো আধারীতে ছেয়ে গেলো চলাচর।
সাজুর সন্ধ্যা বরণ করার রবীন্দ্রসংগীত ওদের নিয়ে গেলো অন্য এক অলিক জগতে।
***
‘‘ বয়েজ, গেট রেডি ফর ল্যান্ডিং”
আনোয়ার ভাই চিৎকার করলেন-‘‘ আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছে গেছি।”
‘‘ নিজাম, রহমান ভাই সামনে ঐ যে ছোট নালা
দেখা যাচ্ছে বামদিকে এটা দিয়ে একটু ভেতরে যাবেন, তবে স্টার্ট বন্ধ করে দিন, নাইলে বেশী
দুর চলে যেতে পারে।”
আধ ঘণ্টা হল সন্ধ্যা নেমেছে। ট্রলারের
লাইট না হলে কিছুই দেখা যেতো না।
আনোয়ার ভাইয়ের নির্দেশিত দিকে সতর্ক ভাবে
তাকাতে একটা ছোট নালা দেখা গেলো, যেটা খালের পাড়ের গাছের ছায়ায় ঢাকা। আগে থেকে জানা
না থাকলে কেউ লক্ষই করবেনা। স্টার্ট থামিয়ে ধীরে ধীরে ছোট নালার ভেতর ট্রলার ঢুকিয়ে দিল রহমান ভাই, নিজাম দৌড়ে
গেল বো এর দিকে নোঙ্গর নিয়ে। পাশে দাড়িয়ে আনোয়ার ভাই দেখালো, কোথায় নোঙ্গর করতে হবে।
নিজাম ভাই নোঙ্গরটা ছুড়ে মারলো পাড়ের
দিকে। একটা গাছের মোটা ডালে ওটা আটকে নিজাম ভাই দড়ি ধরে টানতে টানতে ট্রলারটাকে পাড়ে
নিযে ঠেকালো।
ভন্ডূলরা সবাই ডেক-এ দাড়িয়ে অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করছে। অবশেষে ওরা গহীণ বনে পৌছেছে !
নোঙ্গর শেষ হতেই নিজাম ভাই লাফ দিয়ে পাড়ে
উঠে নোঙ্গরের দড়িটা শক্ত করে গাছের গুড়ির সাথে বাধলো।
ছেলেরা সবাই চাইছিল দৌড়ে পাড়ে গিয়ে উঠতে।
কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছে, অন্য কেউ আগে যাক।
ট্রলারের ওয়াচ লাইট ছাড়া অন্য কোনও আলো
নেই কোথাও।
রহমান ভাইকে ওয়াচ লাইট নিভাতে বলল।
হঠাৎ আলো নিভে যাওয়ার পর চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। আনোয়ার ভাই ডেকে
এসে ভন্ডূলদের পাশে দাড়ালেন।
‘‘ আজ আর জঙ্গলে নেমে কাজ নেই। অন্ধকারে
ভালো দেখা যাবে না। এদিকে আকাশও মেঘলা, যে কোনও সময় বৃষ্টি হতে পারে,” সবার দিকে তাকিয়ে
তিনি বললেন ‘‘ চল, আজ রাতটা আমরা ট্রলারেই কাটিয়ে দেই।”
যদিও ট্রলার পাড়ে নোঙ্গর করা তবুও গাছের
ফাঁক দিয়ে ভেতর দিকে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা, এত ঘণ জঙ্গল। ভন্ডূলদের একটু মন খারাপ হয়ে
গেলো।
প্রথম দিন রাতে ওরা কত কিছু পরিকল্পনা
করে রেখেছিল !
ওদের দিকে তাকিয়ে আনোয়ার ভাই আবার বললেন
‘‘ যদি রাতে আবহাওয়া ভালো থাকে, তোমাদের আমি জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যাবো, একটা ইন্টারেষ্টিং
জায়গা দেখাতে। এখন চল সবাই মিলে রান্নার আয়োজন করি, মজা হবে।”
‘‘ গুড আইডিয়া ! ” চিৎকার করে উঠল মিন্টু।
খাবার প্রসঙ্গে যে কোন আইডিয়াই ওর কাছে ভালো লাগে।
‘‘ চল দেখি, রাতের আয়োজন কি।”
হঠাৎ বিজলী চম্কে উঠল আকাশে, বজ্রের শব্দ
শোনা গেলো। কোথা থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে ওদের শরীর কাঁপিয়ে দিল।
‘‘ মনে হচ্ছে, বৃষ্টি হবে” আনোয়ার ভাই মন্তব্য করলেন –“চল, ডাইনিং
এ যাই।”
সবাই
ডাইনিং-এ দৌড় চলে এল, হাতে একটা করে প্লাষ্টিক চেয়ার। এর পর সবাই মিলে শুরু হল রান্নার
আয়োজন।
‘‘ মনে হচ্ছে জব্বর বৃষ্টি হবে। চল, খিচুরী
রান্না করি ” আনোয়ার ভাই বললেন।
সবাই মিলে হৈ হৈ করে শুরু হল রান্নার আয়োজন,
কেউ তরকারী কাটছে, কেউ চাল ধুচ্ছে কেউ ডাল ধুচ্ছে, কেউবা গিয়ে ডিম সিদ্ধ করছে।
কিছুক্ষণ পর বাইরে তুমূল বৃষ্টি শুরু হয়ে
গেলো। ঠান্ডা কন কনে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাটে ওদের ভিজে যাওয়ার অবস্থা। সবাই দৌড়ে গিয়ে
জানালা বন্ধ করল। এরপর গল্প কথায় ও গানে গানে রান্না চলল।
সবার অংশগ্রহণের জন্যেই হোক অথবা রান্নার
গুনেই হোক ডিম ভূনার সাথে ভূনা খিচুরী সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলো। মিন্টু তো পারলে
খিচুরীর পাতিল শুদ্ধ খেয়ে ফেলতে চায়।
বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা
রাত এভাবেই চলবে। বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণই নেই।
‘‘ দুর! আমরাও এলাম, আর বৃষ্টি শুরু হল”
বিদ্যুত আফসোস করল, ‘‘ না জানি কালকে কেমন আবহাওয়া থাকবে!”
ফাস্ট বয় সাজু মন্তব্য করল, ‘‘ উহু এভাবে
হতাশ হলে চলবে না। সব সময় উইশফুল থিংকিং করতে হয়। দেখবি কাল সকালে কী চমৎকার আবহাওয়া
হবে।”
‘‘ দ্যাটস কল স্পিরিট ” আনোয়ার ভাই বলে
উঠলেন,‘‘ মন খারাপ না করে বরং কালকের জন্য প্ল্যান প্রোগ্রাম করা যাক।”
‘‘ হুরররে ।”
ছেলেরা সবাই চিৎকার করে উঠল।
আনোয়ার ভাই হাসি মুখে ওদের দিকে তাকালেন।
ডান হাত তুলে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন।
সবাই খুব অবাক হয়ে উনার দিকে তাকালো। ডাইনিং
রুমের দরজা জানালা বন্ধ। বাইরে বিজলী চমকাচ্ছে আর সাথে তুমূল বৃষ্টি।
‘‘ শোন তোমরা, একটা খুব গুরত্বপূর্ণ কথা এখন বলব
”আনোয়ার ভাই শুরু করলেন,‘‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে, জঙ্গলস্ ল। এর অর্থ হচ্ছে বনের নিয়ম
কানুন। সহজ কথায় বলতে হয়, জঙ্গলের ভেতর সব সময় সকর্ত থাকতে হয়, হৈ চে করতে হয় না। এক
দম চিৎকার করা যাবে না। একটু আগে তোমরা হুরররে করে চিৎকার করলে, বাচ্চারা আনন্দের জন্য
এরকম করতেই পারে। কিন্তু এই জঙ্গলে যারা বাস করে তাদের ডিসটার্ব হতে পারে, এমন কি তোমাদের
শব্দ শুনে কোনও ভয়ংকর প্রাণীও চলে আসতে পারে। সেই জন্য বনের মধ্যে, বিশেষ করে রাতে
জোরে কথা বলবে না। নইলে বিপদ হতে পারে।”
আনোয়ার ভাইয়ের কথা শুনে সবার মুখ থমথমে
হয়ে গেলো। ওদের দিকে তাকিয়ে আনোয়ার ভাই আবার মুচকি হাসলেন,‘‘ আরে এত সিরিয়াস হওয়ার
কি আছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা সবাই সব সময় এক সাথে থাকবো আর সতর্ক থাকবো।”
ছেলেরা নিরবে মাথা উপর নীচ করে সম্মতি
জানালো।
ভন্ডূল বলল ‘‘ আনোয়ার ভাই, বলুন কালকের
প্লান কি।”
এর পর সবাই মিলে আগামী কালের পরিকল্পনায়
ব্যস্ত হয়ে গেলো। বাইরে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষন নেই।এক সময় সবাই ডাইনিং ফ্লোরেই বিছানা
বালিশ পেতে ঘুমিযে পড়ল।
***
পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে ওদের সবারই
বেশ দেরি হল। সবার আগে ঘুম ভাঙ্গলো ভন্ডুলের, তখন বাজে সাড়ে আটটা। ভন্ডূল একা একা চলে
এল ডেকে। চারদিকে তাকিয়ে ও খুব অবাক হয়ে গেল। কাল রাতে খালের পাড় ছিল ডেকের সমান্তরাল,
এখন অনেক উচু।
জঙ্গলের রাতের রূপ আর দিনের রূপের মধ্যে বিরাট ফারাক। সারা রাতের বৃষ্টির পর
আকাশ একদম ফর্শা। নীল আকাশে এখন শুধুই সাদা মেঘের ভেলা।জঙ্গলের সমস্ত গাছে বৃষ্টি ধোয়া
এক প্রশান্তভাব। ও মুগ্ধ হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। একটু পর সাজু আর বিদ্যুত ওর পাশে
এসে দাড়ালো। সাজু ওর ক্যামেরা বের করে একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগলো প্রকৃতির।
কিছুক্ষণ পর একে একে সবাই জেগে উঠল, নিজাম
ভাই ব্যস্ত হয়ে গেল নাস্তা তৈরীতে। আনোয়ার ভাই ওদের নিয়ে খালের পাড়ে নেমে এলেন। ইতি
মধ্যে ওরা হাত মুখ ধুযে নিয়েছে।
‘‘ চল , একটু চারপাশটা হেটে দেখে আসি”
আনোয়ার ভাই প্রস্তাব দিলেন।
ছেলেরা সবাই ওর পিছে পিছে চলল।
জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে ওরা খুব অবাক হয়ে গেলো।
কাল রাতের ঝড় বৃষ্টিতে অনেক গাছ ক্ষতিগ্রস্থ
হয়েছে। বেশ কিছু গাছ বাঁকা হয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। আশ্চার্য ব্যাপার যে খালের পাড়ে কয়েকটা
ডাব ও কলা গাছ বাঁকা হয়ে পড়ে আছে। ওরা দৌড়ে গিয়ে ডাব গাছের উপর দাড়াল। খালের পাড়ের
গোল পাতা গাছের পাশেই ডাব গাছ পানির দিকে বাঁকা হয়ে আছে।
মিন্টুই প্রথমে গিয়ে ডাব হাত দিয়ে মুচবে
ছেড়ার চেষ্টা করল। ওর দেখা দেখি সবাই একই কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে ওরা এক
কাদি কলা, পনেরটা ডাব নিয়ে ট্রলারে ফিরে এল।
ততক্ষণে নিজাম ভাই ওদের নাস্তা রেডী করে
ফেলেছে। ওরা নাস্তার সাথে বন্য কলা ও ডাব উপভোগ করল।
‘‘ এই লঞ্চটা মনে হচ্ছে বেশ মজবুত! ”
চারদিকে তাকাতে তাকাতে আনোয়ার ভাই মন্ত্যব্য
বরলেন, ‘‘কাল রাতের ভয়াবহ ঝড় আমরা ভেতর থেকে একদম টের পাইনি।”
‘‘ হ্যা এটা খুব মজবুত নৌযান”
রহমান ভাই ভারিক্কি চালে বললেন,
‘‘ আরেফিন স্যার এইটা ভিয়েতনাম থেইকা কিন্না আনছে।”
‘‘ হুম, তাই এটার ডিজাইন এত আধুনিক ও নিরাপদ
” আনোয়ার ভাই বললেন।
চা খাওয়ার পর ওরা সবাই ব্যাগ কাধে নিয়ে স্কাউটিং এ বেরুল। সবার পরনে
সার্ট অথবা টি সার্ট, জিন্স পেন্ট ও কেড্স। এর উপর জ্যাকেট। একে বারে প্রস্তুত ।
আনোয়ার ভাইয়ের দেখানো পথে ওরা এগিয়ে চলল।
প্রায় দশ মিনিট হাটার পর ওরা ওদের গন্তব্যে
পৌছল। ওদের সামনে দুইটা বিশাল গাছের উপর একটা মাচাং! প্রায় বিশ ফুট উচ্চতা। পাশা পাশি
দুটি কেওরা গাছের ডাল ব্যবহার করে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে। ওরা অবাক
হয়ে দেখলো দুটো গাছের ডাল যেন এই মাচা তৈরির জন্যই সমান্তরাল ভাবে পাশাপাশি বেড়েছে!
গাছের গোড়া দুটো এতই চওড়া যে একজন মানুষ দুহাতে জাড়িয়ে ধরতে পারবে না।
ভন্ডূল বলল ‘‘ এই মাচাটার উপর উঠবো কীভাবে
আনোয়ার ভাই? কোনও মই বা উঠার ব্যাবস্থা তো দেখছি না।”
আনোয়ার ভাই মুচকি হাসলেন। এর পর কিছু না
বলেই সামনের একটু দুরে একটা গোল পাতার ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলেন। ছেলেরা অবাক হয়ে ওর
কাণ্ড দেখছিল। ওদের চোখের সামনে আনোয়ার ভাই ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেলেন। কাল রাতের ঝড়ে
অনেক গাছ ও বাঁকা হয়ে গেছে ।
দুই তিন মিনিট পর আনোয়ার ভাই একটা প্রায় পনের ফুট লম্বা দুপাশে গিট অলা বাঁশ হাতে নিয়ে
ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল।
‘‘ এইটা হচ্ছে মাচায় উঠার সিড়ি, এটা ঝোপের
আড়ালে লুকানো থাকে যাতে সবাই ব্যবহার করতে না পারে।”
‘‘ ওয়াও!” সাজু খুব অবাক হয়ে বলল, ‘‘ একটা
বাঁশ দিযে কীভাবে মাচায় উঠা যাবে।”
‘‘ খুব সহজ, এসো দেখিয়ে দিচ্ছি।”
আনোয়ার ভাই বাঁশটা নিয়ে মাচার একপাশে দিয়ে গাছের গুড়ির কাছে দাড়ালেন।
এর পর তিনি বাঁশটা লম্বা করে দাড় করালেন।
সবাই দেখলো বাঁশের উপর দিকে একটা লোহার আংটা আছে। সেটা তিনি উপরে গাছের ডালে আর একটা
আংটার মধ্যে আটকে নিলেন।
তারপর তর তর করে দুপাশের গিটের মধ্যে পা
দিয়ে উপরে উঠে গেলেন। ছেলেরা অবাক হয়ে দেখলো উপরে উঠে আনোয়ার ভাই একটা ডালের আড়ালে
লুকানো দড়ির মই বেড় করলেন।
‘‘ একজন একজন করে উপরে উঠে এসো,” নীচের
দিকে তাকিয়ে আনোয়ার ভাই বললেন।
ছেলেরা একজন উপরে উঠতেই আনোয়ার ভাই দড়ির
মই দিয়ে ওকে উপরে মাচায় উঠে যেতে বলল। এভাবে একে একে সবাই উপরের ডালে উঠার পর তিনি
আংংটা থেকে বাঁশটা খুলে উপরে উঠিয়ে আরেকটা চিকন ঢালে বাঁশটা ঝুলিয়ে রাখলেন।
সবার শেষে আনোয়ার ভাই মাচায় উঠে আসলেন।
মাচাটা দৈর্ঘে প্রস্থে প্রায় ষোল বাই বিশ ফুট। সবাই উঠার উপর
দাড়িয়ে বুঝতে পারলো মাচাটা খুব মজবুত করে তেরি করা হয়েছে।
‘‘ দি আইডিয়া!” হঠাৎ ভন্ডূল বলে উঠল। সবাই
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো।
ভন্ডূল বলল ” আনোয়ার ভাই, আমরা এটার উপর
ক্যাম্প করলে কেমন হয়!”
‘‘ গুড আইডিয়া !” আনোয়ার ভাই মুচকি হেসে
বললেন, ”তাছাড়া নিচে ক্যাম্প করে রাতে থাকা নিরাপদ নয়।”
‘‘ কেন, ভুত আছে নাকি!” জিজ্ঞেস করল মিন্টু।
‘‘ না, ভূত নেই, তবে রাতের অন্ধকারে অনেক
জীব জন্তু চলাফেরা করে। নীচে জঙ্গলের ভেতরে থাকা তাই নিরাপদ না।”
‘‘ তোমরা সুন্দরবনে ক্যাম্পিং করবে শুনে
স্যার (কামাল মামা) তাই আমাকে তোমাদের এখানে নিয়ে আসতে বলেছেন।”
ভন্ডূলরা একজন আরেক জনের দিকে তাকাতে লাগলো,
মামা প্রথম থেকেই সব কিছু ভেবে রেখেছেন!
ছেলেদের দিকে তাকিযে আনোয়ার ভাই আবার বললেন
‘‘ তোমরা আসলে একটা ব্যাপারে ভুল করেছো প্রথম থেকেই। তোমরা জানো না, সুন্দবনের কেউ
রাতে থাকে না। সারা বছর বিভিন্ন সময় বাওয়ালী ,মোওয়ালী (মধু সংগ্রহকারী), জেলে, জোংড়া
খুটারা ও মাঝিরা সুন্দরবনে আসে কিন্তু কেউ রাতে বনের ভেতর থাকে না। সবাই নৌকাতে থাকে
রাতে। কিন্তু তোমাদের এত আগ্রহ দেখে স্যার (কামাল মামা)
আমাকে বলেছেন যেন তোমাদের অন্তত একরাত এই বনে ক্যাম্প করার ব্যবস্থা করে দেই। যদিও
আমার মতে সবার লঞ্চেই থাকা নিরাপদ। ”
এরপর ছেলেরা সবাই কাধ ব্যাগ নামিয়ে তাবুর
সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আনোয়ার ভাই একটা লম্বা নাইলনের দড়ি মাথার উপর আড়াআড়ি
দুই গাছের ডালে বেধে দিলেন। এরপর ছেলেরা দড়ির দুপাশে তাবুর কাপড় ছড়িয়ে দিল। প্রত্যেকে
চারদিকে ছড়িয়ে তাবুর এক একটা প্রান্ত মাচার বাঁশের সাথে বেধে ফেলল।
ভন্ডুলের দেয়া লিস্টের মধ্যে সবার জন্য
একটা পকেট নাইফ আনা বাধ্যতামূলক ছিল। দেখা গেলো সুভ্রই ওটা ব্যবহার করছে সবার প্রথমে,
তাবু খাটানো হয়ে যেতেই ও মাচার পাশে দাড়িয়ে এক লাফে গাছের উপর দিকেব একটা ডালে উঠে
সেটার আশে পাশে গজানো চিকন শাখা প্রশাখা কাটিতে লগলো।
বিদ্যুত জিজ্ঞেস করল ‘‘ কিরে , কি করছিস।”
উপর থেকে সুভ্র বলল, ‘‘ নিচে মেঝেতে বিঝানোর
জন্য পাতলা ছোট ডাল গুলো কাটছি।”
ভন্ডূলও
একমত হল ওর সাথে,‘‘ গুড আইডিয়া ! একটু বড় ডালও কাটিস তাবুর চারদিকে ঢেকে দেব। বাইরে
থেকে আর দেখা যাবে না।”
সুভ্রর সাথে তিতু আর বাবলুও গাছের ডাল
কাটতে লেগে গেলো। কিন্তু পকেট নাইফ দিয়ে ছোট চিকন ডাল কাটা গেলেও একটু বড় ডাল কাটা
যাচ্ছেনা। সুভ্ররা উপর থেকে ডাল কেটে নিচে মাচার মধ্যে ফেলছে। দেখতে দেখতে মাচা উপচে
পরার মত অবস্থা।
ভন্ডূল বলল, ‘‘ এবার থাম। আর কাটতে হবে
না। ”
সুভ্র, তিতু, বাবলু মাচার উপর নেমে এল।
সবাই চিকন ডাল গুলো নিয়ে তাবুর ভেতর মেঝেতে বিঝিযে এর উপর শতরঞ্জি ও বিছানার চাঁদর
বিঝালো। মিন্টু প্রথমে মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
‘‘ আহ কি আরাম!”
ওর দেখা দেখি সবাই শুয়ে দেখতে লাগলো। হ্যা,
সত্যিই আরাম। নীচে গাছের চিকন ডাল পাতা দেয়াতে বিছানাটা উচু ও আরামদায়ক হয়েছে।
‘‘ তোমরা তাহলে এখানে একটু বিস্রাম কর।
আমি রহমান এর কাছ থেকে একটা দা নিয়ে আসি বড় ডাল কাটার জন্য। চারিদিক থেকে তাবুটা ঢেকে
দেয়ার বুদ্ধিটা ভালো। তোমরা কিন্তু ভুলেও মাচা থেকে নীচে নামবে না, খবরদার!”
ভন্ডূল বলল ‘‘ আনোয়ার ভাই, আমি আপনার সাথে
আসি?”
”না, তুমি থাকো, আমি বরং পালোয়ান বাবলুকে
নিয়ে যাই, ” চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘‘ পথে যদি কোন ও সমস্যা হয় তাহলে
আমাকে সাহায্য করতে পারবে!”
ওর কথা শুনে বাবলু শোয়া থেকে লাফ দিয়ে
উঠে দাড়াল। তাবুর কাপড়ে ওর মাথা ঠুকে গেলো। সবাই ওর কান্ড দেখে হেসে উঠল। কুচ পারোয়া
নেই। আনোয়ার ভাই ওকে সংগে নিচ্ছে তাই ও সম্মানিত বোধ করছে। দুজনে প্রথমে দড়ির মই দিয়ে
নীচে নেমে মাঝের ডালটায় দাড়াল। সেখানে ঝুলিয়ে রাখা বাঁশটা আবার নীচের আংকটায় আটকে দুজন
নেমে গেলো। উপর থেকে ভন্ডূল বাঁশের মইটা আবার উঠিয়ে রাখলো।
আধঘণ্টা পর ওরা যখন ফিরে এল, নীচে থেকে
বাঁশি বাজিয়ে সিগনাল দিল আনোয়ার ভাই। ভন্ডূল গিয়ে আবার বাঁশের মই নীচে নামিয়ে দিল।
ওরা উপরে উঠে এল। ইতিমধ্যে সবাই মিলে তাবুর ভেতরটা একদম ফিটফাট করে ফেলেছে। সবার শোয়ার
জায়গা একদিকে। জামা কাপড় রাখার জায়গা উল্ট দিকে। এক কোণে জুতো রাখার জায়গা। মাঝে দুটো
লম্বা লম্বি দড়ি টানা। তাতে কয়েকটা হ্যাংগার ঝুলানো। যে কেউ কাপড় খুলে হ্যাংগারে রাখতে
পারবে। ভেতরে বসে ছেলেরা এত পূলক অনুভব করছে যে তা ভাষায় বর্ণনার অতীত। একজন আরেক জনের
দিকে অবাক ও আনন্দ ভরা চোখে তাকাচ্ছে। ওদের বিশ্বাসই হচ্ছেনা, ওরা সুন্দরবনে এসে বনের
ভেতর একটা ট্রি হাউজের মত ক্যাম্প করেছে। এতদিন এই ব্যাপারটা ছিল ওদের কল্পনায়, আজ
তা বাস্তব এবং কল্পনার চেয়েও সুন্দর।
আনোয়ার ভাই ফিরে আসতেই, দা দিকে উপর থেকে
কয়েকটা ডাল কেটে দিলেন। তা দিয়ে তাবুটাকে ঘিরে ফেলা হল। এমনভাবে তাবুর উপর শক্ত করে
ডাল গুলো বেধে দেয়া হল যাতে বাতাসে সরে না যায় এবং তাবুটা বাইরে থেকে দেখা না যায়।
তাবুর যাওয়া আসার পথটা ছাড়া সম্পূর্ণ ডাল পালায় ঢাকা।
সমস্ত প্রস্তুতি সেড়ে ওরা সবাই আবার তাড়াতাড়ি নীচে নেমে বাঁশের
মইটা লুকিযে ফেলল। এখন সবাই মিলে ট্রলারে ফিরে যাবে। সেখানে লাঞ্চের পর রাতের খাবার
প্যাক করে এক বারে ক্যাম্পে চলে আসবে। আজ ক্যাম্পেই
রাত্রি যাপন!
ট্রলারে ফিরে সবাই খুব অবাক হয়ে গেলো,
সকালে যেখানে ভাসমান ছিল এখন ট্রলারটা তার থেকে উপরে উঠে এসছে। অর্থাৎ পানির লেভেল
উপরে উঠে গেছে। সবাই মিলে খুব দ্রুত খাওয়া দাওয়া করে খাবার প্যাক করে নিল।আনোয়ার ভাই
তাড়া দিচ্ছে জলদি করার জন্য। যদিও সুন্দরবনের নিরাপদ অংশে উনি ভন্ডূলদের নিয়ে এসেছেন।
এদিকে কোনও ভয়ঙ্কর প্রাণীর আনাগোনা নেই। তবু সুন্দরবনের ব্যাপারে আগাম কিছুই বলা যায়
না। আনোয়ার ভাইয়ের বাম বগলের নীচে হোলস্টারে লুকানো একটা রিভলবার আছে। ভন্ডলরা তা জানে
না, যদিও ভয়ঙ্কর প্রাণীর জন্য রিভলবার তেমন সুবিধাজনক কিছু নয়।
খাওয়া দাওয়ার পর রহমান ভাই বলল, ‘‘ খুলনা
যাওয়া প্রয়োজন কিছু কেনাকাটা করতে হবে।”
আনোয়ার ভাই বললেন, ‘‘ কি কিনবেন?”
‘‘ এই তরিতরকারী মাছ মাংস আর ড্রাই ফুড।”
‘‘ ঠিক আছে, আপনি চলে যান, আজ রাতটা খুলনাই
থাকবেন, কাল সকালে বাজার করে আপনারা ১১টা ১২টার মধ্যে চলে আসুন। আপনারা এলে আমি ছুটিতে
যাবো।”
ভন্ডূল
জিজ্ঞেস করল,“ আপনি সত্যিই ছুটিতে যাবেন?”
‘‘ হ্যা, কেন?” আনোয়ার ভাই অবাক হয়ে জানতে
চাইলেন।
বিদ্যুত উত্তর দিল ‘‘ না, আমরা ভেবেছি মামা আপনাকে
মিথ্যা কথা বলে আমাদের সাথে পাঠিয়েছে। ”
‘‘ আরে না, স্যার মিথ্যা কথা বলেনি, আমার
যদিও দায়িত্ব তোমাদের নিরাপত্তা দেখা শুনা করা, তবুও কাল একবার আমার বাড়ি যেতে হবে।”
ঠিক হল,ভন্ডূলদের রাতের খাবার ও কাল সকালের
জন্য কিছু কেক বিস্কুট, মুড়ি চানাচুর প্যাক করে দিয়ে রহমান ও নিজাম ভাই খুলনা চলে যাবে,
ভন্ডূলরা ওদের নতুন আবিস্কৃত ট্রি হাউজের তাবুতে চলে যাবে।
তাবুতে ফিরে ওরা সবাই খুব রিলাক্স হয়ে
গেলো। আনোয়ার ভাই বলেছে ঝড় বৃস্টি না হলে রাতে মজার দৃশ্য দেখা যেতে পারে। কিন্তু সন্ধ্যার
পর কোনও ভাবেই তাবু থেকে নিচে নামা যাবে না। সবাই ট্রলার থেকে বাথরুম ইত্যাদি সেরে
এসেছে। ফলে সে সব নিয়ে আপাতত কোনও সমস্যা হবে না ,আশা করা যায়।
ভন্ডূল বলল ‘‘ সবাইকে দাবা,মনোপলি এইসব
খেলার সরঞ্জাম আনতে বলেছিলাম, এই ধরণের বন্দি সময় কাঠটানোর জন্যেই। চল সবাই মিলে দাবা
অথবা লুডু খেলা যাক।”
এরপর সন্ধ্যার পূর্ব পর্যন্ত সবাই দাবা
আর লুডু খেলে সময় কাটালো যদিও সাজু বনাম বিদ্যুত, ভন্ডূল বনাম আনোয়ার ভাই দাবা খেলছিল
নিরবে, কিন্তু মিন্টু , তিতু , সুভ্র, ও বাবলুদের লুডু খেলার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লেগে
যাচ্ছিল। আনোয়ার ভাই স্ স্ স্ ইশারা করতে ওরা থামতে বাধ্য হয়। ইনডোর গেমস্ শেষ হতে
হতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেলো। আনোয়ার ভাই বললেন ‘‘ এখন খেলা বন্ধ কর আপাতত, চল তাবুর
বাইরেটা খেয়াল করে দেখি কি হচ্ছে?”
সবাই দাবা ও লুডুর বোর্ড গুছিযে ফেলল।
আনোয়ার ভাই প্রায় নিঃশ্বব্দে তাবুর দরজা দিয়ে মাথা বের করে বাইরের মাচার মধ্যে গিয়ে
দাড়ালেন। পেছনে ফিরে সবাইকে আসতে ইশারা করলেন।
ভন্ডূলরা একে একে সবাই এসে মাচার উপর লতা
পাতা ও ডাল পালার আড়ালে দাড়ালো। আনোয়ার ভাই বললেন ‘‘ চুপচাপ নিঃশ্বব্দে চার পাশ দেখতে
থাকো, কেউ জোড়ে শব্দ করবে না।”
নির্দেশ মত সবাই চুপচাপ রইল। মিন্টু ছাড়া
সবারই খুব কৌতুহল, মিন্টুর উচ্চতায় ভয় লাগে। ও প্রায় চোখ বন্ধ করে আছে, বিদ্যুত পাশে
দাড়িয়ে ওর কাধে হাত রেখে ওকে সাহস দিচ্ছে।
প্রায় দশ মিনিট কাটলো চুপচাপ। কিন্তু চার
পাশের দৃশ্যের তেমন কোনও পরিবর্তন হল না, হঠাৎ আনোয়ার ভাই হাত তুলে খালের দিকে ইশারা
করলেন। সবাই এক সাথে সেদিকে তাকালো।
খালের
পাড়ের দিকে দুইটা চিত্রল হরিণ এসে দাড়িয়েছে। ভন্ডূলরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো, হরিণ গুলোর
পাশে একে একে আরোও প্রায় পনের বিশটা হরিণ এসে খালের পাড়ে নেমে পানি খাওয়া শুরু করল।
আনোয়ার ভাই ছেলেদের দিকে মুচকি হেসে তাকালেন।
যেন উনার জানাছিল কখন হরিণ গুলো আসবে। সাজু ক্যামরা বেড় করতেই ফিস ফিস করে আনোয়ার ভাই বললেন ‘‘ ফ্লাশ অফ্ করে দিও।”
সাজু ফটা ফট কয়েকটা ছবি তুলল হরিণ গুলোর।
ভন্ডূলরা উপর থেকে অবাক হয়ে দেখলো নীচে এখন প্রায় তিরিশটার মত হরিণ এসে দাড়িয়েছ। ভন্ডূল
তাবুর ভেতরে গিয়ে দুরবিন নিয়ে এল। দুরিবিন চোখে লাগাতেই হরিণগুলো যেন আধহাতের মধ্যে
এসে গেলো। চাইলেই ছোয়া যাবে!
সাজু বলল”
গাছের উপরে থেকে ভালো ছবি পাচ্ছিনা। কাছে থেকে দেখতে পেতাম যদি!”
আনোয়ার ভাই ফিস ফিস বললেন ‘‘ সম্ভব না
, হরিণের কান খুব পাতলা আর ওরা এমনিতে ভীতু, যে কোনও শব্দ হলে দৌড়ে ভাগবে। এখন কথা
না বলে দেখতে থাকো।”
একে ঘন জঙ্গল, তার উপর সূর্য ডোবার সময়
হয়ে যাচ্ছে, ওরা হরিণগুলো আর দেখতে পাচ্ছেনা, আবছা অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ
সবগুলো খালের দিকে থেকে টাই টাই চিৎকার করে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
‘‘ সম্ভবত কুমির অথবা সাপ দেখে ভয় পেয়েছে
হরিণগুলো, আজ আর আসবে না । চল তাবুর ভেতরে যাই।”
সবাই তাবুর ভেতরে আসার পরও ভন্ডূলদের চোখে
মুগ্ধতা ! সবাই গোল হয়ে বসল। তাবুর ভেতর প্রায় অন্ধকার, দিনের বেলায় তাবুর ট্রান্সপারেন্ট
জানালা দিয়ে আলো আসছিল। এখন তা পাওয়া যাচ্ছেনা। একটা চার্জ লাইট জেলে দেয়া হল। সাজু
বলল ‘‘ কি বাত্তি লাগাইলি রে মানিক! সব ফক্ফকা !”
সবাই হেসে উঠল এক সাথে! তারপরই আনোয়ার
ভাইয়ের হুশিয়ারী স্বরণ করে সাথে সাথেই থেমে গেল। কিন্তু সাজুর বিখ্যাত ফিলিপ্স বাল্বের
বিজ্ঞাপনের নকল শুনে ভন্ডূলদের হাসি চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছে।
ভন্ডূল জিজ্ঞেস করল ‘‘ আনোয়ার ভাই, আপনি
কিভাবে বুঝলেন, হরিণগুলো সাপ বা কুমির দেখে ভয় পেয়েছে?”
‘‘ আসলে, আমি সিউর না, তবে অন্য সময় দেখেছি
হরিণগুলো আরো ও অনেক্ষণ খালের পাড়ের দিকে অবস্থান করে, এক সময় নিরবে একে একে চলে যায়,
আজ হঠাৎ একত্রে ভয় পেয়ে পালালো তাই ভাবছি সাপ বা কুমির দেখেছে।”
মিন্টু বলল ‘‘ আল্লাহ্ ! আমাদেরও যদি সাপে
কামড়ায়?”
আনোয়ার
ভাই বললেন, “ভয় নেই, এই সাপ বিষধর নয়, সুন্দরবনের সাধারনত অজগর সাপই দেখা যায়।”
‘‘ ওরে বাপ রে!” মিন্টু যেন কেঁদে উঠলো,
”এতো আরোও বড় সমস্যা! এখন আমরা নীচে নামবো কিভাবে?”
ওর কথা শুনে সবাই খিক খিক করে হেসে উঠলে।
‘‘ নিচের নামা আসলে কোন সমস্যা নয়, কেন
না, আমাদের কাছে আছে ক্লোরোফর্ম, ক্লোরোফর্মের গন্ধে সাপ কাছে আসেনা, ” আনোয়ার ভাই
সবার অবগতির জন্য জানালেন।
সাপ প্রসঙ্গ চাপা দেয়ার জন্য ভন্ডূল বলল
‘‘ আনোয়ার ভাই আপনি বাঘ দেখেছেন সুন্দরবনে?”
সবাই
উৎসুক হয়ে ওর দিকে তাকালো। আনোয়ার ভাই হেসে বললেন ‘‘ ঠিক সামনা সামনি বাঘ, মানে সুন্দর
বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখিনি, তবে একবার নৌকা দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্র বয়সে নদীর পাড়ে
সম্ভবত এক ঝলক দেখেছিলাম বাঘ মামাকে! বিশাল বড় মাথাটাই শুধু দেখছিলাম!”
এরপর শুধু হয়ে গেলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার
এর গল্প! আনোয়ার ভাই ভন্ডূলদের শুনালেন সুন্দরবনের বিখ্যাত শিকারী পশ্চাব্দী গাজীব
গল্প, যিনি তার গৌরবময় শিকারী জীবনে সাতান্নটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার মেরেছেন, যার মধ্যে
একুশটাই ছিল ভয়ঙ্কর মানুষ খেকো , গল্পে গল্পে রাত গভীর হল। একসময় মিন্টুই আওয়াজ দিল, “খিদা লাগছে।”
এর পর সবাই নিজাম ভাইয়ের প্যাক করে দেয়া
খাবার ও প্যাকেট জুস খেয়ে শুয়ে পড়ল।
আসছে..... বাঘ শিকার !
আসছে..... বাঘ শিকার !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন